• শনিবার , ২১ ডিসেম্বর ২০২৪

হাসিনার পুরো পরিবার চোর-দুদক বিচারালয় ছিল দাস:আসিফ নজরুল


প্রকাশিত: ৬:২০ পিএম, ৯ ডিসেম্বর ২৪ , সোমবার

নিউজটি পড়া হয়েছে ১৫ বার

একটা ধার্মিক মানুষ অসৎ হয় কীভাবে, কীভাবে অন্যের হক মেরে খায়, আমানতের খেয়ানত করে, নিজের দায়িত্বে অবহেলা করে? আমরা সবাই যদি এমন করে ভাবতে শিখি, আমার মনে হয় কোনো আইন-টাইন দরকার নেই।’

 

স্টাফ রিপোর্টার : আগে আড্ডায় শুনতাম শেখ হাসিনার ক্যাশিয়ার কে, রেহানার ক্যাশিয়ার কে! ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তাঁর পুরো পরিবার ‘চোর’ ছিল বলে মন্তব্য করেছেন অন্তর্বর্তী সরকারের আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক উপদেষ্টা আসিফ নজরুল। তিনি বলেছেন, ওই ‘চোরের’ মুখের সামনে কেউ কথা বলতে পারত না। দুদক ও বিচার বিভাগ তাঁর দাসে পরিণত হয়েছিল। এখন কোনো হস্তক্ষেপ নেই।

দুদক কর্মকর্তাদের উদ্দেশে আইন উপদেষ্টা বলেন, ‘প্রমাণ করুন, আপনারা আসলেই ভালো পরিবেশ পেলে ভালো কাজ করতে পারেন।’ সোমবার সকালে রাজধানীর কাকরাইলে ইনস্টিটিউশন অব ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার্সের মুক্তিযুদ্ধ স্মৃতি মিলনায়তনে এক আলোচনা সভায় আসিফ নজরুল এসব কথা বলেন। আন্তর্জাতিক দুর্নীতিবিরোধী দিবস উপলক্ষে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) এ সভার আয়োজন করে।

উপদেষ্টা আসিফ নজরুল বলেন, ‘আমার দুঃখ লাগে, আমার সঙ্গে যাঁরা বড় হয়েছেন, ছাত্রজীবন-বিশ্ববিদ্যালয়জীবন, সাংবাদিকতাজীবন ও শিল্প-সাহিত্যের জগতে যাঁদের দেখেছি, তাঁরা যে বড়লোক হয়েছেন, সেটার কোনো কারণ ছিল না। কিন্তু তাঁদের মধ্যে কোনো অনুশোচনা, দুঃখবোধ বা লজ্জা ছিল না।…দুর্নীতি এই সমাজে “এক্সেপ্টেড নর্মে” (সাধারণ বিষয়) পরিণত হয়েছিল। কেউ প্রশ্ন করত না, এত টাকা কোত্থেকে এল? উল্টো গর্ব করত, খুশি হতো; আরে, তাঁর এত টাকা! অবৈধ বিত্ত নিয়ে অহংকার চলত। …এদের কেউ কেউ মসজিদ কমিটিগুলোতে ঢুকে পড়েছিল।’

আসিফ নজরুল বলেন, ‘আমরা বিভিন্ন জায়গায় আড্ডায় শুনতাম, শেখ হাসিনার ক্যাশিয়ার কে, রেহানার ক্যাশিয়ার কে, সালমান কার ক্যাশিয়ার, জয়ের টাকা কার মাধ্যমে যায়, পলক কার টাকা রাখে। দুদক তো ছিল, উচ্চ আদালতও ছিলেন, কোনো বিচার হয়নি। বিচার কার হতো? খালেদা জিয়ার। তিন কোটি টাকা একটা ব্যাংকে রেখেছেন, একটা টাকা সেখান থেকে কেউ আত্মসাৎ বা স্পর্শ করেনি; শুধু প্রক্রিয়াগত ভুলের জন্য তিনবারের সাবেক প্রধানমন্ত্রীকে ১০ বছরের জেল দিয়েছিল দুদক-বিচার বিভাগ মিলে।’

আসিফ নজরুল বলেন, ‘সেই “চোর” প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, যাঁর পুরো পরিবার ছিল “চোর”। তিনি সারা দেশে বলে বেড়াতেন, খালেদা জিয়া নাকি এতিমের টাকা আত্মসাৎ করেছেন! ওই “চোরের” মুখের সামনে কেউ কথা বলতে পারতেন না, দুদক ও বিচার বিভাগ তাঁর দাসে পরিণত হয়েছিল।’

আইন উপদেষ্টা আরও বলেন, ‘দুর্নীতি এক্সেপ্টেড নর্মে (সাধারণ বিষয়ে) পরিণত হওয়ার কারণ ছিল, দুর্নীতির কোনো বিচার তো হতোই না, বরং দুর্নীতি যে একটা খারাপ জিনিস, এটা ভাবার সংস্কৃতিটাই চলে গিয়েছিল। …আমরা দেখতাম, একটা বেহায়া প্রধানমন্ত্রী তাঁর পিয়ন ৪০০ কোটি টাকার মালিক হয়েছে—এটা হাসতে হাসতে জাতির সামনে বলছেন। আওয়ামী লীগের কোনো নেতার সঙ্গে দেখা হলে বলতেন, “আপা তো আসলে কিছু করতে পারেন না, ওনার ছোট বোনের জন্য।” বোনের প্রতি কী মায়া! বোন ‘চোর’ দেখে উনি কিছু করতে পারেন না!’

দুদকের কর্মকর্তাদের উদ্দেশে আসিফ নজরুল বলেন, ‘দুদকের যাঁরা কমিশনার ছিলেন, পদত্যাগ করার আগে তাঁরা গত আমলে চুরি করে হাজার হাজার কোটি টাকার মালিক হওয়া শতাধিক মন্ত্রী-ব্যবসায়ীর বিরুদ্ধে তদন্তের অনুমোদন দিয়ে গেছেন। এখন তদন্ত করুন। প্রমাণ করুন, ভালো পরিবেশ পেলে আপনারা কাজ করতে পারেন। এটাই আপনাদের প্রতি আমাদের ও সারা দেশের আকাঙ্ক্ষা।’

আইন উপদেষ্টা বলেন, ‘পৃথিবীর কোনো ধর্মই দুর্নীতি ও মানুষের হক মেরে খাওয়া অনুমোদন করে না। একটা ধার্মিক মানুষ অসৎ হয় কীভাবে, কীভাবে অন্যের হক মেরে খায়, আমানতের খেয়ানত করে, নিজের দায়িত্বে অবহেলা করে? আমরা সবাই যদি এমন করে ভাবতে শিখি, আমার মনে হয় কোনো আইন-টাইন দরকার নেই।’

ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা তুলে ধরে আসিফ নজরুল বলেন, ‘প্রায় সাত মাস আগে একটা ফ্ল্যাটের নামজারি করতে গিয়েছিলাম। আমার কাছে ১০ লাখ টাকা ঘুষ চেয়েছে।…আমার বাবার কেনা যে ফ্ল্যাটের আমরা ২০ বছর ধরে ভাড়া পাই, সেটা অন্য কারও নামে নামজারি হয়ে গিয়েছিল। এ জন্য ১০ লাখ টাকা ঘুষ চাওয়া হয়েছিল। ভূমি অফিসের লোকজনকে এই ঘুষ নেওয়ার নির্দেশ কি শেখ হাসিনা দিয়ে গিয়েছিল?

রাজনৈতিক নেতাদের আমরা অবশ্যই দোষ দেব। কিন্তু এই দোষ দিয়ে নিজের অন্যায় থেকে যেন পার পাওয়ার চেষ্টা না করি। নিজেকে জিজ্ঞেস করুন, আমরা কি সৎ আছি? …বাংলাদেশে বহু সৎ মানুষ আছেন। কিন্তু ১০০ জনের মধ্যে ২০ জন অসৎ থাকে, সেই ২০ জনের মধ্যে ১০ জন যদি ক্ষমতাবানের জায়গায় থাকে, তাহলে একটা দেশ অনাচার, দুর্নীতি ও পাপাচারে ভরে ওঠে।’

সভায় বিশেষ অতিথি টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ও দুদক সংস্কার কমিশনের প্রধান ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ‘দুদক সংস্কার কমিশনের দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে আমরা যে ধরনের তথ্য পাচ্ছি, সেটি অত্যন্ত বিব্রতকর। এত দিন যা শুনে এসেছি, তার চেয়ে হাজার গুণ বেশি। অনিয়ম, অনাচার, বৈষম্য, দুর্নীতি, লুণ্ঠনতন্ত্র…। বুকে হাত দিয়ে বলছি, আমি বিব্রত হচ্ছি। এই প্রতিষ্ঠানকে ধ্বংস করে সাঁড়াশি অভিযান চালাতে হবে। আমাদের তরুণদের স্বপ্ন বাস্তবায়ন করতে হলে এর কোনো বিকল্প নেই।’

ইফতেখারুজ্জামান আরও বলেন, ‘আদর্শ দুদক হলেও এ প্রতিষ্ঠান দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণে যথাযথ ভূমিকা পালন করতে পারবে না, যত দিন পর্যন্ত আমাদের আমলাতন্ত্র ও রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে ইতিবাচক পরিবর্তন না হবে। এখন দুদক নেই। তিনজন কমিশনার পদত্যাগ করেছেন। …দুদক এমন একটি প্রতিষ্ঠান, যেখানে কমিশনারদের ছাড়া কোনো সিদ্ধান্ত হয় না। এক মাসের বেশি হয়েছে কমিশনে কোনো সিদ্ধান্ত হয় না।’

এ সময় অতীতে কালোটাকা বৈধ করার সুযোগ দেওয়ার সমালোচনা করেন ইফতেখারুজ্জামান। অতীতে দুদকের কর্মকর্তাদের দুর্নীতির সহযোগী ভূমিকা পালনের সমালোচনা করে তিনি বলেন, এ প্রতিষ্ঠানের সংস্কার কেন হবে? দুদকের জন্য এর চেয়ে বড় অবমাননা কি আর হতে পারে? এর কারণ, একদিকে দুদক দুর্নীতির সহায়ক ভূমিকা পালন করেছে, অন্যদিকে তারা নিজেরাও দুর্নীতিতে নিমজ্জিত ছিল।দুদক সচিব খোরশেদা ইয়াসমীনের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য দেন দুদকের মহাপরিচালক (প্রতিরোধ) মো. আক্তার হোসেন।