শনিবার ঢাকায় দুই দেশের শীর্ষ বৈঠকে তার এই ঘোষণার পর বাংলাদেশের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানান জাপানের প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবে।দুই দিনের সফরে শনিবার দুপুরেই ঢাকায় আসেন বাংলাদেশে উন্নয়নের অন্যতম প্রধান অংশীদার জাপানের সরকার প্রধান।
বিমানবন্দরে লাল গালিচা সংবর্ধনার পর তিনি জাতীয় স্মৃতিসৌধ ও বঙ্গবন্ধু জাদুঘর ঘুরে সোনারগাঁও হোটেলে বাংলাদেশ-জাপান বিজনেস ফোরামের অনুষ্ঠানে যোগ দেন।
সেখান থেকে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে গিয়ে শীর্ষ বৈঠকে অংশ নেন আবে, যাতে বাংলাদেশের পক্ষে নেতৃত্ব দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
দুই প্রধানমন্ত্রীর বৈঠকের পর যৌথ বিবৃতিতে বলা হয়, “এশিয়া ও প্রশান্ত গ্রুপের প্রতি সংহতি ও একাত্মতা জানিয়ে বাংলাদেশ জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের অস্থায়ী সদস্য পদে নির্বাচনে ২০১৬-১৭ মেয়াদে জাপানের প্রার্থিতা সমর্থনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে।“একইসঙ্গে বাংলাদেশের বন্ধু জাপানের জন্য বাংলাদেশ তার নিজ প্রার্থিতা প্রত্যাহারের সিদ্ধান্তও গ্রহণ করেছে।”
জাতিসংঘের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ফোরাম নিরাপত্তা পরিষদে পাঁচটি দেশ স্থায়ী সদস্য, যাদের ভেটো ক্ষমতা রয়েছে। তারা হল- যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, যুক্তরাজ্য, চীন ও ফ্রান্স।
বাকি ১০টি পদে ভোটাভুটি করে সদস্য নির্বাচিত হয়, যার একটি পদে ২০১৬-১৭ মেয়াদে নির্বাচনে অংশ নেয়ার ঘোষণা কয়েক বছর আগেই দেয় বাংলাদেশ।
বাংলাদেশ ১৯৭৯-১৯৮০ এবং ১৯৯৯-২০০০ মেয়াদে নিরাপত্তা পরিষদে অস্থায়ী সদস্য ছিল।
২০১১ সালে জাপানও ২০১৬-১৭ মেয়াদে একই গ্রুপ থেকে নিরাপত্তা পরিষদের অস্থায়ী সদস্য পদে প্রার্থিতার ঘোষণা দেয়। এরপর বিষয়টি নিয়ে বিভিন্ন পর্যায়ে বাংলাদেশের সঙ্গে জাপানের আলোচনা চলে।
জাপানকে ছাড় দেয়ার বিষয়ে যৌথ সংবাদ সম্মেলনে শেখ হাসিনা বলেন, বাংলাদেশের উন্নয়ন প্রক্রিয়ায় জাপানের অব্যাহত এবং বলিষ্ঠ সমর্থনের পরিপ্রেক্ষিতে এই সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে।
শেখ হাসিনা এসময় মুক্তিযুদ্ধে জাপান সরকার এবং সে দেশের জনগণের অকুণ্ঠ সমর্থন ও সহমর্মিতার কথাও স্মরণ করেন।
জাপানের প্রধানমন্ত্রীও তার উন্নয়ন পরিকল্পনায় বাংলাদেশকে গুরুত্ব দেয়ার কথা বলেছেন। বাংলাদেশকে আগামী ৪-৫ বছরে ৬০০ কোটি ডলার সহায়তা দেয়ার ঘোষণা দেন তিনি।কক্সবাজারের মাতারবাড়ীতে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণে সহায়তা দিচ্ছে জাপান। বঙ্গোপসাগরের তীরে বিশেষ অর্থনৈতিক এলাকা (বে অফ বেঙ্গল ইন্ডাস্ট্রিয়াল গ্রোথ বেল্ট-বিগ বি) প্রতিষ্ঠাই বাংলাদেশকে সহযোগিতার অগ্রাধিকারে রাখার প্রতিশ্রুতিও দেন আবে।
শেখ হাসিনা বাংলাদেশ-জাপান দুই দশকের অর্থনৈতিক সহযোগিতার বিষয়টি তুলে ধরে বলেন, বাংলাদেশ ও জাপানের মধ্যে চমৎকার বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বিদ্যমান। সময়ের পরিক্রমায় জাপান বাংলাদেশের অন্যতম উন্নয়ন অংশীদার হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে।
স্বাধীনতার পর থেকে বাংলাদেশকে দেয়া জাপানের ১২ বিলিয়ন ডলারের অর্থ সহায়তা এবং আগামী ৪-৫ বছরে আরো ৬০০ কোটি ডলার সহায়তার প্রতিশ্রুতির কথাও উল্লেখ করেন তিনি।
গত মে মাসে জাপান সফরের কথা উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, “দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের সকল ক্ষেত্রকে সম্প্রসারণ এবং সুদৃঢ় করার লক্ষ্যে আমি এবং জাপানের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবে যৌথভাবে সমন্বিত অংশীদারিত্ব কর্মসূচির উদ্বোধন করি।”বিনিয়োগ ও অবকাঠামো উন্নয়নে বাংলাদেশকে সহায়তা দিতে জাপান কর্তৃক বিগ-বি উদ্বোধনের কথাও উল্লেখ করে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী।জাপানের নির্মাণ শিল্প এবং স্বাস্থ্য ও নার্সিং সেবায় বাংলাদেশের সহযোগিতা চেয়ে প্রস্তাবও দেয়া হয়েছে বলে জানান তিনি।
অনুষ্ঠানে শেখ হাসিনা রয়েল বেঙ্গল টাইগারের ছবির একটি অ্যালবাম শিনঝো আবেকে দেন। গত মে মাসে সফরের সময় জাপানের প্রধানমন্ত্রীকে দুটো বাঘ উপহারের প্রতিশ্রুতি দেন তিনি। আবে তার দেশে তৈরি করা বাংলাদেশি মুদ্রার কয়েকটি উপহার হিসেবে শেখ হাসিনাকে দেন।
পরমাণু জ্বালানির নিরাপদ ব্যবহার নিশ্চিত করতে এই বছরই বিশেষজ্ঞ পর্যায়ে বৈঠক করতে দুই প্রধানমন্ত্রী আগ্রহ দেখিয়েছেন।কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রে জাপানের উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহারের ওপরও জোর দেয়া হয় যৌথ বিবৃতিতে।
বিগ-বি এর আওতায় বিনিয়োগের পরিবেশ সৃষ্টি, অবকাঠামো উন্নয়ন, যোগাযোগ ব্যবস্থা নিরবচ্ছিন্ন করার ওপরও জোর দেন তারা।১০ পৃষ্ঠার যৌথ বিবৃতিতে দ্বিপক্ষীয় রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সম্পর্ক আরো দৃঢ়, নিরাপত্তার ক্ষেত্রে পারস্পরিক সহযোগিতা বৃদ্ধি, আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক বিভিন্ন ফোরামে পরস্পরের স্বার্থ অক্ষুণ্ন রাখতে সহযোগিতা সম্প্রসারণ, দুই দেশের নাগরিকদের যোগাযোগ বাড়ানোর ওপর জোর দেয়া হয়েছে।
দুই নেতার বৈঠকে ভিসা প্রক্রিয়া সহজ করা নিয়েও আলোচনা হয়। এতে বাংলাদেশি কূটনীতিকদের জাপানে ভিসা ছাড়াই যাওয়ার সুযোগ পাওয়ার ইঙ্গিত মিলেছে।
বিনিয়োগ বাড়াতে বাংলাদেশের আহ্বানের প্রতিক্রিয়ায় শিনজো আবে সেই ক্ষেত্র নির্বাচন, অবকাঠামো উন্নয়নের পরামর্শ দেন। বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ তৈরির ওপরও জোর দেন তিনি।
বাংলাদেশের জন্য দুই টাকা মূল্যমানের ৫০ কোটিটি ধাতব মুদ্রা ‘জাপান মিন্ট’ এপ্রিলের মধ্যে তৈরি করে দিতে পারায় দুই প্রধানমন্ত্রীই সন্তোষ প্রকাশ করেন।
জাপানের প্রধানমন্ত্রী বাংলাদেশে সরকার প্রধান হিসেবে শেখ হাসিনার গতিময় নেতৃত্বের প্রশংসা করেন। হাসিনা সরকারের লক্ষ্য অর্জনে জাপান পরীক্ষিত বন্ধু হিসেবে পাশে থাকবে বলে আশ্বাস দেন তিনি।