• মঙ্গলবার , ২৪ ডিসেম্বর ২০২৪

৩ তাজা প্রাণের করুণ পরিণতি কেন! পল্লী বিদ্যুৎ বিআরটিসির খামখেয়ালিপনা


প্রকাশিত: ৩:৫৭ এএম, ২৪ নভেম্বর ২৪ , রোববার

নিউজটি পড়া হয়েছে ২৬ বার

 

 

গাজীপুর থেকে প্রিয়া রহমান : পল্লী বিদ্যুৎ এর খামখেয়ালিতে আইইউটির তিন শিক্ষার্থীর করুণ মৃত্যু হয়েছে। নিহত তিন শিক্ষার্থী হলেন, মোবতাছির রহমান মাহিন (২২), মোজাম্মেল হোসেন নাইম (২৩), এবং জুবায়ের রহমান সাকিবকে (২৩)। এই ছাত্ররা পিকনিক করতে যাচ্ছিল বিআরটিসির ডাবল ডেকার বাসে করে। কিন্তু পল্লী বিদ্যুৎ এর ঝুলন্ত তারের মৃত্যুফাঁদে মূহুর্তে বাস তড়িতাহত হয়ে ৩ ছাত্রের জীবন প্রদীপ নিভে যায়। আনন্দ যাত্রা নিমিষেই ধূলায় লুটায়ে পড়ে। গাজীপুরের শ্রীপুর উপজেলার তেলিহাটি ইউনিয়নের উদয়খালী গ্রামের মানুষের তখন আর্ত চিৎকার করতে থাকে। শান্ত পরিবেশ হঠাৎ-ই খানখান হয়ে যায় আর্ত-চিৎকারে। ঘটনাস্থলের কাছের স্থানীয় বাসিন্দা জাকির হোসেন, প্রথমে শুনতে পান – ‘আগুন, আগুন’ বলে চিৎকার।

প্রত্যক্ষদর্শী শামীম বলেন, তাদের চিৎকার শুনে আমরা বাসের কাছে ছুটে যাই। বিদ্যুতায়িত হওয়া বাসের ভেতরে তিনজন ছাত্রকে শকড (বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে স্থবির) অবস্থায় দেখি, তাদের মধ্যে দুইজনের শরীর একসাথে আটকে ছিল। তখন আমরা লক্ষ করি, পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির ঝুলে থাকা উন্মুক্ত বিদ্যুতের লাইনের (কাভারহীন তারের) সংস্পর্শে এসেছে বাসটি। তখন সকাল সাড়ে ৮টা, গাজীপুরের শ্রীপুর উপজেলার তেলিহাটি ইউনিয়নের উদয়খালী গ্রামের শান্ত পরিবেশ হঠাৎ-ই খানখান হয়ে যায় আর্ত-চিৎকারে। ঘটনাস্থলের কাছেই নিজ বাড়িতে ছিলেন স্থানীয় বাসিন্দা জাকির হোসেন, প্রথমে তিনিই শুনতে পান – ‘আগুন, আগুন’ বলে চিৎকার।

আমরা বুঝতে পারি, বাসের মধ্যে থাকা ওই শিক্ষার্থীরা বিদ্যুৎতায়িত হয়েছেন, তখন শুকনো বাঁশ দিয়ে একসাথে শকড হওয়া দুইজনের শরীর আলাদা করি। পরে স্থানীয়রা পল্লী বিদ্যুৎ অফিসে ফোন দিয়ে বিদ্যুৎ লাইনের সংযোগ বন্ধ করতে বললে তারা বন্ধ করে দেয়। তা নাহলে আরো ছাত্র মারা যেত” – বলছিলেন শামীম।

শনিবার (২৩ নভেম্বর) সকালে উদয়খালী গ্রামের স্থানীয় চায়না কারখানার সামনে ইসলামিক ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজি (আইইউটি) বিশ্ববিদ্যালয়ের পিকনিক বাস বিদ্যুতায়িত হয়ে এ দুর্ঘটনা ঘটে। বিশ্ববিদ্যালয়ের ৪৬০ শিক্ষার্থী স্থানীয় ‘মাটির মায়া রিসোর্টে’ বনভোজনের উদ্দেশ্যে বিআরটিসির পাঁচটি দ্বিতল বাস ভাড়া করেছিলেন। যাওয়ার পথে একটি বাস পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির ১১ হাজার কেভি লাইনের সংস্পর্শে এসে বিদ্যুতায়িত হয়ে এ দুর্ঘটনা ঘটে।

বিশ্ববিদ্যালয়ের মেকানিক্যাল অ্যান্ড প্রডাকশন ইঞ্জিনিয়ারিং এবং ইলেকট্রিক্যাল অ্যান্ড ইলেকট্রনিক ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের বার্ষিক বনভোজন ছিল। রিসোর্ট থেকে আধা কিলোমিটার দূরে বহরে থাকা পাঁচ নম্বর বাসটি বিদ্যুতায়িত হয়।স্থানীয় ও প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, যেখানে দুর্ঘটনা ঘটেছে সেটি একটি ছোট গ্রামীণ সংযোগ সড়ক। রাস্তাটি এতই ছোট যে, পাশাপাশি দুটি যানবাহন চলতে পারে না। যাত্রাপথে আরেকটি গাড়িকে সাইড দিতে গিয়ে ওই বাসটি রাস্তার একদিকে একটু বেশি সরে আসলে– খোলা তারের সাথে ধাক্কা লাগে। সঙ্গেসঙ্গে পুরো বাস বিদ্যুতায়িত হয়, এবং লোহার যেকোনো কিছু যারা ধরে ছিলেন– তাঁরা বিদ্যুতাস্পৃষ্ট হয়ে পড়েন।

জাকির বলেন, ‘বিদ্যুৎ সংযোগ বন্ধ করার পরে আমরা বাসে ওঠে দেখি একজন শিক্ষার্থীর নিথর দেহ পড়ে রয়েছে। কয়েকজন মিলে লাশটি নিচে নামাই। বাসে থাকা প্রায় ৬০ জন শিক্ষার্থী বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে ও আগুনে আহত হন। তাঁদের শরীরের বিভিন্ন স্থান আগুনে পুড়ে গিয়েছিল। দ্রুত আহতদের অটোরিকশায় করে হাসপাতালে পাঠাই।’

বাসে আগুন লাগছে- শিক্ষার্থী মাহিদ হাসান শিশির ঘটনার হৃদয়বিদারক বর্ণনা দেন। তিনি বলেন, “আমাদের বাসটি আগে ছিল, তার পেছনে ছিল বিদ্যুতায়িত হয়ে আগুন লাগা বাসটি। আমাদের বাসে সবাই প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী। পেছনে বড় ভাইদের বাস। গ্রামীণ রাস্তা সরু থাকায় বাসগুলো ধীরে ধীরে এগিয়ে যাচ্ছে। পেছনের বাস থেকে হঠাৎ করে ডাক চিৎকার শুনতে পাই। তারা আগুন আগুন বলে চিৎকার করছিল। আর বলছিল, ‘তোমাদের কাছে পানি আছে— দ্রুত পানি দাও। আমাদের বাসে আগুন লাগছে। পানি দাও।’

শিশির বলেন, আমরা দ্রুত বাস থেকে নেমে আমাদের কাছে থাকা বোতলের পানি ছিটাতে থাকি। এসময় বাস থেকে প্রচুর ধোঁয়া বের হতে শুরু করে। এ সময় আমাদের আর্ত-চিৎকারে আশপাশের স্থানীয় লোকজন আমাদের সহযোগিতায় এগিয়ে আসেন। তারাও পানি ছিটানো শুরু করেন। এসময় স্থানীয়রা বলেন, একজন মারা গেছে।আশপাশের মানুষ আমাদের উদ্ধার করে নিরাপদ স্থানে সরিয়ে আনে। ওদিকে কী হয়েছে– আমরা বলতে পারব না। আমরা হেঁটে, কেউ অটোরিকশা করে রিসোর্টে আসি। যারা হতাহত হয়েছে, তাদের হাসপাতালে নিয়ে যান স্থানীয়রা- বলছিলেন তিনি।

নিহতদের পরিচয়- এই দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছেন ৩ শিক্ষার্থী, তাঁরা হলেন – মোবতাছির রহমান মাহিন (২২), তিনি রংপুর সদরের ইমতিয়াজুর রহমানের ছেলে। মোজাম্মেল হোসেন নাইম (২৩), তিনি ফেনীর মাস্টারপাড়া এলাকার মোতাহার হোসেনের ছেলে এবং জুবায়ের রহমান সাকিবকে (২৩), তিনি রাজশাহীর রাজপাড়া ডিঙ্গাবো এলাকার জাহাঙ্গীর আলমের ছেলে।এর মধ্যে মোবতাছির রহমান মাহিন ঘটনাস্থলেই নিহত হন। গুরুতর আহত মোজাম্মেল হোসেন নাইম (২৩) ও জুবায়ের রহমান সাকিবকে (২৩) ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসাপাতালে নিয়ে গেলে চিকিৎসক তাদেরকে মৃত ঘোষণা করেন।অপর, আহত ৬ জনকে ময়মনসিংহ মেডিকেল হাসপাতালে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। তারা প্রত্যেকেই আইইউটি’র ইলেক্ট্রিক বিভাগের তৃতীয় বর্ষের শিক্ষাথী। আহতদের পরিচয় পাওয়া যায়নি।

ক্ষুদ্ধ ছাত্র জনতা- এ ঘটনায় ক্ষোভ বিরাজ করছে স্থানীয়দের মধ্যেও। জাকির হোসেন বলেন, গ্রামীণ আঞ্চলিক সড়কটি বেশ সরু — যেখানে মিনিবাস চলাই কঠিন, সেই রাস্তায় কী করে বিআরটিসি’র ডাবল ডেকার বাস প্রবেশ করানো হলো? এই সড়কে ডাবল ডেকার বাস প্রবেশ করবে কিনা সেটা আগে থেকেই বিবেচনা করার দরকার ছিল। তাঁর ওপর রাস্তার পাশেই নীচু হয়ে ঝুলেছিল বিদ্যুৎ লাইনের উন্মুক্ত তার।রিসোর্ট কর্তৃপক্ষও বিষয়টি বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্তৃপক্ষের নজরে আনেনি। এ কারণে ঘটনার দায় বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ও রিসোর্ট কর্তৃপক্ষ এড়াতে পারেন না।’

তবে, আইইউটির উপ-উপাচার্য রাকিবুল ইসলাম ঘটনাস্থল পরিদর্শন শেষে সাংবাদিকদের বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন বিভাগের পিকনিকের জন্য প্রতি বছরেই আমরা ডাবল ডেকার বাস বাস ব্যবহার করি। দুর্ভাগ্যজনকভাবে এবারে দুর্ঘটনা ঘটলো। এই ঘটনায়, পরস্পরকে দোষারোপ না করে – কীভাবে আহতদের সুচিকিৎসা-সহ অন্যান্য বিষয় নিশ্চিত করতে কাজ করতে হবে। তবে তদন্তের পরই বলা যাবে এটি দুর্ঘটনা কিনা।

বনভোজনে যাওয়ার পথটি দ্বিতল বাস চলাচলের উপযুক্ত না হলেও কেন— শিক্ষার্থীদের এই বাসে করে নেওয়া হচ্ছিল এমন প্রশ্নে উপ-উপাচার্য আরো বলেন, সংশ্লিষ্ট বিভাগ কেন ডাবল ডেকারের বাস ভাড়া নিল সেটি আমার জানা নেই। যারা বাস ভাড়া দেয়, সেই বিআরটিসি তো ভালো জানবে বিষয়টি। রাস্তা দিয়ে ডাবল ডেকারের বাস যেতে পারবে কি পারবে না, এটি বিআরটিসির দায়িত্ব।

এদিকে স্থানীয়দের অভিযোগ, পল্লী বিদ্যুতের সরবরাহ লাইনের তারটি দীর্ঘদিন ধরে নীচু হয়ে ঝুলেছিল। আমরা খুব ঝুঁকির মধ্যে আছি। পল্লী বিদ্যুৎ কর্তৃপক্ষ যদি তারটি খোলা না রেখে কভার ব্যবহার করতো, বা ঝুলে যাওয়ার পর তারটি ওপরে তুলে রাখার ব্যবস্থা করতো – তাহলে এতবড় দুর্ঘটনা ঘটতো না।

পৃথক দুটি তদন্ত কমিটি গঠন- পিকনিকের বাসে বিদ্যুৎপৃষ্ট হয়ে তিন শিক্ষার্থী মৃত্যু ও হতাহতের ঘটনায় গাজীপুর জেলা প্রশাসন ও আইইউটি কর্তৃপক্ষ পৃথক দুটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছে। গাজীপুরের অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট সালমা আক্তার ও আইইউটি’র প্রো-ভিসি রাকিবুল ইসলাম তদন্ত কমিটি গঠনের বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।

গাজীপুর জেলা প্রশাসক নাফিসা আরেফিন জানান, তিনি চার সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি ঘঠন করেছেন। কমিটিতে অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট সালমা আক্তারকে প্রধান করা হয়েছে। এ কমিটির অপর সদস্যরা হলেন, শ্রীপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) ব্যরিষ্টার সজীব আহমেদ, শ্রীপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) জয়নাল আবেদীন মণ্ডল ও ময়মনসিংহ পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি-২ এর উপ-মহাব্যবস্থাপক (ডিজিএম) খন্দকার মাহমুদুল হাসান।
অপরদিকে, আইইউটির প্রো-ভিসি জানিয়েছেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে পাঁচ সদস্য বিশিষ্ট একটি উচ্চ-পর্যায়ের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। তদন্ত কমিটির প্রধান তিনি নিজে। কমিটিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিন, রেজিস্ট্রার ও কন্ট্রোলারগণ রয়েছেন।