• শুক্রবার , ২২ নভেম্বর ২০২৪

১৫ আগস্টের অজানা অধ্যায়-এক মুজিবের রক্ত থেকে লক্ষ মুজিবের জন্ম


প্রকাশিত: ১:৫১ এএম, ১৫ আগস্ট ১৪ , শুক্রবার

নিউজটি পড়া হয়েছে ৩১১ বার

 

Bangobandu-1আবুল বাশার:
১৫ আগস্ট, ১৯৭৫। সকালে আশপাশের বাসার লোকজনের হইচইয়ে সচকিত হয়ে রাস্তায় নেমে আসি। সবাই বলছে, গেট বন্ধ করো, কেউ বাইরে যেয়ো না। রেডিও চালিয়ে শোনো, বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার ঘোষণা দেওয়া হচ্ছে। এক অজানা আতঙ্ক সবার চোখেমুখে।
সেদিন সকালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যাবেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। তাঁকে সংবর্ধনা দেওয়া হবে। টিএসসিতে তিনি ভাষণ দেবেন। কিন্তু তার আগেই খুব ভোরে তাঁকে ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের নির্মমভাবে হত্যা করল বিপথগামী একদল উচ্ছৃঙ্খল সামরিক কর্মকর্তা ও সৈনিক।
এর আগের দিন সন্ধ্যায় সার্কিট হাউস রোডে মহানগর বাকশাল অফিসে সভা হয়। আমি ঢাকা জেলা কমিউনিস্ট পার্টির সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য হিসেবে নগর বাকশালের সঙ্গে যুক্ত ছিলাম। আমরা ঠিক করি, ১৫ আগস্ট সকালে আওয়ামী লীগ-ন্যাপ-সিপিবির নেতা-কর্মী-সমর্থকেরা সমবেত হয়ে টিএসসি এলাকায় যাব। মহানগরের সব ওয়ার্ড থেকে মিছিল আসবে। বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় মানুষের ঢল নামবে। হাজার হাজার মানুষের সমাগম ঘটবে। কিন্তু কেউ আর যায়নি। নির্মম হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় সবাই হতবিহ্বল হয়ে পড়ে। ঢাকার কোথাও তাৎক্ষণিক কোনো প্রতিবাদ মিছিল বের হয়নি।
রেডিওর ঘোষণা শোনার পর শুধু কিশোরগঞ্জ ও বরগুনায় বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন, কমিউনিস্ট পার্টি ও ন্যাপের নেতা-কর্মীরা প্রতিবাদ মিছিল বের করেন। কিন্তু বড় কিছু করা যায়নি।
দুপুরের আগেই এটা পরিষ্কার হয়ে গেল যে তাৎক্ষণিক প্রতিবাদ-প্রতিরোধের সুযোগ ও সম্ভাবনা ক্ষীণ। আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা চরম বিভ্রান্তিতে। দলের এক বড় অংশই ভাবল, সেনাশক্তির বিরুদ্ধে কিছু করা যাবে না। কেউ কেউ ভাবছিলেন, বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করা হলেও খন্দকার মোশতাকের নেতৃত্বে তো আওয়ামী লীগই ক্ষমতায় আছে। এ অবস্থায় সময় নিয়ে ভালোভাবে প্রস্তুত হয়ে মাঠে নামার পরিকল্পনা নেয় ছাত্র ইউনিয়ন ও ছাত্রলীগ।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ। না খুললে আন্দোলন গড়ে তোলা কঠিন। তাই অপেক্ষা। সিপিবি ও ন্যাপের নেতাদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ রেখে ও তাঁদের পরামর্শে মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম ও অন্য কয়েকজন ছাত্রনেতা প্রতিরোধ আন্দোলন গড়ে তোলার কাজ করছিলেন। তাঁরা ছাত্রলীগের নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ করে বিশ্ববিদ্যালয় খোলার পরপরই আন্দোলন শুরুর উদ্যোগ নেন।
বিশ্ববিদ্যালয় খোলে ২০ অক্টোবর। সেদিন পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ী মধুর ক্যানটিনে ছাত্র নেতা-কর্মীরা জড়ো হন। সেখান থেকে ক্যাম্পাসে মিছিল বের হয়। ২২ অক্টোবর একই কায়দায় আবার মিছিল।

babgo71ছাত্রনেতা মাহবুব জামান বিশ্ববিদ্যালয়ের কলাভবনের করিডরে ঝটিকা মিছিলে নেতৃত্ব দেন। স্লোগান ছিল ‘মুজিব হত্যার বিচার চাই’, ‘এক মুজিবের রক্ত থেকে লক্ষ মুজিব জন্ম নেবে’। ছাত্রকর্মীরা ক্লাসে ক্লাসে গিয়ে শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের প্রতিবাদ–প্রতিরোধে শামিল হওয়ার আহ্বান জানান। বিশ্ববিদ্যালয়ে সাড়া পড়ে যায়।
ছাত্র ইউনিয়ন ও ছাত্রলীগ ঠিক করেছিল, ৪ নভেম্বর মৌন মিছিল বের করবে। ৩২ নম্বরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বাসায় শোক ও শ্রদ্ধা জানাবে। ১৬ ও ১৭ অক্টোবর কারফিউর মধ্যেই জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ছাত্র ইউনিয়নের কর্মীরা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় চিকা মারেন (দেয়াললিখন)। শুরু হয়ে যায় প্রতিবাদ আন্দোলন।
৪ নভেম্বর মৌন মিছিলের জন্য ছাত্ররা একটি লিফলেট বের করেন, যার কথা শুরুতেই বলেছি—কাঁদো বাঙালি কাঁদো। লাখ খানেক লিফলেট ছাপানো ও বিভিন্ন এলাকায় বিতরণের দায়িত্ব ছিল শওকাত হোসেনের। তিনি ছিলেন ছাত্র ইউনিয়ন মহানগর কমিটির নেতা, পরে জাতীয় ছাত্রলীগ ঢাকা মহানগর কমিটির সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য। বেশ ঝুঁকি নিয়ে তিনি উর্দু রোডে পূর্ববঙ্গ প্রেসে লিফলেট ছাপানোর ব্যবস্থা করেন। ৩০ অক্টোবর লিফলেট বিলির সময় তাঁকে ও ছাত্র ইউনিয়নের নেতা কাজল ব্যানার্জিকে পুলিশ গ্রেপ্তার করে। পরদিন সেগুনবাগিচায় এজি অফিসে লিফলেট বিতরণ করতে গিয়ে গ্রেপ্তার হন ছাত্র ইউনিয়নের নেতা চামেলীবাগের আবু সিদ্দিক ও শাহ জামাল। এই চারজনের ওপর অমানুষিক নির্যাতন চালানো হয়। দুই-তিন মাস তাঁরা জেল খাটেন।বর্তমানে কাজল ব্যানার্জি

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজির অধ্যাপক, শওকাত হোসেন ব্যবস্থাপনা বিশেষজ্ঞ ও আন্তর্জাতিক ট্রেইনার, আবু সিদ্দিক ব্যবসায়ী এবং শাহ জামাল অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা। তাঁরা চারজনই সাহসিকতার প্রতীক। তাঁরা সমাজে আপন গৌরবে সুপ্রতিষ্ঠিত।

খুনি মেজর চক্রের বিরুদ্ধে ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে অসন্তোষ চলছিল। ২ নভেম্বর দিবাগত শেষ রাতে সেনা অভ্যুত্থান ঘটে। ৩ নভেম্বর অবস্থা পাল্টে যায়। ৪ নভেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলায় বিশাল সমাবেশে মুজাহিদুল ইসলাম সেলিমের বক্তৃতার পর মিছিল বের হয়। ইসমত কাদের গামা, নূহ-উল-আলম লেনিন, মাহবুব জামানসহ অনেক নেতা-কর্মী মিছিলে নেতৃত্ব দেন। আমিও সেই মিছিলে ছিলাম। জেনারেল খালেদ মোশাররফের বৃদ্ধ মা তাঁর আরেক ছেলে, আওয়ামী লীগের নেতা রাশেদ মোশাররফকে নিয়ে সেই মিছিলে যোগ দেন। খালেদ মোশাররফের মা মিছিলে যোগদান করায় মানুষের মধ্যে কিছুটা প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়।
পরের বছর ১৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর জন্মদিন উদ্যাপন উপলক্ষে ছাত্ররা আবার মাঠে নামেন। নবাবপুরে একটি প্রেসে লিফলেট ছাপানো হয়। বিভিন্ন হলে সেগুলো বিলি করার কথা। এ সময় জগন্নাথ হলের ছাত্র ইউনিয়নের নেতা মাখন বড়াল বংশালের মোড়ে লিফলেটসহ গ্রেপ্তার হন। তাঁর ওপর অকল্পনীয় অত্যাচার চালানো হয়। চার-পাঁচ মাস জেল খাটেন। বর্তমানে তিনি কুমিল্লায় একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক।
বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিবাদে গড়ে ওঠা আন্দোলনের বিভিন্ন পর্বে ছাত্রীরা গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা পালন করেন। এ জন্য সিপিবির বিশেষ উদ্যোগ ছিল। ১৯৭৬ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু হত্যার শোকাবহ দিনে ধানমন্ডির ৩২ নম্বর বাসায় শ্রদ্ধা নিবেদনের উদ্যোগ নেন ছাত্রনেতারা। সে সময় সামরিক আইনের মধ্যে কোনো মিছিলের সুযোগ ছিল না। ছাত্র ইউনিয়ন সাহস করে এগিয়ে যায়। আসলে এটি ছিল বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে ধারাবাহিক আন্দোলন বিকশিত করার আরেকটি পদক্ষেপ। প্রথমে পরীক্ষামূলকভাবে খুব সকালে ছাত্র ইউনিয়নের নেত্রী নিনু নাজমুনআরা, নাজনীন সুলতানাসহ তিনজন ফুল নিয়ে বঙ্গবন্ধুর ৩২ নম্বরের বাসার গেটে যান শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য। তাঁরা পুলিশের বাধা ডিঙিয়ে ফুল দিয়ে আসেন। এরপর অন্যরা দলে দলে গিয়ে ফুল দেন। সংগ্রাম-আন্দোলনে নতুন প্রেরণা সৃষ্টি হয়। পরে অবশ্য পুলিশের বাধায় মানুষ দূরে সরে যায়।
বঙ্গবন্ধু হত্যার পর জেলখানায় জাতীয় চার নেতা হত্যা, প্রথম সারির নেতাদের ধরে নিয়ে অমানুষিক নির্যাতন, অগণিত নেতা গ্রেপ্তার প্রভৃতি ঘটনায় আওয়ামী লীগের অন্য নেতা-কর্মীরা ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে পড়েন। অনেকে বাড়ির বাইরেও বেরোতে চান না। এ সময় সিপিবির উদ্যোগে ন্যাপ ও আওয়ামী লীগকে নিয়ে তিন দলের সমন্বিত পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়। এই উদ্যোগের মধ্যে ছিলেন সিপিবির মোহাম্মদ ফরহাদ, ন্যাপের নেতা হারুনুর রশীদ, আওয়ামী লীগের প্রবীণ নেতা জহিরুল কাইয়ুম, ময়েজউদ্দীন আহমেদ প্রমুখ। তাঁরা রাজনৈতিক দলের যৌথ উদ্যোগে ও ছাত্র ইউনিয়ন-ছাত্রলীগকে নিয়ে নানাভাবে প্রতিরোধ আন্দোলন এগিয়ে নেওয়ার পরিকল্পনা করেন।
mujib-indiraখন্দকার মোশতাক বা ওই ধরনের দক্ষিণপন্থী প্রতিক্রিয়াশীল সরকার উচ্ছেদের আহ্বান জানিয়ে ১৯৭৫ সালের ১৪ অক্টোবর সিপিবির কেন্দ্রীয় সম্পাদকমণ্ডলী রাজনৈতিক প্রস্তাব গ্রহণ করে। এই প্রস্তাব পুস্তিকা আকারে ছাপিয়ে পার্টির সদস্যদের জন্য গোপনে বিলি করা হয়। এ সময় জনমত গড়ে তোলার জন্য কমিউনিস্ট পার্টি সামরিক রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে বেশ কয়েকটি লিফলেট, বুকলেট, চার পাতার পত্রিকা প্রভৃতি ছাপিয়ে প্রচার করতে থাকে। ওগুলোর অন্যতম ছিল ‘নিরপেক্ষ সরকার এবং এবারের একুশে ফেব্রুয়ারি (২৫ ফেব্রুয়ারি ১৯৭৬, নিচে লেখা ছিল স্পষ্টভাষী)’। পরে প্রচার করা হয় ‘চক্রান্ত রুখে দাঁড়াও, খুনিদের শাস্তি দাও (১৫-৫-৭৬, নিচে লেখা ছিল দেশপ্রেমিক)’। ‘রাজবন্দীদের মুক্তি দাও—বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতির প্রতি বিশ্বের বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গের আবেদন।’ ‘ওদের ক্ষমা নেই’ নামে প্রচারিত লিফলেটে ব্যাংকক পোস্ট, দ্য ফার ইস্টার্ন ইকোনমিক রিভিউ প্রভৃতি পত্রিকায় প্রকাশিত বঙ্গবন্ধু হত্যার বিষয়ে কর্নেল ফারুকের দম্ভোক্তি উদ্ধৃত করা হয়। ‘বিদেশি সংবাদপত্র ও বেতারে বাংলাদেশ’ নামে একটি বুকলেট ছাপানো হয়। ১৯৭৬ সালের জুলাই-আগস্ট মাসে ইশ্পাত নামে চার পাতার পত্রিকার তিনটি সংখ্যা প্রকাশ করা হয়। এতে ছাত্র ইউনিয়নের নেতাদের পাশাপাশি সিপিবির কোনো কোনো নেতারও রাজনৈতিক বিশ্লেষণমূলক লেখা ছাপা হয়। ন্যাপ পকেট সাইজের একটি বুকলেট ছাপিয়ে প্রচার করে। সেটি ছিল আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন দৈনিক নিউইয়র্ক টাইমস-এ প্রকাশিত এমা রথসচাইল্ডের লেখা ‘দুর্ভিক্ষের অর্থনীতি (দুর্ভিক্ষের রাজনীতি)’ নিবন্ধের অনুবাদ।
বঙ্গবন্ধু হত্যার পর প্রায় চার দশক পার হলো। বিচার হয়েছে। মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত কয়েকজন খুনি এখনো পলাতক। তাঁদের দেশে ফিরিয়ে এনে শাস্তি কার্যকর করতে পারলে একটি অধ্যায়ের সমাপ্তি ঘটবে। দেশবাসী সেই দিনের অপেক্ষায়।