• শনিবার , ১৬ নভেম্বর ২০২৪

২৪ পরিবারের ঈদের আনন্দ-স্বপ্ন কেঁড়ে নিল কেমিক্যালের আগুন


প্রকাশিত: ৩:০৪ এএম, ১১ সেপ্টেম্বর ১৬ , রোববার

নিউজটি পড়া হয়েছে ১৯৬ বার

 

সরেজমিনে মোস্তফা কামাল প্রধান :   000গাজীপুরের টঙ্গীর বিসিক শিল্পনগরীতে কেমিক্যাল ও ফয়েল পেপার তৈরির একটি কারখানায় বিস্ফোরণ থেকে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। এতে ২৪ জনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। আহত হয়েছেন অন্তত ৫০ জন। এখনো পাঁচতলা ওই কারখানা ভবনের বিভিন্ন স্থানে আগুন জ্বলছে। আগুন নেভাতে কাজ করছে ফায়ার সার্ভিসের ২৫টি ইউনিট। এ দুর্ঘটনায় যাঁরা নিহত হয়েছন, তাঁদের প্রত্যেকের পরিবারকে দুই লাখ টাকা করে দেবে সরকার।

2টঙ্গীর স্টেশন রোড-কালীগঞ্জ আঞ্চলিক সড়কের রেল ক্রসিংয়ের পাশে বিসিক শিল্পনগরীর অফিসের পাশে ট্যাম্পাকো ফয়েলস লিমিটেড নামের এই কারখানা। কারখানাটিতে একধরনের রাসায়নিক ও ফয়েল পেপার তৈরি করা হতো। গতকাল শুক্রবার রাতের পালায় ৭৫ জনের মতো শ্রমিক সেখানে কাজ করছিলেন।

00কারখানার শ্রমিক ও স্থানীয় লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, আজ শনিবার ভোর ছয়টার দিকে কারখানায় বিকট শব্দে বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে। এতে কারখানায় আগুন ধরে যায় ও কারখানার পূর্ব পাশের দুইতলা অফিস ভবন ধসে পাশের একটি রাস্তার ওপর পড়ে।

ওই সময় ওই পথচারী রোজিনা আক্তার (২০) ও তাহমিনা আক্তার (১৮) এবং রিকশাচালক রাশেদ মিয়া চাপা পড়ে ঘটনাস্থলেই মারা যান। কারখানার অগ্নিকাণ্ডের সময়ে কয়েজন শ্রমিক ভবন থেকে লাফিয়ে বের হতে পারলেও বেশির ভাগ শ্রমিক আটকা পড়েন।

01স্থানীয় বাসিন্দা সেলিনা বেগম বলেন, বিস্ফোরণের পর ভবনের বিভিন্ন জিনিসপত্রের সঙ্গে মানুষের শরীরের বিভিন্ন অংশ ছিটকে তাঁদের আশপাশে পড়েছে। তিনি অন্তত ১৫ থেকে ২০ জন শ্রমিককে দেখেছেন, যাঁদের শরীরে আগুন লেগে গিয়েছিল এবং তাঁরা বাঁচার জন্য আকুতি জানাচ্ছিলেন।

কারখানার পাশেই একটি টিনশেড বাড়িতে থাকেন আফরিন আক্তার। তিনি বলেন, বিস্ফোরণের সঙ্গে সঙ্গে মাটি প্রচণ্ডভাবে কেঁপে ওঠে। আমরা সবাই মনে করেছি ভূমিকম্প হচ্ছে। নিজের ঘরের সব জিনিসপত্র রেখে বের হয়ে এসেছি।

প্রত্যক্ষদর্শী নিহত প্রকৌশলী মো. আনিসুর রহমানের স্ত্রী নিগার সুলতানা জানান, তাঁর স্বামী সাত বছর ধরে ওই কারখানায় চাকরি করছেন। আজ ভোর ছয়টার দিকে একটি বিকট শব্দ শুনতে পান। কিছুক্ষণ পরে তিনি বাসা থেকে দেখতে পান তাঁর স্বামীর কারখানা থেকে কালো ধোঁয়া বের হচ্ছে। দৌড়ে ঘটনাস্থলে গিয়ে দেখেন সেখান থেকে স্থানীয় ব্যক্তিরা তাঁর স্বামীসহ কয়েকজনের লাশ হাসপাতালের দিকে নিয়ে যাচ্ছেন।

ফায়ার সার্ভিসের পরিচালক (প্রশিক্ষণ ও পরিকল্পনা উন্নয়ন) মোশাররফ হোসেন বেলা তিনটার দিকে জানান, আগুন নেভাতে ফায়ার সার্ভিসের ২৫টি ইউনিটের ১৫০ জন কর্মী কাজ করছেন। কাউকে এখন পর্যন্ত জীবিত উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি। আগুন পুরো নিয়ন্ত্রণে এলে উদ্ধারকাজ পুরোদমে শুরু হবে। আহত ঠিক কতজন, তা এখনো জানা যায়নি বলে জানান এই কর্মকর্তা।

কারখানার মালিক সিলেট-৬ আসনের সাবেক সাংসদ সৈয়দ মো. মকবুল হোসেন বলেন, তাঁর কারখানায় সাড়ে চার শর মতো শ্রমিক রয়েছেন। গতকাল রাতের পালায় ৭৫ জনের মতো কাজ করছিলেন। আজ শনিবার কারখানা ঈদের ছুটি হওয়ার কথা ছিল। ১৯৭৭ সালে কারখানাটি প্রতিষ্ঠা করা হয়। তিনি হতাহত শ্রমিকদের ক্ষতিপূরণ দেওয়ারও আশ্বাস দেন।

জয়দেবপুর ফায়ার স্টেশনের সিনিয়র স্টেশন কর্মকর্তা মো. রফিকুজ্জামান জানান, আগুন নেভাতে গিয়ে তাঁদের কয়েকজন কর্মী আহত হয়েছেন। আশপাশের ২৫টি ইউনিট আগুন নেভাতে কাজ করেছে। রাত আটটা পর্যন্ত আগুন নিয়ন্ত্রণে আসেনি।

বিকেলে ঘটনাস্থল পরিদর্শন করতে যান স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান। তিনি বলেন, ‘গাজীপুরের টঙ্গীতে একটি কারখানায় বয়লার বিস্ফোরণের ঘটনা মোকাবিলায় প্রশাসন, নিরাপত্তা বাহিনী, ফায়ার সার্ভিস, নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরা তাৎক্ষণিক দায়িত্ব পালন করেছেন। না করলে হয়তো আগুন আরও ব্যাপক হতো। কেমিক্যালের মাধ্যমে এ আগুন ছড়িয়ে পড়ে বলে আমরা জানতে পেরেছি।পরে নৌপরিবহনমন্ত্রীও ঘটনাস্থলে যান। বলেন, ‘এ ধরনের দুর্ঘটনা দুঃখজনক। আমরা এর জন্য প্রস্তুত ছিলাম না। প্রধানমন্ত্রী ঘটনাটি পর্যবেক্ষণ করছেন।’

মেডিকেল রিপোর্টার জানান, এ দুর্ঘটনায় টঙ্গী থেকে ১৯টি লাশ ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মর্গে পাঠানো হয়েছে। এ ছাড়া আহত অবস্থায় ঢাকা মেডিকেলে আনার পর পাঁচজনকে মৃত ঘোষণা করেন চিকিৎসক।

টঙ্গী ৫০ শয্যা সরকারি হাসপাতালের আবাসিক চিকিৎসক পারভেজ হোসেন জানান, আহত ব্যক্তিদের মধ্যে টঙ্গীতে ১২ জন ভর্তি এবং অন্যদের উত্তরা আধুনিক মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ও ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে।

আগুনে নিহত যাঁরা –
গাজীপুর সিভিল সার্জন আলী হায়দার খান জানান, নিহত ব্যক্তিদের মধ্যে ঢাকার নবাবগঞ্জের গোপাল দাস (২৫), একই এলাকার কিনার শংকর সরকার (৩৫), পিরোজপুরের আল মামুন (৪০), চাঁদপুরের মতলবের নিরাপত্তাকর্মী আবদুল হান্নান (৫০), কুড়িগ্রামের ইদ্রিস আলী (৪০), ভোলার দৌলতখান এলাকার নিরাপত্তাকর্মী জাহাঙ্গীর আলম (৬৫), টাঙ্গাইলের গোপালপুর এলাকার সুভাস চন্দ্র (৩০), ময়মনসিংহের ত্রিশাল এলাকার রফিকুল ইসলাম (৪০), একই জেলার ঈশ্বরগঞ্জ এলাকার রিকশাচালক আবদুর রাশেদ (২৫), কারখানার শ্রমিক সিলেটের গোপালপুর এলাকার ওয়ালি হোসাইন (৪০), একই এলাকার মো. সোলায়মান (৩০), সাইদুর রহমান (৫১), মাইন উদ্দিন (২৯) ও এনামুল হক (৩৫), ময়মনসিংহের ত্রিশালের মো. আনিসুর রহমান (৪৫) (প্রকৌশলী), পথচারী হবিগঞ্জের রোজিনা আক্তার (২০) ও তাঁর ছোট বোন তাহমিনা আক্তার (১৮) ও শিশু মো. আশিক (১২)। এ ছাড়া ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিহত ব্যক্তিদের মধ্যে দেলোয়ার হোসেন (৩৫), ওয়াহিদুজ্জামান (৪০), আনোয়ার হোসেনের (৩৫) নাম জানা গেছে। নিহত এক নারীসহ অন্যদের নাম জানা যায়নি।

তদন্ত কমিটি গঠিত
ঘটনা তদন্তে ফায়ার সার্ভিস ও জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে পৃথক দুটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। পাঁচ সদস্যের ফায়ার সার্ভিস কমিটিকে ১০ কার্যদিবসের মধ্যে আর অপর কমিটিকে ১৫ কার্যদিবসের মধ্যে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে।

আর্থিক সহায়তার ঘোষণা
গাজীপুর জেলা প্রশাসক এস এম আলম ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে নিহত প্রত্যেকের পরিবারকে ২০ হাজার টাকা করে এবং আহত ব্যক্তিদের প্রতিজনকে ১০ হাজার টাকা করে আর্থিক সহায়তার ঘোষণা দেন। এ ছাড়া শ্রম মন্ত্রণালয় থেকে নিহত ব্যক্তিদের পরিবারকে ২ লাখ টাকা করে দেওয়ার ঘোষণা দেওয়া হয়।