• শুক্রবার , ১৮ অক্টোবর ২০২৪

হুন্ডি বাণিজ্যে দুবাই পর্তুগাল-৯১ হাজার কোটি লেনদেন


প্রকাশিত: ৯:০৩ পিএম, ১৭ অক্টোবর ২৪ , বৃহস্পতিবার

নিউজটি পড়া হয়েছে ৫ বার

 

শফিক রহমান : দেদারছে হুন্ডি বাণিজ্য চলছে বাংলাদেশ পর্তুগাল ও দুবাইয়ে। বাংলাদেশী একটি লুটেরা সিন্ডিকেট এই হুন্ডি বাণিজ্যে নেমে ফুলে ফেঁপে উঠে বিত্ত বৈভব গড়ে তুলছে দেশে-প্রবাসে। এ চক্রে রাজনীতিক, আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর সাবেক কর্তা, আমলা ও ব্যবসায়ীরা ওৎপ্রোতভাবে জড়িত। গত বছরের শেষ দিকে অর্থ পাচারের নতুন নতুন গন্তব্য খুঁজে পায় বাংলাদেশ ব্যাংক। ইউরোপের দেশ পর্তুগালে অর্থ পাচারের ঘাঁটি গেড়েছে বাংলাদেশের আড়াই হাজার নাগরিকের একটি বিশাল চক্র।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, নিরাপদে অর্থ সরিয়ে নিতে তারা দেশটির নাগরিকত্বও নিয়েছে। এর মধ্যে তারা দেশটিতে সাড়ে ১৪ হাজার কোটি টাকা পাচার করেছে। মধ্যপ্রাচ্যের দুবাইয়ের পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ। বর্তমানে অর্থ পাচারের প্রধান রুট বা ‘সেফ হেভেন’ হিসেবে দেশটি ব্যবহৃত হচ্ছে।

দুবাই সূত্র দৈনিক সত্যকথা প্রতিদিন কে জানায়, পাচারকাজ পরিচালনার জন্য দুবাইয়ে ১৩ হাজার প্রতিষ্ঠান খুলেছেন বাংলাদেশি ব্যবসায়ীরা। সেখানে বিনিয়োগ করা হয়েছে ৬৫ হাজার কোটি টাকা। রাজনীতিবিদ ও আমলাদের অর্থ পাচারের বাহক হিসেবে কাজ করছে ব্যবসায়ী গোষ্ঠীগুলো। পতিত সরকারের প্রভাবশালীদের প্রশ্রয়ে আমদানি-রপ্তানির আড়ালে এবং হুন্ডির মাধ্যমে বিপুল অর্থ পাচার করে বিদেশে বিশাল সাম্রাজ্য গড়ে তুলেছে কয়েকটি শিল্প গ্রুপ।

অনুসন্ধানে মিলেছে, বিগত ১৫ বছরে অবৈধ হুন্ডিতে তছনছ হয়েছে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ। সূত্র বলছে, প্রবাসীদের রক্তে-ঘামে অর্জিত রেমিট্যান্স গেছে চোরাকারবারিদের পেটে।বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্য থেকে মার্কিন ডলারের বদলে পাচার হয়ে প্রতিদিন দেশে ঢুকেছে শত শত কোটি টাকার অবৈধ সোনা। এই সোনার বড় অংশ পুনরায় পাচার হয়েছে দেশের স্থল ও নৌপথে অন্য দেশে।

একইভাবে চোরাচালানের মাধ্যমে প্রতিবছর দেশে আসছে হাজার হাজার কোটি টাকার হীরা ও হীরাসদৃশ বস্তু। বাংলাদেশের এক আগাওয়াল প্রায় প্রকাশ্যে হীরা জালিয়াতি করছে। এই চক্র সোনা আর হীরার বৈধ আমদানি নামমাত্র করে চোরাচালানের মাধ্যমে বছরে ৯১ হাজার কোটি টাকা হুন্ডিতে পাচার করে দিচ্ছে বলে তথ্য দিয়েছে বাংলাদেশ জুয়েলার্স অ্যাসোসিয়েশন-বাজুস।

এ পরিস্থিতিতে অংশীজনরা বলছেন, হুন্ডিতে জড়িতদের গ্রেপ্তার ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে নতুন সরকারকে। এই লক্ষ্যে বাংলাদেশ ব্যাংক, দুর্নীতি দমন কমিশন-দুদক ও জাতীয় রাজস্ব বোর্ড-এনবিআরের অনুসন্ধান ও বিদেশে গোয়েন্দা নজরদারির তাগিদ দিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। জানা গেছে, অব্যাহত ডলার সংকটের কারণে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ।

নানা উদ্যোগ নেওয়ার পরও সংকট কাটছে না ডলার সংকট। ফলে ব্যাংকগুলো সময়মতো এলসি খুলতে পারছে না। এতে ব্যাহত হচ্ছে আমদানি-রপ্তানি কার্যক্রম। ডলার সংকটের সবচেয়ে বেশি প্রভাব পড়েছে জ্বালানি খাতে। জ্বালানির মূল্য বাড়ার কারণে সব ধরনের জিনিসপত্রের দাম অনিয়ন্ত্রিতভাবে বেড়েছে। এতে মানুষের জীবনযাত্রার ব্যয় বাড়ছে হুহু করে।

ওদিকে নানা কৌশলে হুন্ডিবাজ ব্যবসায়ী ও সংশ্লিষ্ঠ চক্র দেশের কষ্টার্জিত রেমিটেন্স আত্মসাত করে চলেছে। সাম্প্রতিক কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০২৩-২৪ অর্থবছরের জুলাইয়ে ১৯৭ কোটি ৩১ লাখ, আগস্টে ১৫৯ কোটি ৯৪ লাখ, সেপ্টেম্বরে ১৩৩ কোটি ৪৩ লাখ, অক্টোবরে ১৯৭ কোটি ১৪ লাখ, নভেম্বরে ১৯৩ কোটি, ডিসেম্বরে ১৯৯ কোটি ১২ লাখ, জানুয়ারিতে ২১১ কোটি ৩১ লাখ, ফেব্রুয়ারিতে ২১৬ কোটি ৪৫ লাখ, মার্চে ১৯৯ কোটি ৭০ লাখ, এপ্রিলে ২০৪ কোটি ৪২ লাখ, মে মাসে ২২৫ কোটি ৩৮ লাখ এবং জুন মাসে আসে ২৫৪ কোটি ১৬ লাখ মার্কিন ডলার রেমিট্যান্স।

এ প্রসঙ্গে ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন বাংলাদেশ শিল্প ও বণিক সমিতি ফেডারেশন-এফবিসিসিআইর সাবেক সভাপতি আবদুল আউয়াল মিন্টু দৈনিক সত্যকথা প্রতিদিন কে বলেন, অর্থনীতিতে হুন্ডি বড় ফ্যাক্টর। প্রবাসী আয় বা রেমিট্যান্স ব্যাংকিং চ্যানেলের চেয়েও বেশি আসে হুন্ডিতে। সরকার মুদ্রা মান ম্যানুয়ালি করায় হুন্ডিতে উৎসাহিত হন প্রবাসীরা। ফলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে রেমিট্যান্সের প্রকৃত প্রতিফলন নেই।

রিজার্ভের অর্থ হুন্ডিতে আসার ফলে সোনা চোরাচালানসহ সব ধরনের চোরাকারবারি বেড়ে যায়। এই সংকট উত্তরণে নতুন সরকারকে মুদ্রামান যথাযথ রাখার উদ্যোগ নিতে হবে। কেন ৯১ হাজার কোটি টাকার সোনা ও হীরা চোরাচালান হচ্ছে তা সংশ্লিষ্ট আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীতে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়ে খতিয়ে দেখতে হবে এবং প্রতিরোধ করতে হবে। সংশ্লিষ্টরা এ কাজে ব্যর্থতার পরিচয় দিলে অর্থনীতিতে দুর্বৃত্তায়নের পুনরাবৃত্তি হবে।

বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ- সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন বলেন, ডলারের ক্ষেত্রে ব্যাংকের চেয়ে হুন্ডিতে বাড়তি দর পাওয়ায় প্রবাসীরা উৎসাহী হন। হুন্ডির সঙ্গে আন্তর্জাতিক চক্র জড়িত। এ চক্রের সঙ্গে আছে দেশি চোরাকারবারিরা। এদের ধরতে বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটকে (বিএফআইইউ) সক্রিয় হতে হবে। দেশি চক্রকে ধরা বিএফআইইর পক্ষে কঠিন নয়। চোরাচালানে সোনা কীভাবে আসে তা খতিয়ে দেখতে হবে। সোনা চোরাচালান বন্ধে কেন উদ্যোগ নেওয়া হয়নি, সেটাও বেরিয়ে আসবে দেশি চক্রের সদস্যদের ধরতে পারলে। পাচার হওয়া সোনা কীভাবে দেশে আসছে, সেই পথ বন্ধ করতে হবে। আর্থিক খাতে শৃঙ্খলা আনতে চোরাচালান বন্ধের বিকল্প নেই।

সর্বশেষ গত ৩ জুন সোনা ও হীরা চোরাচালানে বছরে ৯১ হাজার ২৫০ কোটি টাকা পাচার হওয়ার তথ্য-উপাত্ত তুলে ধরে বাজুস বলেছে, পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের ৩০টি জেলার সীমান্ত অবস্থিত। এর মধ্যে খুলনা বিভাগের মেহেরপুর, কুষ্টিয়া, চুয়াডাঙ্গা, ঝিনাইদহ, যশোর ও সাতক্ষীরা জেলা সোনা চোরাচালানের নিরাপদ রুটে পরিণত হয়েছে। ভারতে পাচার হওয়া সোনার বড় একটি অংশ এসব জেলার সীমান্ত দিয়ে পাচার হয়ে থাকে।

বাজুসের প্রাথমিক ধারণা, প্রবাসী শ্রমিকদের রক্ত-ঘামে অর্জিত বৈদেশিক মুদ্রার অপব্যবহার করে প্রতিদিন সারা দেশের জল, স্থল ও আকাশ পথে কমপক্ষে প্রায় ২৫০ কোটি টাকার অবৈধ সোনার অলংকার, সোনার বার, ব্যবহৃত পুরনো জুয়েলারি (যা ভাঙ্গারি হিসেবে বিবেচিত হয়) ও হীরার অলংকার (ডায়মন্ড জুয়েলারি) চোরাচালানের মাধ্যমে বাংলাদেশে আসছে। যা ৩৬৫ দিন বা এক বছর শেষে দাঁড়ায় প্রায় ৯১ হাজার ২৫০ কোটি টাকা বা তার অধিক।

এর মধ্যে প্রতিদিন গড়ে ২২০ কোটি টাকার সোনা ও গয়না এবং ৩০ কোটি টাকার হীরা ও হীরার অলংকার বাংলাদেশে আসছে। সে হিসাবে ৩৬৫ দিন বা এক বছরে ৮০ হাজার ৩০০ কোটি টাকার সোনা ও ১০ হাজার ৯৫০ কোটি টাকার হীরা অবৈধভাবে বাংলাদেশে আসছে। এই পুরো টাকাটাই হুন্ডির মাধ্যমে সোনা ও হীরা চোরাকারবারিরা বিদেশে পাচার করে থাকে। যার ফলে সরকার রেমিট্যান্স হারাচ্ছে এবং সোনা ও হীরা চোরাকারবারিরা তাদের অবৈধ অর্থ বিদেশে পাচার করে যাচ্ছে। দেশে চলমান ডলার সংকটে প্রায় ৯১ হাজার ২৫০ কোটি টাকার অর্থ পাচার ও চোরাচালান বন্ধে সরকারকে উদ্যোগ নিতে হবে।

বাজুস চোরাকারবারিদের ধরতে সুপারিশে বলেছে, সোনা ও হীরা চোরাচালানে জড়িতদের ধরতে আইন-প্রয়োগকারী সংস্থার জোরালো অভিযান পরিচালনা করা প্রয়োজন। সোনা ও হীরা চোরাচালান প্রতিরোধে বাজুসকে সম্পৃক্ত করে পৃথকভাবে সরকারি মনিটরিং সেল গঠন করা জরুরি। বাজুস মনে করে, দেশে অবৈধভাবে আসা সোনা ও হীরার সিকি ভাগও আইন প্রয়োগকারী সংস্থার নজরে আসছে না। ফলে নিরাপদে দেশে আসছে চোরাচালানের বিপুল পরিমাণ সোনা ও হীরার চালান। আবার একইভাবে পাচার হচ্ছে। বাংলাদেশ সোনা চোরাচালানের বড় রুট হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে ঝিনাইদহের মহেশপুর ও চুয়াডাঙ্গার দর্শনা সীমান্ত। এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণে গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর নিয়মিত কড়া নজরদারি প্রয়োজন।

দেশে চলমান ডলার সংকট ও অর্থ পাচারের সঙ্গে সোনা চোরাচালানের সিন্ডিকেটের সুসম্পর্ক রয়েছে বলে মনে করেন অনেকে। এমন পরিস্থিতিতে সোনার বাজারের অস্থিরতার নেপথ্যে জড়িত চোরাকারবারিদের বিরুদ্ধে কাস্টমসসহ দেশের সব আইন- প্রয়োগকারী সংস্থার জোরালো অভিযান ও শাস্তি নিশ্চিত করা প্রয়োজন। সোনার বাজারে শৃঙ্খলা আনতে কঠোর অভিযানের বিকল্প নেই। বিশেষ করে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে সোনা চোরাচালানের ক্ষেত্রে আলোচিত জেলাগুলোতে চিরুনি অভিযানের দাবি করছে বাজুস।

এ প্রসঙ্গে পলিসি এক্সচেঞ্জ বাংলাদেশের (পিইবি) চেয়ারম্যান এম. মাশরুর রিয়াজ বলেন, রেমিট্যান্স বৈধ চ্যানেলে বাড়ানোর কোনো বিকল্প নেই। প্রবাসী শ্রমিকদের আয়ের বেশিরভাগ অর্থই হুন্ডিতে আসে। হুন্ডি বন্ধে ব্যাংকিং চ্যানেলে ডলারের দর বাড়াতে হবে। বৈধপথে কীভাবে প্রবাসী আয় তাদের পরিবারের দোরগোড়ায় পৌঁছে দেওয়া যায় সেই উদ্যোগ নিতে হবে। এই পদক্ষেপের ফলে মধ্যপ্রাচ্য থেকে চোরাচালানের মাধ্যমে বিপুল পরিমাণ সোনা আসে, সেটা অনেকাংশে কমবে।

বাজুসের মুখপাত্র ও কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্য আনোয়ার হোসেন বলেন, হুন্ডি বন্ধ করতে চাইলে প্রথমেই সোনা চোরাচালান বন্ধ করতে হবে। এ জন্য সোনা চোরাচালানের সঙ্গে জড়িতদের ধরতে চিরুনি অভিযান পরিচালনা করা জরুরি। এছাড়া ব্যাগেজ রুলের অপব্যবহার বন্ধ করতে হবে। দেশে বড় আকারের বিদেশি সোনা এবং হীরার অলংকার কোথা থেকে কীভাবে আসে, এই সোনার বৈধ উৎস কী, কোনো বৈধ কাগজপত্র আছে কি না তা খতিয়ে দেখতে হবে।

বৈদেশিক মুদ্রা ও চোরাচালান বিভিন্ন তথ্য-উপাত্তে দেখা যায়, হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর, শাহ্ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর ও সিলেট ওসমানী বিমানবন্দর দিয়ে প্রচুর সোনার বার, অলংকার ও হীরা খচিত অলংকার দেশে প্রবেশ করে। এক্ষেত্রে বিমানে কর্মরত কর্মীরাও সম্পৃক্ত থাকার বেশ কয়েকটি ঘটনায় প্রমাণ পাওয়া যায়। সাধারণত বিমানবন্দর দিয়ে ছাড় হওয়ার পর কর্মীরা বাস ও ট্রেনযোগে ঝিনাইদহের মহেশপুর ও চুয়াডাঙ্গার দর্শনা সীমান্ত দিয়ে ভারতে পাচার করে থাকে। সোনা চোরাকারবারিরা সিন্ডিকেটের মাধ্যমে বিদেশ থেকে সোনার বার আনছে। উদ্বেগজনক তথ্য হলো- গত কয়েক মাসে দেশের দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চলের জেলা চুয়াডাঙ্গা, ঝিনাইদহ, যশোর, মেহেরপুর, সাতক্ষীরা সীমান্তবর্তী থেকে প্রায় ২৬ কেজি চোরাচালানের সোনা জব্দ করা হয়। যার বাজারমূল্য প্রায় ২৬ কোটি টাকা।

জাতীয় রাজস্ব বোর্ড-এনবিআর ও বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ-বিজিবির তথ্যানুযায়ী ২০২৩ সালে ১০১ দশমিক ৮৯ কোটি টাকার সোনা জব্দ করা হয়েছে। এ ছাড়াও ২০১৪ সাল থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত বিজিবি সীমান্তবর্তী অঞ্চল থেকে ৯২৫ দশমিক ৯১৯ কেজি চোরাচালানের সোনা জব্দ করে। ২০২৪ সালের জানুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত বিজিবি বাংলাদেশ সীমান্তবর্তী অঞ্চল থেকে ২৭ দশমিক ৭১৩ কেজি চোরাচালানের সোনা জব্দ করা হয়। ২০১৪ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত বিজিবির হাতে গ্রেফতার আসামির সংখ্যা ২৯০ জন এবং দায়ের করা মামলার সংখ্যা ২৮৯টি। এক্ষেত্রে উল্লেখ্য থাকে যে, আসামি ও মামলার পরবর্তী কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি। গত ১০ বছরে শুল্ক গোয়েন্দা, কাস্টম হাউস, বিজিবি, পুলিশ ও এয়ারপোর্ট এপিবিএন সারা দেশে অভিযান চালিয়ে ২ হাজার ৫৮৩ কেজি সোনা জব্দ করে।

বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের তথ্য অনুযায়ী, এই সোনা যদি আনুষ্ঠানিক পথে আমদানি করা হতো তাহলে বাংলাদেশ ব্যাংকে ২২ বিলিয়ন ডলার রিজার্ভ জমা হতো, যা থেকে সরকারের রাজস্ব আহরণ হতো প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকা। এপিবিএনের সর্বশেষ তথ্যানুযায়ী, হযরত শাহ্জালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে এপিবিএন বিগত কয়েক বছরে ১৩১ দশমিক ১১০ কেজি সোনার বার, অলংকার জব্দ করেছে যার বর্তমান বাজারদর ১৩০ কোটি ৪৭ লাখ ৬৫ হাজার টাকা।

ঢাকা কাস্টমস হাউসের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, শুধু হযরত শাহ্জালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের মাধ্যমেই ২০২০ সালে ২ দশমিক ৭৭৫ টন, ২০২১ সালে ২৫ দশমিক ৬৮৯ টন, ২০২২ সালে ৩৫ দশমিক ৭৩৩ টন এবং ২০২৩ সালে ৩১ দশমিক ৪৬৮ টন সোনার বার ব্যাগেজ রুলের আওতায় আমদানি হয়েছে। কাস্টমসের তথ্যমতে, ২০২০ থেকে ২০২২ সালে শিল্পে ব্যবহারের জন্য ৪টি চালানে ২ কেজি ১৬০ গ্রাম ডায়মন্ড আমদানি করা হয়েছে। তবে ডায়মন্ডের অলংকার আমদানি হয়নি। গত ১৯ বছরে যত ডায়মন্ড আমদানি হয়েছে, তার ৮৭ শতাংশই আনা হয়েছে ভারত থেকে। ভারতের গুজরাটের সুরাটে বিশ্বের ৬৫ শতাংশের বেশি হীরা কাটিং ও পলিশিং করা হয়। খুব সহজে বহন করা যায় বলে দেশটি থেকে অবৈধভাবে হীরা আসছে বলে অনেকের ধারণা।

বিজিবি জোয়ানরা ভারত থেকে বাংলাদেশে পাচারের সময় বিগত কয়েক বছরে কয়েকটি চালান জব্দ করেছে। ২০২১ সালে সাতক্ষীরা সীমান্তে পৌনে ২ কোটি টাকার ১৪৪টি হীরার গয়না জব্দ করেছে বিজিবি। ২০১৮ সালে ৭০ লাখ টাকার হীরার গয়না জব্দ করা হয়। অবৈধ পথে হীরা আমদানির বড় কারণ শুল্ক ফাঁকি। হীরা আমদানিতে শুল্ককর অনেক বেশি। যেমন বন্ড সুবিধা ছাড়া অমসৃণ হীরা আমদানিতে কর ৮৯ শতাংশ। মসৃণ হীরা আমদানিতে কর প্রায় ১৫১ শতাংশ। এই শুল্ককর ফাঁকি দিতেই মূলত অবৈধ পথে বিপুল পরিমাণ হীরা আসছে।

গত ১৯ বছরে এই মূল্যবান রত্ন আমদানিতে সরকার মাত্র ১২ কোটি টাকার রাজস্ব পেয়েছে। ধারণা করা হচ্ছে- দেশের হীরার বাজার প্রায় ১১ হাজার কোটি টাকার। এই হীরার বাজার পুরোটাই চোরাচালান নির্ভর হয়ে আছে। সোনা চোরাচালানের খবর পাওয়া গেলেও, আমরা হীরা চোরাচালানের খবর না পাওয়া রহস্যজনক। হীরা চোরাচালানের সঙ্গে কারা জড়িত, তাও দ্রুত চিহ্নিত করতে আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোর জোরালো ভূমিকা প্রয়োজন বলে মনে করছে বাজুস।

মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইনের ২ ধারায় সোনা চোরাচালানকে মানি লন্ডারিংয়ের সম্পৃক্ত অপরাধ হিসাবে বিবেচনা করা হয়েছে। আইনে সেখানে ১২ বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড এবং ২০ লাখ টাকা জরিমানা করার বিধান রয়েছে। কিন্তু বাস্তবে দেখা যায় যে, অপরাধীর মূল হোতা আড়ালে থেকে যায় এবং ধরা পড়ে চুনোপুঁটিরা। কিন্তু সেক্ষেত্রেও আইনের বেড়াজালে জামিনে মুক্তি পেয়ে যাচ্ছে চুনোপুঁটির দল। ফলে চোরাচালান চলছেই!