‘হিরের চেয়েও দামি’ বাংলাদেশের শীর্ষ ফুটবলারদের অজানা অধ্যায়
লাবণ্য চৌধুরী: বাংলাদেশের ফুটবলাররা একসময় ছিলেন ‘হিরের চেয়েও দামি’।তখন বাংলাদেশের শীর্ষ ফুটবলাররা নিজেদের দর বাড়িয়ে নিয়েছিলেন বহু গুণ। তাছাড়া খেলোয়াড়দের ফর্মের গুনে বিপুল অঙ্কের অর্থ দিতেও কার্পণ্য ছিল না ক্লাবগুলোর। সেই সময় সবচেয়ে দামি ফুটবলার ছিলেন মোনেম মুন্না। সাব্বির, রিজভি করিম রুমি, রুম্মান বিন ওয়ালি সাব্বির, কায়সার হামিদ কিংবা ওয়াসিম ইকবালদের দরও মুন্নার প্রায় কাছাকাছিই ছিল। মোনেম মুন্নার দাম তখন উঠেছিল ৩০ লাখ টাকা।
আশরাফউদ্দিন চুন্নু ১৯৮৪ সালে দেশের ফুটবল ইতিহাসের অন্যতম সেরা খেলোয়াড় । ছিলেন ফর্মের তুঙ্গে। আবাহনীতে খেলে তিনি তখন দেশের ফুটবলের অন্যতম শীর্ষ তারকা, জাতীয় দলে খেলছেন দীর্ঘ দিন ধরে। নতুন মৌসুমের শুরুতেই চুন্নুর জন্য আসতে থাকল লোভনীয় সব প্রস্তাব। চুন্নুর মতো খেলোয়াড়ের দিকে আবাহনীর চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী মোহামেডানের নজর থাকবে, সেটাই স্বাভাবিক। একদিন সকালে তাঁর নারায়ণগঞ্জের বাসায় এসে হাজির মোহামেডানের এক শীর্ষ কর্তা। হাতে একটা ব্রিসকেস, সঙ্গে একটা গাড়ির চাবি।
১৯৮৩ মৌসুমে আবাহনীতে ২ লাখ টাকায় খেলেছিলেন চুন্নু। মোহামেডানের কর্মকর্তা প্রস্তাব এনেছিলেন ১০ লাখ টাকার। সঙ্গে একটি নতুন ঝকঝকে গাড়ি! চুন্নু বিনয়ের সঙ্গেই মোহামেডানের সেই কর্মকর্তার প্রস্তাবটি ফিরিয়ে দেন।আশি-নব্বইয়ের দশকে বাংলাদেশের ফুটবলাররা ছিলেন ‘হিরের চেয়েও দামি’। ১৯৮৩-৮৪ সালে ১০ লাখের অঙ্ক চোখ কপালে তুলে দেওয়ার মতো ছিল।
বাংলাদেশের শীর্ষ ফুটবলাররা এই পরিমাণ অর্থেই সেসময় খেলতেন আবাহনী-মোহামেডান কিংবা ব্রাদার্সের মতো ক্লাবে। দর-কষাকষি চলত, অনেকেই এক ক্লাব থেকে টাকা নিয়ে অন্য ক্লাবে নাম লেখাতেন। দলবদলের সময় খেলোয়াড়দের কর্মকর্তাদের বাড়িতে লুকিয়ে রাখার মতো বিচিত্র ঘটনাও ঘটত, বোরকা পরিয়ে স্টেডিয়াম এলাকায় নিয়ে এসে সই করানোর মতো কৌতুককর ঘটনাও বিরল ছিল না সে সময়।
সম্প্রতি শেখ জামাল ধানমন্ডি ক্লাবের ১২ ফুটবলারের অন্য ক্লাব থেকে নেওয়া টাকার চেক বাফুফেতে জমা দেওয়া নিয়ে যখন জোর আলোচনা তখন দলবদল নিয়ে বিচিত্র সব ঘটনার ঝাঁপি খুলে তো বসাই যায়…
আবাহনীর জন্যে মুন্নার ত্যাগ-
১৯৯১ সালে বাংলাদেশের ফুটবলে দলবদল অন্যরকম এক রোমাঞ্চ নিয়েই এসেছিল। সেবার বাংলাদেশের শীর্ষ ফুটবলাররা নিজেদের দর বাড়িয়ে নিয়েছিলেন বহু গুণ। বিপুল অঙ্কের অর্থ খেলোয়াড়দের দিতেও কার্পণ্য ছিল না ক্লাবগুলোর। সেই বাজারে সবচেয়ে দামি ফুটবলার ছিলেন মোনেম মুন্না। সাব্বির, রিজভি করিম রুমি, রুম্মান বিন ওয়ালি সাব্বির, কায়সার হামিদ কিংবা ওয়াসিম ইকবালদের দরও মুন্নার প্রায় কাছাকাছিই ছিল। মোনেম মুন্না ব্রাদার্সের ৩০ লাখ আর মোহামেডানের ২৫ লাখ টাকার প্রস্তাব ফিরিয়ে দিয়ে ২০ লাখে থেকে গিয়েছিলেন আবাহনীতে। কেবল আবাহনীর মোহেই বাড়তি ৫ লাখ আর ১০ লাখের হাতছানি উপেক্ষা করেছিলেন মুন্না। ১৯৯১ সালে এমন অঙ্ক আজকের বাজারে কত একবার হিসাবে করে দেখুন!
জুয়েলকে নিতে-মোহামেডান-মুক্তিযোদ্ধা সমঝোতা
১৯৯৪ সালে মুক্তিযোদ্ধায় খেলেছিলেন জুয়েল রানা। ১৯৯৫ মৌসুমের শুরুতে মুক্তিযোদ্ধার সঙ্গে কথাবার্তা এক রকম চূড়ান্তই করে ফেলেন। বেশ ভালো অঙ্কের টাকা অগ্রিম হিসাবেও নিয়ে নেন। মুক্তিযোদ্ধায় খেলবেন জেনেই জাতীয় দলের হয়ে সার্ক গোল্ডকাপ খেলতে শ্রীলঙ্কা চলে যান। প্রতিযোগিতা শেষে দেশে ফিরে এক রাতে একটা ফোন পেলেন। মোহামেডানের সে সময়কার একজন শীর্ষ কর্মকর্তার। এ কথা, সে কথার পর সেই কর্মকর্তা জুয়েলকে পর দিনই মোহামেডান ক্লাবে দেখা করতে বললেন। ব্যাপারটা বুঝে নিয়ে মুক্তিযোদ্ধার কাছ থেকে টাকা নেওয়ার প্রসঙ্গ তুললেতেই জুয়েল হতবাক। জুয়েলকে দলে নিতে ভেতরে ভেতরে মোহামেডান-মুক্তিযোদ্ধা কর্মকর্তা পর্যায়ে সমঝোতা হয়ে গেছে! মোহামেডান মুক্তিযোদ্ধাকে হুমকি দিয়েছিল, যদি জুয়েল রানাকে না ছাড়েন, তাহলে ৪-৫ জন তারকা ফুটবলারকে আমরা বিরাট অঙ্কে নিয়ে নেব। এক জুয়েল রানার জন্য এত বড় ঝুঁকি কেন নেবে মুক্তিযোদ্ধা! জুয়েলের সেই অগ্রিম অর্থও নাকি মোহামেডান মুক্তিযোদ্ধাকে বুঝিয়ে দিয়েছিল।
শীর্ষ ফুটবলারদের বাজার-দর আকাশ ছোঁয়া-
১৯৯১ সালের পরের দুই মৌসুম দেশের শীর্ষ ফুটবলারদের বাজার-দর রীতিমতো আকাশ ছুঁয়ে যায়। দেশের শীর্ষ তিন ক্লাব আবাহনী-মোহামেডান-ব্রাদার্স ১৯৯৪ সালে এক হয়ে সিদ্ধান্ত নেয় কোনোভাবেই খেলোয়াড়দের ৫ লাখ টাকার বেশি দেওয়া যাবে না। এমন একটি সিদ্ধান্ত নিয়ে তিন ক্লাব ১৪/১৫ জন খেলোয়াড়ের একটা সিন্ডিকেট তৈরি করে জানায়, এই ১৪/১৫ জন খেলোয়াড়ের দিকে তিন প্রধানের কেউই হাত বাড়াবে না। এতে করে মারাত্মক আর্থিক ক্ষতির মুখোমুখি হয় তারকারা। কিন্তু এমন সিদ্ধান্ত মানবেন কেন? অপেক্ষায় ছিলেন সুযোগের। মুক্তিযোদ্ধা ক্লাব সেবার বিরাট বাজেটের দল গড়ার সিদ্ধান্ত নিলে মহসিন, রুমি, মাসুদ রানা, আতাউর, জুয়েল রানা, সাইফুল বারী টিটো, বরুণ দেওয়ানহ অনেকেই যোগ দেন মুক্তিযোদ্ধায়। তিন প্রধান ক্লাবের সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে গিয়ে অপেক্ষাকৃত ছোট ক্লাব মুক্তিযোদ্ধায় নাম লেখান তাঁরা। এমন প্রতিবাদ নজিরবিহীন।
তারকাকে দলে ভেড়ানোর ব্যাপারে তৎপরতা-
১৯৯১ মৌসুমে তরুণ উদীয়মান তিন তারকা গোলাম গাউস, মাসুদ রানা আর মামুন জোয়ারদারকে নিয়ে তীব্র দড়ি-টানাটানি ছিল আবাহনী-মোহামেডান-ব্রাদার্স তিন প্রধানেরই। কিন্তু এই তিন তারকাকে দলে ভেড়ানোর ব্যাপারে তৎপরতা চালায় আবাহনী। চুক্তির অগ্রিম টাকা হাতে ধরিয়ে দিয়ে এই তিন খেলোয়াড়কে রীতিমতো বন্দী করে ফেলা হয় ধানমন্ডিতে আবাহনী ক্লাবের এক কর্তার বাড়িতে। সেখানে ছিল ‘বন্দী’ জীবন কাটানোর জন্য অফুরন্ত ব্যবস্থা, খাওয়া-দাওয়া, বইপত্র থেকে শুরু করে ভিসিআরে (তখন তো ভিসিআরের যুগ) হিন্দি-ইংরেজি-বাংলা ছবি দেখার ব্যবস্থা। নিজেদের দলের পক্ষে সই করিয়েই এই তিন জনকে মুক্তি দেয় আবাহনী।
মোহামেডান আবাহনীর দর-কষাকষি
১৯৮৯-৯০ মৌসুমের ঘটনা। আবাহনী তাঁর শীর্ষ এক তারকার সঙ্গে ৮ লাখ টাকার চুক্তি সেরে ফেলেছে। দিয়ে দেওয়া হয়েছে অগ্রিম টাকাও। চুক্তি চূড়ান্ত হওয়ার পর দিন সেই শীর্ষ তারকা আবাহনীর এক ক্লাব কর্তার কাছে এসে বললেন, মোহামেডান নাকি তাঁকে ৯ লাখে দলে নিতে চাচ্ছে। এ নিয়ে তিনি শুরু করলেন দর-কষাকষি। আলাপ-আলোচনা সাপেক্ষে সেই খেলোয়াড়কে আরও এক লাখ বাড়িয়ে দেওয়া হল। পরদিন সেই খেলোয়াড় আবার এসে হাজির। এবার তিনি জানাতে এসেছেন মোহামেডানের ১০ লাখ প্রস্তাবের বিষয়টি। এবারও আবাহনী তাঁর টাকা বাড়িয়ে দিল। এভাবে সেই শীর্ষ তারকা নাকি মোট তিনবার আবাহনীর কাছ থেকে টাকার অঙ্ক বাড়িয়ে নিয়েও শেষ পর্যন্ত মোহামেডানে যোগ দিয়েছিলেন। এমন ঘটনা উল্টো দিকেও ঘটেছে। মোহামেডান থেকে একইভাবে আবাহনীতে যোগ দেওয়ার ঘটনাও বিরল নয়।