৫ জানুয়ারি ‘গণতন্ত্রের বিজয় বনাম ‘গণতন্ত্র হত্যা..
প্রিয়া রহমান.ঢাকা:
৫ জানুয়ারিকে ‘গণতন্ত্রের বিজয় দিবস’ আখ্যা দিয়ে কাল ‘বিজয় উৎসব’ করার কর্মসূচি নিয়েছে আওয়ামী লীগ। আর দিনটিকে ‘গণতন্ত্র হত্যা’ দিবস হিসেবে পালন করতে কাল নয়াপল্টনে সমাবেশ করার ঘোষণা দিয়েছে বিএনপি।গত এক বছরে সরকার বড় ধরনের চাপে না পড়লেও এক ধরনের অস্বস্তি রয়েছে সবার মধ্যে। সবার অংশগ্রহণে নির্বাচন না হওয়ায় দেশ-বিদেশে সরকারের সমালোচনা আছে। তবে এ বিষয়ে আন্তর্জাতিক মহল এখন আর আগের মতো সরব নয়।২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি প্রধান বিরোধী জোটের অংশগ্রহণ ছাড়াই ‘একতরফা’ নির্বাচনে আবার ক্ষমতায় আসে আওয়ামী লীগ। আর নির্বাচন বর্জন করে অবরোধ ও আন্দোলনের মাধ্যমে শক্তি পরীক্ষায় হেরে যায় বিএনপি-জামায়াতসহ ১৮-দলীয় জোট।সমঝোতা ও সংলাপ ব্যর্থ করে শক্তি পরীক্ষার জয়-পরাজয়ের সেই ৫ জানুয়ারি কাল।
সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতার কারণ দেখিয়ে পুলিশ, প্রশাসন ও দলীয় শক্তির জোরে সেদিন একতরফা নির্বাচন সম্পন্ন করেছিল আওয়ামী লীগ। আর গণতন্ত্র হত্যার অভিযোগ তুলে নির্বাচন বর্জন করে আন্দোলনের পথ বেছে নিয়েছিল বিএনপি-জামায়াত।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা বলছেন, ওই নির্বাচনের মাধ্যমে সাংবিধানিক ধারাবাহিকতা রক্ষা হয়েছে, এটা সত্য। কিন্তু বিপন্ন হয়েছে গণতন্ত্র। জাতীয় সংসদ থাকলেও সেখানে গৃহপালিত বিরোধী দল থাকায় অধিবেশনকক্ষ থাকছে নিষ্প্রাণ।
দুই জোটের অনমনীয় মনোভাবের মধ্যে সাধারণ মানুষের প্রত্যাশা ছিল, নিয়ম রক্ষার এই নির্বাচনের পর সবার অংশগ্রহণে আরেকটি নির্বাচন হবে। এই প্রত্যাশার পেছনে দৃষ্টান্ত ছিল ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারির নির্বাচন, ওই সময় বিএনপির নেতৃত্বাধীন জোট বিরোধী দল ছাড়াই একতরফা নির্বাচন করে। পরে আওয়ামী লীগের দাবির মুখে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিষয়টি সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করে সেই সরকারের অধীনে নির্বাচন হয়। বিজয়ী হয়ে সরকার গঠন করেছিল আওয়ামী লীগ।
ওই নির্বাচনের পর যত শিগগির সম্ভব সব দলের অংশগ্রহণে আরেকটি নির্বাচন অনুষ্ঠানে জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক মহলের তাগিদ ছিল। ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের আগে-পরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও সরকারি দলের শীর্ষস্থানীয় নেতারা সংলাপ এবং মধ্যবর্তী বা অন্তর্বর্তী নির্বাচন বিষয়ে নমনীয় মনোভাব দেখান। কিন্তু পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার পর এখন সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, সংবিধান অনুযায়ী নির্ধারিত সময় ২০১৯ সালেই নির্বাচন হবে।
জানুয়ারির নির্বাচনে ১৫৩টি সংসদীয় আসনে ভোট ছাড়াই সাংসদ নির্বাচিত হন আওয়ামী লীগের নেতারা। বাকি ১৪৭টি আসনে ভোট হলেও প্রধান বিরোধী জোট না থাকায় প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয়নি এবং ভোটারের আগ্রহ ছিল কম।
বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের উপায় সম্পর্কে জানতে চাইলে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা আকবর আলি খান বলেন, এই অবস্থা কবে, কোথায় গিয়ে শেষ হবে, তা কেউ বলতে পারে না। তবে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে শুভবুদ্ধির উদয় হলে এই সংকটের সমাধান হতে পারে।
৫ জানুয়ারি, ২০১৪ থেকে ৫ জানুয়ারি, ২০১৫—এই এক বছরের মূল্যায়ন করতে গিয়ে আকবর আলি খান বলেন, ‘আমরা সংঘাতের মধ্যে ছিলাম, সংঘাতের মধ্যে আছি এবং ভবিষ্যতেও থাকব, এটুকু বলা যায়।’
গত এক বছরে সরকার বড় ধরনের চাপে না পড়লেও এক ধরনের অস্বস্তি রয়েছে সবার মধ্যে। সবার অংশগ্রহণে নির্বাচন না হওয়ায় দেশ-বিদেশে সরকারের সমালোচনা আছে। তবে এ বিষয়ে আন্তর্জাতিক মহল এখন আর আগের মতো সরব নয়।
গত নির্বাচনের ঠিক আগে বিরোধী জোটকে সামাল দিতে সরকার যখন ব্যস্ত, তখন এইচ এম এরশাদকে নিয়ে শুরু হয় নাটক। বিএনপি-জামায়াতকে বাদ দিয়ে নির্বাচন করার সব আয়োজন যখন প্রায় সম্পন্ন, তখনই এরশাদ মহাজোট ছাড়ার ঘোষণা দেন। শেষমেশ এরশাদকে সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে (সিএমএইচ) আটকে রেখে রওশন এরশাদের নেতৃত্বে জাতীয় পার্টিকে নির্বাচনে অংশ নিতে বাধ্য করা হয়।
৫ জানুয়ারির নির্বাচনে বিএনপির নেতৃত্বাধীন জোট শক্তির জোরে ও রাজনৈতিক কূটচালে আওয়ামী লীগের সঙ্গে পেরে উঠতে পারেনি। এর কারণ হিসেবে নেতৃত্বের ব্যর্থতা, দলীয় বিরোধ, সরকারের ফাঁদে পা দেওয়া এবং মাঠের শক্তি পরীক্ষায় হেরে যাওয়া।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে রাষ্ট্রবিজ্ঞানী এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য এমাজউদ্দীন আহমদ বলেন, গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় ক্ষমতার ভিত্তি হচ্ছে জনসমর্থন। কিন্তু ভোট ও প্রতিদ্বন্দ্বিতা ছাড়া ওই নির্বাচনের মাধ্যমে ১৫৩ জন সাংসদ হয়ে গেলেন। বাকি আসনগুলোতে ৪০ শতাংশ ভোট পড়েছে বলা হলেও ৬০ শতাংশের অংশগ্রহণ নেই। এটা গণতন্ত্রের কোনো কাঠামোর মধ্যেই পড়ে না।
তাঁর মতে, দেশে রাজনীতি যে পর্যায়ে বিষাক্ত হয়ে গেছে, যেভাবে সর্বত্র দলের আনুগত্য ও নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা হয়েছে, তাতে সুশাসন বলে কিছু অবশিষ্ট নেই। ক্ষমতাসীনদেরও নৈতিক ভিত্তি নেই। এখন ক্ষমতার জোরে যত দিন চলা যায় তত দিনই তারা চলবে।
জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হারুন-অর-রশিদ মনে করেন, গত এক বছরে দেশে মোটামুটি শান্তিপূর্ণ অবস্থা বজায় থাকলেও ক্ষমতাসীন ও বিরোধী জোটের দূরত্ব আগের চেয়ে বেড়েছে। রাজনীতিতে যে মুখোমুখি অবস্থান চলছে, শিগগির তা নিরসনের সম্ভাবনা নেই। তিনি বলেন, পারস্পরিক আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে একটি নির্বাচনের কথা সবাই বলছেন, এটা দরকারও। কিন্তু লন্ডনে বসে তারেক রহমান যেভাবে মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে উসকানিমূলক ও কুরুচিপূর্ণ বক্তব্য দিচ্ছেন, তাতে সব সম্ভাবনাই ক্ষীণ হয়ে যাচ্ছে।
গত এক বছরে বিএনপি-জামায়াতের নেতৃত্বাধীন জোটের কর্মসূচি পর্যালোচনা করে দেখা যায়, মুখে আন্দোলনের কথা বললেও গত এক বছরে জনসম্পৃক্ত কোনো আন্দোলন করতে পারেনি তারা। এর আগে আন্তর্জাতিক মহল, কূটনীতিক ও দাতাদের ওপর অতিনির্ভরতা দলটিকে নিষ্ক্রিয় করে দেয় বলে শীর্ষস্থানীয় নেতাদের অনেকেই মনে করছেন।
নির্বাচনের আগে ঢাকায় সফররত জাতিসংঘের সহকারী মহাসচিব অস্কার ফার্নান্দেজ তারানকোর নেতৃত্বাধীন জাতিসংঘ প্রতিনিধিদলের সঙ্গে শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়াসহ আওয়ামী লীগ এবং বিএনপির প্রতিনিধিদলের কয়েক দফা আলোচনা হয়। কিন্তু কোনো সমাধান ছাড়াই ১০ ডিসেম্বর তিনি ঢাকা ছাড়েন। তারানকো ঢাকায় এসে নির্বাচন পেছানো যায় কি না, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে তা জানতে চেয়েছিলেন। জবাবে প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন, সংবিধানের বাইরে যাওয়া তাঁর পক্ষে সম্ভব নয়।
পরস্পরের কাছে গ্রহণযোগ্য সমাধানের মাধ্যমে একটি ‘অংশগ্রহণমূলক ও সহিংসতামুক্ত’ নির্বাচনের জন্য দুই দলকে সংলাপে উৎসাহ জোগাতে তারানকোর নেতৃত্বে সেটিই ছিল জাতিসংঘের শেষ উদ্যোগ। তবে আলোচনার জন্য সময় কমে গেলেও সংলাপে বসতে সব ধরনের উদ্যোগ অব্যাহত রাখার আহ্বান রেখে যান তিনি। রাজনৈতিক সংকট কাটাতে জাতিসংঘের মহাসচিব বান কি মুনের প্রতিনিধি হিসেবে তারানকো এর আগেও দুবার ঢাকা সফর করেন।
তৃতীয়বার তারানকোর সফরের পর সংলাপ ও সমঝোতার সম্ভাবনা ক্ষীণ হয়ে যায়। নির্বাচন প্রতিহত করতে গত বছরের প্রথম দিন থেকেই অনির্দিষ্টকালের জন্য সড়ক, নৌ ও রেলপথ অবরোধের ডাক দিয়েছিল বিরোধী জোট। এর আগে ২৫ নভেম্বর নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর ২৬ নভেম্বর থেকে ২৪ ডিসেম্বর পর্যন্ত ‘গণতন্ত্রের অভিযাত্রা’ নামে পাঁচ দফা অবরোধ কর্মসূচি পালন করে জোট।
প্রশাসন, পুলিশ এবং সরকারদলীয় নেতা-কর্মীদের সক্রিয় অংশগ্রহণে ৫ জানুয়ারি নির্বাচনী বৈতরণি পার হলেও এর রেশ এখনো চলছে।