হজ হতে হবে আল্লাহ তায়ালা ও তাঁর রাসুলের প্রেমে…
পবিত্র জিলহজ মাস একটি ফজিলতপূর্ণ মাস। এ মাসে ইসলামের পঞ্চস্তম্ভের অন্যতম স্তম্ভ হজ ও ইসলামের প্রতীক কোরবানি করা হয়। হজরত ইবরাহিম (আ.) বায়তুল্লাহ শরিফ নির্মাণের পর আল্লাহর নির্দেশে মাকামে ইবরাহিমে দাঁড়িয়ে অথবা আবু কুবায়স পাহাড়ে আরোহণ করে ঘোষণা দিয়েছিলেন- হে লোকেরা! তোমাদের পালনকর্তা নিজের ঘর নির্মাণ করেছেন এবং তোমাদের ওপর এই ঘরের হজ ফরজ করেছেন। তোমরা সবাই তোমাদের পালনকর্তার আদেশ পালন করো। দুই কানে আঙুল রেখে ডানে-বামে, পূর্ব-পশ্চিমে মুখ করে তিনি এই ঘোষণা দিয়েছিলেন। আল্লাহ তায়ালা হজরত ইবরাহিম (আ.)-এর এই আওয়াজ পৃথিবীর কোণে কোণে পৌঁছে দিয়েছিলেন। তখন থেকে কিয়ামত পর্যন্ত যত মানুষ পৃথিবীতে এসেছে এবং আসবে, তাদের সবার কানে এই আওয়াজ পৌঁছে দেওয়া হয়েছিল। যাদের ভাগ্যে আল্লাহ তায়ালা হজ লিখে দিয়েছেন, তাদের প্রত্যেকেই এই আহ্বানের জবাবে ‘লাব্বাইক আল্লাহুম্মা লাব্বাইক’ বলেছিল। হজরত ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন, হাজিগণ যে ‘লাব্বাইক’ বলেন, তা মূলত হজরত ইবরাহিম (আ.)-এর সেই ঘোষণার জবাব বা সাড়া। (কুরতুবি, মাজহারি)
হজরত ইবরাহিম (আ.)-এর ওই ঘোষণার পর থেকে যে হজ শুরু হয়েছিল, তা আজ অবধি অব্যাহত রয়েছে। সামর্থ্যবান মানুষের ওপর আল্লাহ তায়ালা জীবনে একবার হজ ফরজ করেছেন- পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘মানুষের মধ্যে যার সেখানে (কাবা শরিফে) যাওয়ার সামর্থ্য আছে, আল্লাহর উদ্দেশ্যে বাইতুল্লাহর হজ করা তার জন্য অবশ্য কর্তব্য এবং কেউ প্রত্যাখ্যান করলে সে জেনে রাখুক, নিশ্চয়ই আল্লাহ বিশ্বজগতের প্রতি মুখাপেক্ষী নন। (আলে ইমরান : ৯৭)
হজ হতে হবে একমাত্র মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে। লোক দেখানোর জন্য মোটেই নয়। পবিত্র কোরআনের পূর্বোক্ত আয়াতে সেদিকে ইঙ্গিত করা হয়েছে। অন্য আয়াতে ইরশাদ হয়েছে, ‘আর তোমরা আল্লাহর উদ্দেশ্যে হজ ও উমরা পরিপূর্ণভাবে পালন করো।’ (বাকারা : ১৯৬) বুখারি শরিফে বর্ণিত হয়েছে, হজরত মুহাম্মদ (সা.) ইরশাদ করেন, যে আল্লাহর উদ্দেশ্যে হজ করল এবং অশ্লীল কাজ ও সীমা লঙ্ঘন করল না, সে তার মা তাকে যেদিন জন্ম দিয়েছিল সেদিনের মতোই নিষ্পাপ হয়ে বাড়ি ফিরে এলো। (বুখারি : ১/২০৬) এক হাদিসে বর্ণিত হয়েছে, হজরত মুহাম্মদ (সা.) ইরশাদ করেন, এমন সময় আসবে, যখন কিছু লোক হজে যাবে ভিক্ষা করার জন্য, কিছু লোক যাবে ব্যবসার জন্য, আর কিছু লোক যাবে লোক-দেখানোর জন্য। হজের মাধ্যমে একজন হাজির জীবনে যে আমূল পরিবর্তন ঘটে যাওয়ার কথা, আজ কি তা মোটেও হচ্ছে? প্রতি বছরই হজে যান এমন অনেকেই আছেন যারা হালাল-হারামের কোনো বাছ-বিচারই করেন না। হজের আগে যেমন হারাম ও অবৈধ উপার্জনে লিপ্ত ছিলেন, হজের পরও সেই সুদ, ঘুষ, দুর্নীতি, ভেজাল, প্রতারণা, অন্যকে ঠকানোসহ হারাম উপার্জন ঠিকই বহাল থাকে। তাহলে এই হজের সার্থকতা কোথায়? রাসুল (সা.) ইরশাদ করেন, যখন কেউ হারাম মাল নিয়ে হজে রওয়ানা হয়, যানবাহনে সওয়ার হয়ে ‘লাব্বায়েক’ বলে, তখন আকাশ থেকে একজন ফেরেশতা ঘোষণা করেন, ‘তোমার লাব্বায়েক কবুল নয়। কারণ, তোমার পাথেয় হারাম। তোমার সওয়ারি হারাম। তোমার হজ কবুল নয়। বরং তোমার এই হজ গোনাহের কারণ।’ হজ হতে হবে আল্লাহ তায়ালা ও তাঁর রাসুলের প্রেমে, মক্কা মদিনার প্রেমে, বাইতুল্লাহ ও রওজায়ে আতহারের নিখাদ প্রেমে পাগলপারা হয়ে। কিন্তু বর্তমানে কি সেই প্রেমময় হজ লক্ষ করা যায়? হয়তো খুবই স্বল্পসংখ্যক হাজির ক্ষেত্রেই সেটা হয়।
হজের মতোই কোরবানিও একটি অনেক বড় ইবাদত। মুসলিম উম্মাহর অন্যতম ধর্মীয় বিধান। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে- ‘এবং উটকে করেছি আল্লাহর নিদর্শনগুলোর অন্যতম। তাতে তোমাদের জন্য রয়েছে মঙ্গল’ (হজ : ৩৬)। অন্য আয়াতে ইরশাদ হয়েছে, ‘এটিই আল্লাহর বিধান। কেউ আল্লাহর নিদর্শনাবলিকে সম্মান করলে তা তো তার হৃদয়ের তাকওয়াসঞ্জাত’ (হজ : ৩২)।
হজরত আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত, হজরত রাসুল (সা.) ইরশাদ করেন, ‘কোরবানির দিন আল্লাহর কাছে রক্ত প্রবাহিত করা থেকে অধিক প্রিয় মানুষের কোনো আমলই নেই। কিয়ামত দিবসে কোরবানিকৃত পশুর শিং, লোম ও পায়ের খুর, সব কিছু নিয়েই আল্লাহর দরবারে হাজির হবে। কোরবানিকৃত জন্তুর রক্ত মাটিতে গড়িয়ে পড়ার আগেই মহান আল্লাহর কাছে তা বিশেষ মর্যাদায় পৌঁছে যায়। সুতরাং তোমরা স্বাচ্ছন্দ্যে কোরবানি করবে।’ (তিরমিজি : ১/২৭৫) হজরত জায়েদ ইবনে আরকাম থেকে বর্ণিত, সাহাবায়ে কেরাম জিজ্ঞেস করলেন, এই পশু জবাই, এই কোরবানিগুলো কী? নবী করিম (সা.) উত্তর দিলেন, তোমাদের পিতা হজরত ইবরাহিম (আ.)-এর সুন্নাত। সাহাবায়ে কেরাম আরজ করলেন, এতে আমাদের কী লাভ? হজরত নবী করিম (সা.) উত্তর দিলেন, প্রতিটি পশমের বিনিময়ে একটি করে নেকি। (মিশকাত : ১/১২৯) কোরবানি এতই গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত যে পবিত্র কোরআনে নবী করিম (সা.)-কে নামাজের সঙ্গে কোরবানির নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। ইরশাদ হয়েছে- ‘সুতরাং আপনি আপনার প্রতিপালকের উদ্দেশে নামাজ আদায় করুন এবং কোরবানি করুন।’ (কাওছার : ২)
পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে- ‘আল্লাহ তো কেবল মুত্তাকিদের কোরবানিই কবুল করেন।’ (মায়েদা : ২৭) অন্য আয়াতে ইরশাদ হয়েছে- ‘কোরবানিকৃত জন্তুর গোশত ও রক্ত কিছুই আল্লাহর কাছে পৌঁছায় না। বরং পৌঁছায় কেবল তোমাদের তাকওয়া।’ (হজ : ৩৭) তাকওয়া, খোদাভীতি, আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের নিয়তে যখন কোরবানি করা হয়, তখনই কোরবানিকৃত জন্তুর রক্ত মাটিতে গড়িয়ে পড়ার আগেই তা আল্লাহর দরবারে বিশেষ মর্যাদায় পৌঁছে যায়। হাদিসে সেটাই বলা হয়েছে। কাজেই লোকলজ্জায় নিজে কোরবানি না করলে সন্তানরা গোশত খাবে কোত্থেকে, এমন মানসিকতায় যদি কেউ কোরবানি করেন- এমন কোরবানি সাওয়াব নয়, গোনাহের কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
কিছু বিত্তবান ব্যক্তিকে দেখা যায় যে কোরবানির সময় এলে কে কত দামি গরু কোরবানি করবেন, সে প্রতিযোগিতায় অবতীর্ণ হন। কিন্তু তারা কি কখনো একটুও ভেবে দেখেন যে হজরত ইবরাহিম (আ.)-এর অনুসরণে আমরা আজ কোরবানি করছি, তিনি তো নিজের প্রাণাধিক প্রিয় পুত্র হজরত ইসমাঈল (আ.)-কেই কোরবানি করতে গিয়েছিলেন। সুতরাং কোরবানির মর্মকথাই হচ্ছে- ‘আল্লাহর নির্দেশ পালনার্থে ইসলামের জন্য সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকার করা। আমাদের তো পশু কোরবানি করেই শেষ। প্রকৃত আত্মত্যাগের কোনো প্রমাণ রাখতে পারছি না আমরা। বিষয়টি নিয়ে আমাদের ভাবতে হবে। প্রতি বছর পশু কোরবানির মাধ্যমে প্রকৃত ত্যাগের মহিমায় উজ্জ্বল হয়ে উঠতে হবে আমাদের। অন্যথায় প্রচলিত প্রথাগত কোরবানি কোনো সার্থকতা বয়ে আনবে না আমাদের জীবনে।
লেখক : প্রধান মুফতি ও সিনিয়র মুহাদ্দিস, চৌধুরীপাড়া মাদরাসা, ঢাকা