ভোটের মাঠে টাকাওয়ালা মেয়র প্রার্থী
বিশেষ প্রতিবেদক: সারাদেশের ভোটের মাঠে টাকাওয়ালা মেয়র প্রার্থীরা এগিয়ে রয়েছে। এরাই নিয়ন্ত্রণ করছে ভোটের মাঠ। দেশের ২৩৫ পৌরসভা নির্বাচনে মেয়র পদে মনোনয়নপত্র জমা পড়েছে এক হাজার ২২৩টি। এদের মধ্যে অধিকাংশই টাকাওয়ালা সম্পদশালী। এ ছাড়া সাধারণ ওয়ার্ডের কাউন্সিলর পদে নয় হাজার ৭৯৮ এবং সংরক্ষিত ওয়ার্ডের কাউন্সিলর পদে দুই হাজার ৬৬৮ জন মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন। মেয়র, কাউন্সিলর ও সংরক্ষিত কাউন্সিলর_ তিন পর্যায়ে প্রায় চার হাজারের মতো পদের বিপরীতে মোট প্রার্থী হয়েছেন ১৩ হাজার ৬৮৯ জন। এসব মনোনয়নপত্র আজ ও আগামীকাল বাছাই করা হবে।
শরীয়তপুরের জাজিরা পৌরসভার মেয়র পদে সর্বোচ্চ ১১ প্রার্থী হয়েছেন। তবে বেশ কয়েকটি স্থানে মেয়র পদে দু’জন করে মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন। ইসির নিবন্ধিত ৪০টি রাজনৈতিক দলের মধ্যে অন্তত ২২টি দলের পক্ষ থেকে মেয়র পদে প্রার্থী মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে। দল থেকে প্রার্থী মনোনীত করে দেওয়া এবং স্বতন্ত্র প্রার্থী হতে এবারেই প্রথম ১০০ ভোটারের সমর্থন সূচক সই বাধ্যতামূলক করা হয়েছে।
ফলে অনেক পৌরসভাতে প্রার্থী সংখ্যা কমে গেছে বলে ইসির কর্মকর্তারা মনে করছেন। এ ছাড়াও যারা মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন তাদের বড় একটি অংশ দলের মনোনয়ন না পেয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েছেন। বড় দু’দলের পক্ষ থেকে এসব প্রার্থীর ওপর মনোনয়নপত্র প্রত্যাহারের চাপ রয়েছে। তাই শেষ পর্যন্ত মেয়র পদের প্রার্থী সংখ্যা আরও কমে যেতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
এদিকে সারাদেশের মনোনয়নপত্র সমন্বয় করতে গিয়ে ইসি কার্যালয়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। ফলে একদিন পরও প্রার্থী সংখ্যা নিয়ে বিস্তারিত তথ্য জানাতে পারেনি ইসি। গতকাল মধ্যরাতে শুধু মোট প্রার্থী সংখ্যা বের করতে সক্ষম হয়েছেন তারা। দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে অনেককে অভিযোগ নিয়েও কমিশন কার্যালয়ে এসে বিড়ম্বনায় পড়তে দেখা গেছে।
সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, কয়েকটি পৌরসভায় মনোনয়নপত্র জমা দিতে গিয়ে বাধা পাওয়ার অভিযোগ গতকালও জমা পড়েছে ইসিতে। এ ছাড়া কোনো কোনো মেয়র প্রার্থী মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার সময় দলীয় এমপিকে সঙ্গে নিয়ে শোডাউন করে আচরণবিধি লঙ্ঘন করেছেন বলে বিএনপির পক্ষ থেকে অভিযোগ করা হয়েছে। ইসি সূত্র জানিয়েছে, ফেনী জেলার তিন পৌরসভায় বেশিরভাগ পদে একক প্রার্থী হওয়ার ঘটনা খতিয়ে দেখা হচ্ছে।
মনোনয়নপত্র জমা দিতে বাধার অভিযোগ তদন্তের বিষয় কমিশনের বিবেচনায় রয়েছে। সত্যতা পেলে ওই তিন পৌরসভার তফসিল পরিবর্তন করা হতে পারে বলে কমিশন সূত্র জানিয়েছে।
বিভিন্ন স্থানে বাধার অভিযোগ সম্পর্কে জানতে চাইলে নির্বাচন কমিশনার মো. শাহনেওয়াজ বলেন, রোববার (কাল) কমিশন সভায় এসব বিষয়ে আলোচনার পর সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। তিনি বলেন, ফেনীর তিন পৌরসভার বেশিরভাগ পদে একক প্রার্থী হওয়ার বিষয়টি অস্বাভাবিক। এটি খতিয়ে দেখা হবে। তিনি আরও বলেন, অন্য কোনো পৌরসভায় মনোনয়নপত্র জমা দিতে না পারলে সংশ্লিষ্ট জেলা প্রশাসকের কাছে (আপিল কর্তৃপক্ষ) আবেদন করার সুযোগ রয়েছে।
গতকাল শুক্রবার নির্বাচন কমিশন কার্যালয়ে গিয়ে লিখিত অভিযোগ জমা দেন কুমিল্লা জেলার দাউদকান্দি পৌরসভার মেয়র পদে স্বতন্ত্র প্রার্থী হতে আগ্রহী মো. শাজাহান মিয়া ও নাজমা আক্তার। তারা রিটার্নিং কর্মকর্তা আসাদুজ্জামান ও সহকারী রিটার্নিং কর্মকর্তা ফারুক আহমেদের বিরুদ্ধে অভিযোগ করেন।
নাজমা আক্তার বলেন, বিকেল ৪টার সময় রিটার্নিং কর্মকর্তার কার্যালয়ে তালা ঝুলিয়ে দেওয়া হয়। এর আগে স্থানীয় এমপির সমর্থকরা তাদের মনোনয়নপত্র জমা দিতে বাধা দেন। ইসি সচিবালয়ের কর্মকর্তাদের মতে, মনোনয়নপত্র জমা দিতে ব্যর্থদের আদালতে যাওয়ারও সুযোগ রয়েছে। নিকট অতীতের উদাহরণ টেনে তারা বলেছেন, ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন নির্বাচনেও অনেক প্রার্থী মনোনয়নপত্র জমা দিতে ব্যর্থ হয়ে আদালতের নির্দেশে প্রার্থী হওয়ার সুযোগ লাভ করেন।
জমা হওয়া মনোনয়নপত্র আজ শনিবার ও আগামীকাল রোববার বাছাই করা হবে। ১৩ ডিসেম্বর পর্যন্ত মনোনয়নপত্র প্রত্যাহারের পর ১৪ ডিসেম্বর চূড়ান্ত প্রার্থীদের মধ্যে প্রতীক বরাদ্দ দেওয়া হবে। ২০১০ সালে ২৬৯ পৌরসভার নির্বাচনে তিনটি পদে ১৫ হাজারেরও বেশি প্রার্থী মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছিলেন। বর্তমান কমিশন ২৪ নভেম্বর ২৩৪টি পৌরসভায় তফসিল ঘোষণা করে। পর দিন রাজশাহীর নওহাটা ও গাজীপুরের শ্রীপুর পৌরসভায়ও একই তফসিলে ভোট নেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়।
এর মধ্যে আদালতের নির্দেশে বাগেরহাটের মংলা পৌরসভার নির্বাচন স্থগিত করা হয়েছে। এ ছাড়া মানিকগঞ্জের সিঙ্গাইর পৌরসভার নির্বাচনের ওপরও আদালত নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। তবে ওই পৌরসভায় ভোট বন্ধ না করে আদালতের আদেশের বিরুদ্ধে আইনি লড়াই চালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় ইসি। শেষ পর্যন্ত সিঙ্গাইর পৌরসভায় নির্বাচন হবে কি-না তা নিয়ে এখনও অনিশ্চয়তা রয়েছে।
ইসির হিসাব অনুযায়ী, ২৩৪ পৌরসভায় মোট পদ রয়েছে তিন হাজার ৯২৪টি। এর মধ্যে ২৩৪ জন মেয়র ছাড়াও ৭৩৮ জন সংরক্ষিত নারী কাউন্সিলর এবং দুই হাজার ৯৫২ জন সাধারণ কাউন্সিলর নির্বাচিত হবেন।
৩০ ডিসেম্বর এসব পদে যোগ্য প্রার্থীদের নির্বাচিত করতে ভোটাধিকার প্রয়োগের সুযোগ পাবেন ৭১ লাখ ৬২ হাজার ৩৯৬ ভোটার। এর মধ্যে ৩৫ লাখ ৮৬ হাজার ৩৫৬ পুরুষ ও ৩৫ লাখ ৭৬ হাজার ৪০ জন নারী ভোটার।
সর্বশেষ ২০১১ সালের জানুয়ারিতে চার ধাপে ২৬৯ পৌরসভায় ভোট নেওয়া হয়। এসব পৌরসভার বর্তমান জনপ্রতিনিধিদের মেয়াদ রয়েছে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত।
বিধান অনুযায়ী, মেয়াদ শেষের আগের ৯০ দিনের মধ্যে নির্বাচন করতে হবে। জানুয়ারিতে নতুন ভোটার তালিকা প্রকাশ ও ফেব্রুয়ারিতে এসএসসি পরীক্ষা বিবেচনায় রেখে ৩০ ডিসেম্বরে পৌরসভা নির্বাচনের সময়সূচি নির্ধারণ করে ইসি। বিএনপিসহ সরকারের অনেক শরিক দলের পক্ষ থেকে নির্বাচন পেছানোর দাবি উঠলেও কমিশন তাতে সায় দেয়নি।