হিলারি ১০৪ এবং ট্রাম্প ১৩৭ আসনে এগিয়ে
যুক্তরাষ্ট্র থেকে ইমরুল সাহেদ : আর মাত্র কয়েক ঘন্টা তারপর’ই নিশ্চিত হওয়া যাবে কে হচ্ছেন আমেরিকার প্রেসিডেন্ট। তবে সর্বশেষ ঘোষিত প্রাপ্ত ফলাফলে একটু আগে হিলারি ১০৪ এবং ট্রাম্প ১৩৭ আসনে এগিয়ে। বাংলাদেশ সময় আজ বুধবার সকাল ১০টা নাগাদ জানা যাবে কে হবেন যুক্তরাষ্ট্রের ৪৫তম প্রেসিডেন্ট।
ট্রাম্প যে আসনগুলোতে জয় পেয়েছেন সেগুলো রিপাবলিকানদের শক্ত ঘাঁটি বলেই পরিচিত। যেমন ইন্ডিয়ানা, কেন্টাকি, আলাবামা, ওয়েস্ট ভার্জিনিয়া, ওকলাহোমা, টেনেসি এবং সাউথ ক্যারোলিনা।ওদিকে ক্লিনটনের জয়ের জন্য যেসব সম্ভাব্য ফল আসছে সেগুলো নিয়মিত ভাবেই প্রতি নির্বাচনে ডেমোক্রেটরা যেসব অঙ্গরাজ্যগুলোতে জিতে থাকেন সেগুলো থেকে। যেমন ভারমন্ট, ডেলাওয়ারে, মেরিল্যান্ড, ম্যাসাচুসেটস এবং নিউ জার্সি।
দুটি গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গরাজ্য নর্থ ক্যারোলিনা এবং ওহাইওতে ভোট গ্রহণ শেষ হয়েছে। নর্থ ক্যারোলিনাতে ১৫টি এবং ওহাইওতে ১৮টি ইলেক্টোরাল ভোট রয়েছে।দুটিই সুইং স্টেট। কিন্তু এখনো কোন সম্ভাব্য ফল পাওয়া যায়নি এখান থেকে। ভার্জিনিয়ার দিকেও এখন সবার নজর আছে। এখানে বুথ-ফেরত জরিপ হাড্ডাহাড্ডি লড়াইয়ের আভাস দিচ্ছে।
সরেজমিনে দেখা গেছে, ইতিহাসের এক সন্ধিক্ষণে এখন যুক্তরাষ্ট্র। ভোটারদের রায়ে হিলারি বা ট্রাম্প—যিনিই জিতুন না কেন, তা সৃষ্টি করবে নতুন ইতিহাস। ডেমোক্র্যাট প্রার্থী হিলারি ক্লিনটন জিতলে তিনি হবেন দেশটির প্রথম নারী প্রেসিডেন্ট। অন্যদিকে রিপাবলিকান প্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্প জিতলে রাজনীতিতে বিতর্কের ঝড় তোলা একজন আগন্তুক হবেন দেশের কর্ণধার।
নিউইয়র্কের স্থানীয় সময় মঙ্গলবার সকাল ছয়টা থেকে ভোট গ্রহণ শুরু হয়। হিলারি ভোট দেন নিউইয়র্ক শহরের বাইরে চাপাকুয়াতে, নিজের বাসভবনের কাছে একটি সরকারি বিদ্যালয় কেন্দ্রে। সকাল আটটার দিকে যখন তিনি স্বামী সাবেক প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটনসহ ভোটকেন্দ্রে পৌঁছান, উপস্থিত কয়েক ডজন ভোটার তাঁকে হাততালি দিয়ে স্বাগত জানান।
আগের দিন মধ্যরাতের পর নির্বাচনী সমাবেশ সেরে হিলারি বাসায় ফেরেন। তা সত্ত্বেও তাঁর চেহারায় বিন্দুমাত্র ক্লান্তির ছাপ ছিল না। কয়েকজন ভোটারের সঙ্গে করমর্দন শেষে তিনি সাংবাদিকদের জানান, দীর্ঘ প্রচারণা শেষে ভোটের দিনে এসে তিনি এখন খুবই কৃতজ্ঞ বোধ করছেন। হিলারি বলেন, অনেক মানুষ এই নির্বাচনের ফলের অপেক্ষায় আছেন। তিনি প্রতিশ্রুতি দেন, নির্বাচিত হলে দেশের মানুষের প্রত্যাশা পূরণে তিনি সাধ্যমতো চেষ্টা করবেন। হাস্যমুখ থেকে বোঝা যাচ্ছিল, নিজের বিজয়ের ব্যাপারে আশাবাদী হিলারি।
ডোনাল্ড ট্রাম্পও ভোট দেন নিউইয়র্কে। বেলা ১১টার দিকে মধ্য ম্যানহাটনে তাঁর বাসভবন ট্রাম্প টাওয়ারের কাছে একটি সরকারি স্কুলে ভোট দেন তিনি। হেঁটে ভোটকেন্দ্রে আসার সময় পথের দুই ধারে দাঁড়িয়ে থাকা বেশ কিছু লোক তাঁর উদ্দেশে ‘দুয়ো ধ্বনি’ দেন। তাঁদের মধ্যে কেউ কেউ চিৎকার করে বলেন, ‘নিউইয়র্ক তোমাকে চায় না’। ট্রাম্পের সঙ্গে তাঁর স্ত্রী মেলানিয়াও একই কেন্দ্রে ভোট দেন। এ সময় তাঁকে বেশ ফুরফুরে দেখাচ্ছিল।
ভোট দিতে যাওয়ার আগে ফক্স নিউজকে ট্রাম্প বলেন, নিজের জয়ের ব্যাপারে তিনি অত্যন্ত আশাবাদী। তিনি বলেন, ‘আমি জরিপের কোনো ভক্ত নই। অধিকাংশ জনমত জরিপ নির্ভরযোগ্য নয়। আমরা অনেক অঙ্গরাজ্যে জয়লাভ করব।’
প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা অবশ্য নিজের ভোটটা আগেই দিয়ে রেখেছিলেন, গত ৭ অক্টোবর নিজের শহর শিকাগোতে ভোট দেন তিনি। ফলে ঘুম থেকে উঠে ভোটকেন্দ্রে যাওয়ার কোনো তাড়া তাঁর ছিল না। গতবার নির্বাচনের দিন তিনি নিকট বন্ধুদের হোয়াইট হাউসের জিম বা ক্রীড়াকক্ষে তাঁর সঙ্গে বাস্কেটবল খেলার আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। এবারও সেটাই করেন।
ভোট চলাকালেই গতকাল ট্রাম্প শিবির নেভাদার ক্লার্ক কাউন্টির নির্বাচনী কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেছে। এখানে বিপুলসংখ্যক হিস্পানিক ভোটারকে ভোটদানে সাহায্য করতে নির্ধারিত সময়ের পরেও দুই ঘণ্টা কেন্দ্র খোলা রাখা হয়। এটি নিয়মের লঙ্ঘন, এই অভিযোগে মামলা করেছে ট্রাম্প শিবির। তবে একজন নির্বাচন কর্মকর্তা বলেছেন, ভোট গ্রহণের সময় বাড়ানো হয়নি। তবে সময় শেষ হওয়ার আগে যাঁরা লাইনে ছিলেন, তাঁদের ভোট নেওয়া হয়েছে।
অন্যদিকে ফ্লোরিডার ব্রোওয়ার্ড কাউন্টিতে অনিয়মের অভিযোগে দুজন নির্বাচন কর্মীকে বরখাস্ত করেছে নির্বাচন বোর্ড। তবে তাঁরা কী ধরনের অনিয়ম করেছেন, তা অবশ্য জানানো হয়নি।মার্কিন মুলুকজুড়ে মঙ্গলবার সকালে ভোট নেওয়া শুরু হলেও ঐতিহ্য মেনে মঙ্গলবার প্রথম প্রহরে অর্থাৎ মধ্যরাতে ভোট হয় নিউ হ্যাম্পশায়ারের তিনটি ছোট গ্রামে।
এর মধ্যে সবচেয়ে ছোট গ্রাম ডিক্সিভিল নচ, সেখানে ভোটার মাত্র আটজন। ফলাফল: হিলারি ৪, ট্রাম্প ২, লিবার্টেরিয়ান পার্টির গ্যারি জনসন ১। আরেকজন ভোটার ভোট দেন গতবারের রিপাবলিকান প্রার্থী মিট রমনিকে।এই রাজ্যের আইন অনুসারে ১০০ জনের কম জনসংখ্যা এমন শহর বা গ্রাম মধ্যরাতে ভোট গ্রহণ করার অধিকার রাখে।
সেই আইনের ভিত্তিতে এই রাজ্যে মোট তিনটি গ্রামে মধ্যরাতে ভোট গ্রহণ সম্পন্ন হয়। ডিক্সিভিল নচ হিলারির পক্ষে গেলেও বাকি দুটি গ্রামে জয়ী হন ট্রাম্প। তিন গ্রামের চূড়ান্ত ফল: ৩২ ট্রাম্প, ২৫ হিলারি।
রিপাবলিকানপন্থী হিসেবে পরিচিত ক্ষুদ্র এই তিন গ্রামের ফলাফল দেখে পুরো নির্বাচনের গতিপ্রকৃতি অনুমান করা ভুল হবে। এই তিন গ্রাম ১৯৬০ সাল থেকে প্রতিটি নির্বাচনে রিপাবলিকান প্রার্থীকেই ভোট দিয়েছে। একমাত্র ব্যতিক্রম ছিল ২০০৮ সালে, সেবার বারাক ওবামা জয়ী হয়েছিলেন।
তবে আগাম ভোটের ফলাফলের ভিত্তিতে এ কথা বলা যায়, নির্বাচনের হাওয়া হিলারির পক্ষে। প্রায় ৪ কোটি ৩০ লাখ মানুষ আগাম ভোট দিয়েছেন। নেভাদা ও ফ্লোরিডায় হিস্পানিক ভোটারদের অভাবিত অংশগ্রহণের ফলে এই দুই রাজ্য হিলারি কবজা করতে পেরেছেন—এ কথা অধিকাংশ নির্বাচন বিশ্লেষকের।
বিখ্যাত নির্বাচন পরিসংখ্যানবিদ নেট সিলভার জানিয়েছেন, সব জনমত জরিপের গড় হিসাব অনুসরণ করে যে নির্বাচনী মডেল তিনি নির্মাণ করেছেন, তাতে হিলারির জয়ের সম্ভাবনা ৭০ শতাংশ। তাঁর হিসাবে জাতীয় জনমত জরিপে হিলারি ৩ দশমিক ৫ পয়েন্টে ট্রাম্পের চেয়ে এগিয়ে। ৪৮ ঘণ্টা আগেও এই ব্যবধান ছিল ২ দশমিক ৯। তাঁর মডেল অনুসারে নেভাদা, নর্থ ক্যারোলাইনা ও ফ্লোরিডা হিলারির খাতায় থাকার সম্ভাবনা বেশি।
সঠিকভাবে ভবিষ্যৎ গণনার জন্য নেট সিলভারের খ্যাতি আছে। গত দুটি নির্বাচনে তিনি সঠিকভাবে চূড়ান্ত বিজয়ী কে হবেন, সে কথা আগাম বলতে পেরেছিলেন। শুধু তা-ই নয়, প্রায় প্রতিটি অঙ্গরাজ্যের ফলাফলও তিনি সঠিকভাবে নির্ধারণে সক্ষম হন।
অন্যদিকে নিউইয়র্ক টাইমস-এর ব্যবহৃত মডেল অনুসারে হিলারি ক্লিনটনের জয়ের সম্ভাবনা ৮৪ শতাংশ। উভয় মডেলই ভবিষ্যদ্বাণী করেছে, খুব অল্প ব্যবধানে হলেও এ বছর মার্কিন সিনেটের নিয়ন্ত্রণও হাতবদল হয়ে ডেমোক্র্যাটদের কাছে আসবে। মাত্র অতিরিক্ত চারটি আসন দখলে সক্ষম হলেই তাদের পক্ষে এই গুরুত্বপূর্ণ বিজয় সম্ভব।
ডেমোক্র্যাটদের জন্য এই বিজয় প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের চেয়ে কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। রিপাবলিকান নেতৃত্ব ইতিমধ্যেই ঘোষণা করেছেন, হিলারি প্রশাসনের প্রথম দিন থেকেই তাঁরা তাঁর বিরুদ্ধে অবস্থান নেবেন এবং সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি হিসেবে কোনো উদারনৈতিক প্রার্থীকে সমর্থন জানাবেন না। কংগ্রেসের নিম্নকক্ষ বা প্রতিনিধি পরিষদের নিয়ন্ত্রণ রিপাবলিকানদের হাতে থেকে গেলেও সিনেট হাতছাড়া হলে হিলারির অ্যাজেন্ডা বাস্তবায়নে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি তাদের জন্য সহজ হবে না।
নির্বাচন বিশ্লেষকেরা জানাচ্ছেন, হিলারির জয়ের সম্ভাবনা আগের চেয়ে উজ্জ্বল হওয়ার বড় কারণ আগাম ভোটে হিস্পানিকদের অভাবিত সংখ্যায় অংশগ্রহণ। ট্রাম্প মেক্সিকানদের ‘ধর্ষণকারী ও মাদক ব্যবসায়ী’ হিসেবে মন্তব্য করায় এ দেশের হিস্পানিক নাগরিকেরা ক্ষুব্ধ। ব্যালটে তাঁরা ট্রাম্পের সে কথার মোক্ষম জবাব দিয়েছেন। হিস্পানিকরা যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে বড় সংখ্যালঘু গোষ্ঠী, তারা মোট জনসংখ্যার ১৭ শতাংশ। দ্বিতীয় বড় গোষ্ঠী আফ্রিকান-আমেরিকান, তারা মোট জনসংখ্যার ১৩ শতাংশ।
অন্য যে বিষয়টি হিলারিকে সাহায্য করছে, তা হলো গত রোববার মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা এফবিআই-প্রধানের ঘোষণা। তিনি জানিয়ে দেন, হিলারির ই-মেইলে তাঁরা নতুন কিছুই পাননি। ফলে হিলারির বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দাখিলের কোনো সম্ভাবনা নেই। নির্বাচনের দুই সপ্তাহ আগে এফবিআই-প্রধানই বলেছিলেন, হিলারির ব্যক্তিগত সহকারী হুমা আবেদিনের ল্যাপটপে সন্দেহজনক ই-মেইল পাওয়া গেছে। সে কারণে তাঁরা হিলারির ই-মেইল প্রশ্নে তদন্ত নতুন করে শুরু করবেন। এই ঘোষণাকে নির্বাচনী প্রচারের মূল বিষয় বলে ডোনাল্ড ট্রাম্প যুক্তি দেখান, নির্বাচিত হলেও হিলারি দেশ শাসন করতে পারবেন না। কারণ, ক্ষমতা গ্রহণের প্রথম দিন থেকেই তাঁকে আইনি ঝামেলায় পড়তে হবে। জনমতের ওপরও এফবিআইয়ের এই ঘোষণা প্রভাব ফেলে।