‘অপারেশন সার্চলাইট’ গনহত্যার কালো রাত
আবু তাহের : মানব ইতিহাসে নিষ্ঠুরতম এক সামরিক অভিযানের নাম ‘অপারেশন সার্চলাইট’। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে দখলদার পাকিস্তানি বাহিনী ঢাকার বুকে এক রাতের ওই অপারেশনে কী নারকীয় হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছিল বিশ্ববাসী প্রথমে তা জানতে পারেনি। নিউ ইয়র্ক টাইমস ’৭১ সালের ২৮ মার্চ এক প্রতিবেদনে জানায়, সেই রাতে নিহত হয়েছে ১০ হাজার মানুষ। কিন্তু ১ এপ্রিলের প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, নিহতের প্রকৃত সংখ্যা ছিল ২৫ হাজার।
আজ সেই ২৫ মার্চ। শোকস্মৃতিবাহী গণহত্যা আর নিষ্ঠুর ধ্বংসযজ্ঞের ‘কালরাত’। দিবসটি এবার প্রথমবারের মতো জাতীয় ‘গণহত্যা দিবস’ হিসেবে পালন করা হচ্ছে। জাতি গভীর বেদনায় নানা আয়োজনে স্মরণ করবে ১৯৭১ সালের এই দিনে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর কাপুরুষোচিত হামলার শিকার নিরীহ শহীদ আর প্রতিরোধ সংগ্রামে আত্মদানকারী বীর যোদ্ধাদের। এ উপলক্ষে রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতারা বাণী দিয়েছেন।
বিগত শতাব্দীর ষাট দশকের স্বাধিকার আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে ১৯৭০ সালের নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে আওয়ামী লীগ। কিন্তু নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর না করে নানা কূটকৌশলের আশ্রয় নেয় পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী। সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে শুরু হয় অসহযোগ আন্দোলন।
বাঙালির স্বাধিকার আন্দোলন একাত্তরের মার্চে রূপ নেয় স্বাধীনতার সংগ্রামে। পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়া খান বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আলোচনার আড়ালে অস্ত্র মজুদ করতে থাকেন। ২৫ মার্চ বঙ্গবন্ধু-ইয়াহিয়ার সিরিজ বৈঠক ব্যর্থ হয়। জেনারেল ইয়াহিয়া বাঙালি হত্যার নীলনকশা বাস্তবায়নের নির্দেশ দিয়ে বিকেলে ঢাকা থেকে পালিয়ে যান। বাংলা তখন অগ্নিগর্ভ।
উত্তাল দিন শেষে ঘনিয়ে আসে আঁধার। বাঙালি জানতে পারেনি কী ভয়ংকর, নৃশংস ও বিভীষিকাময় রাত নামছে বাঙালির জীবনে। ‘অপারেশন সার্চলাইট’ নাম দিয়ে ২৫ মার্চ রাত সাড়ে ১১টার দিকে পাকিস্তানি জল্লাদ বাহিনী দানবীয় নিষ্ঠুরতায় ঝাঁপিয়ে পড়ে স্বাধীনতাকামী নিরস্ত্র মানুষের ওপর।
আকাশ-বাতাস কাঁপিয়ে গর্জে উঠে অত্যাধুনিক রাইফেল, কামান, মেশিনগান, মর্টার। পাকিস্তানি সেনারা হামলে পড়ে পুরান ঢাকা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিক্যাল কলেজ ও সংলগ্ন এলাকা, রাজারবাগ পুলিশ লাইন, পিলখানা ইপিআর (পরে বিডিআর, বর্তমানে বিজিবি) হেডকোয়ার্টার ও আশপাশের এলাকায়। কারফিউ জারি করা হয়। জনবসতিতে দেওয়া হয় আগুন। বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া হয় বিদ্যুৎ সংযোগ। হতচকিত নিরস্ত্র মানুষ কিছু বুঝে ওঠার আগেই ঢলে পড়ে মৃত্যুর কোলে। মধ্যরাতে ঢাকা হয়ে ওঠে লাশের শহর।
হতচকিত বাঙালি সে রাতেই প্রতিরোধে জেগে ওঠে। যার যা আছে তাই নিয়ে স্থানে স্থানে সৃষ্টি করা হয় প্রতিরোধ- ব্যারিকেড। রাজারবাগ পুলিশ সদর দপ্তরে পাকিস্তানি সেনাদের সাঁড়াশি অভিযানের মুখেও বাঙালি পুলিশ সদস্যরা আত্মসমর্পণ না করে গড়ে তোলেন প্রতিরোধ। যদিও শত্রুর ট্যাংক আর ভারী মেশিনগানের ক্রমাগত আক্রমণের মুখে টিকতে না পেরে অকাতরে প্রাণ বিলিয়ে দিতে হয় তাঁদের।
একইভাবে ইপিআর হেডকোয়ার্টারেও বাঙালি সেনারা প্রতিরোধ গড়ার চেষ্টা করেন। সে রাতে পিপলস ডেইলি, গণবাংলা, দৈনিক সংবাদ, ইত্তেফাক ও জাতীয় প্রেস ক্লাবেও অগ্নিসংযোগ, মর্টার শেল ছুড়ে ধ্বংসস্তূপে পরিণত করে পাকিস্তানি হানাদাররা। বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকেও ওই রাতেই গ্রেপ্তার করে পশ্চিম পাকিস্তানে নিয়ে যাওয়া হয়।
তবে এর আগেই তিনি স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়ে যান, যার প্রেক্ষাপটে ২৬ মার্চ স্বাধীনতা দিবস। স্বাধীনতার প্রত্যয়ে দেশজুড়ে শুরু হয় প্রতিরোধ যুদ্ধ। এরপর রাজনৈতিক কর্মী, বাঙালি সৈনিক আর সাধারণ মানুষের সম্মিলিত স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণে ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ, বিপুল প্রাণহানি আর ধ্বংসযজ্ঞের পর ১৬ ডিসেম্বর উদিত হয় স্বাধীনতার সূর্য।
পাকিস্তানি বাহিনী ও তার দোসরদের সেই নিষ্ঠুর হত্যাযজ্ঞ শুরুর দিন ২৫ মার্চকে ‘গণহত্যা দিবস’ হিসেবে পালনের দাবি দীর্ঘদিনের। একাত্তরের ঘাতক-দালাল নির্মূল কমিটি বেশ কয়েক বছর ধরে নানা কর্মসূচি পালন করে আসছে। এ পরিপ্রেক্ষিতে গত ১১ মার্চ জাতীয় সংসদে দিনটিকে জাতীয় গণহত্যা দিবস হিসেবে পালনের প্রস্তাব সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত হয়।
এরপর ২০ মার্চ মন্ত্রিসভা প্রতিবছরের ২৫ মার্চকে গণহত্যা দিবস হিসেবে পালনের প্রস্তাব অনুমোদন করে। ফলে এবারই প্রথমবারের মতো ২৫ মার্চ ‘গণহত্যা দিবস’ পালিত হচ্ছে। সরকার দিবসটিকে আন্তর্জাতিক দিবস হিসেবে স্বীকৃতির জন্য জাতিসংঘে প্রস্তাব পাঠানোর উদ্যোগ নিয়েছে।
দিবসটির বাণীতে রাষ্ট্রপতি বলেছেন, ২৫ মার্চ ‘গণহত্যা দিবস’ পালনের সিদ্ধান্ত দেশ ও জাতির ইতিহাসে এক ঐতিহাসিক মাইলফলক। ‘গণহত্যা দিবস’ বাংলাদেশের মুুক্তিসংগ্রামে ৩০ লাখ বাঙালির আত্মত্যাগের মহান স্বীকৃতির পাশাপাশি তৎকালীন পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বর্বর গণহত্যার বিরুদ্ধেও চরম প্রতিবাদের প্রতীক।
একাত্তরের বীভৎস গণহত্যা শুধু বাংলাদেশের নয়, বিশ্বমানবতার ইতিহাসেও একটি কালো অধ্যায়—এ কথা উল্লেখ করে রাষ্ট্রপতি বলেন, নৃশংস এ হত্যাকাণ্ডের ভয়াবহতা কেউ কোনো দিন ভুলতে পারে না। এমন গণহত্যা আর কোথাও যাতে না ঘটে ‘গণহত্যা দিবস’ পালনের মাধ্যমে সে দাবিই বিশ্বব্যাপী প্রতিফলিত হবে।
বাণীতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, ২৫ মার্চকে ‘গণহত্যা দিবস’ হিসেবে পালনের সিদ্ধান্ত প্রকৃতার্থে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ৩০ লাখ শহীদের আত্মাহুতির প্রতি জাতির চিরন্তন শ্রদ্ধার স্মারক এবং পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর নারকীয় হত্যাকাণ্ডের সাক্ষ্য হিসেবে বিবেচিত হবে।
তিনি বলেন, ‘জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর সরকার যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের জন্য আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনালস) আইন, ১৯৭৩ প্রণয়ন করেছিল। এর আওতায় অনেকের বিচার সম্পন্ন হয়েছিল। কিন্তু পরবর্তীকালে জিয়াউর রহমান অবৈধভাবে ক্ষমতায় এসে যুদ্ধাপরাধীদের মুক্তি এবং বিচারকাজ বন্ধ করে দেন।
শুধু তা-ই নয়, চিহ্নিত যুদ্ধাপরাধীদের রাষ্ট্রক্ষমতার অংশীদার করেন। বেগম জিয়াও স্বামীর পদাঙ্ক অনুসরণ করে গণহত্যার দোসর নিজামী-মুজাহিদদের গাড়িতে জাতীয় পতাকা তুলে দেন। এখন আমরা যুদ্ধাপরাধীদের বিচারকাজ এগিয়ে নিচ্ছি। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশে সংঘটিত গণহত্যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি আদায়ের সর্বাত্মক উদ্যোগ গ্রহণ করেছি। ’
আজ শনিবার রাজধানীসহ সারা দেশে বিভিন্ন রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃৃতিক সংগঠন নানা কর্মসূচি হাতে নিয়েছে। দিনভর থাকছে আলোচনাসভা, শোকসভা এবং রাতে মোমবাতি প্রজ্বালন। শোকাহত বাঙালি ঘৃণা ও ধিক্কার জানাবে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও তাদের এ দেশীয় দোসর রাজাকার, আলবদর ও যুদ্ধাপরাধীদের।
একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির সভাপতি শাহরিয়ার কবির বলেছেন, ‘২৫ মার্চ আন্তর্জাতিক গণহত্যা দিবস পালনের সুযোগ আমরা হারিয়ে ফেলেছি। কারণ ২০১৫ সালের ১১ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ ৯ ডিসেম্বরকে ‘আন্তর্জাতিক গণহত্যা দিবস’ হিসেবে পালনের প্রস্তাব সর্বসম্মতভাবে অনুমোদন করেছে।
এর ফলে আমাদের দীর্ঘদিনের দাবির একটি অংশের কার্যকারিতা থাকছে না। শুধু ২৫ মার্চ নয়, একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধের দীর্ঘ ৯ মাসজুড়ে পাকিস্তানি হানাদাররা যে নারকীয় হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছিল তার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির দাবি করা উচিত। আর এ দাবি করার আগে সরকারের পক্ষ থেকে অনেক কাজ করতে হবে।