‘সৌদি বিনিয়োগে নবধারা সূচিত হবে’
বিশেষ প্রতিনিধি : প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাঁর সাম্প্রতিক সৌদি আরব সফরকে অত্যন্ত সফল আখ্যায়িত করে বলেছেন, এই সফরের মধ্যদিয়ে বাংলাদেশে সৌদি বিনিয়োগের নবধারা সূচিত হবে।প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমার এ সফর দু’দেশের সম্পর্ক বৃদ্ধি বিশেষতঃ বাংলাদেশের স্বার্থ রক্ষায় সুদূরপ্রসারী ভূমিকা রাখবে বলে আমার দৃঢ় বিশ্বাস।প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আজ বিকেলে গণভবনে তাঁর সাম্প্রতিক সৌদি আরব সফর নিয়ে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে একথা বলেন।
প্রধানমন্ত্রী সৌদি বাদশাহ এবং সৌদি আরবে অবস্থিত দুই পবিত্র মসজিদের জিম্মাদার সালমান বিন আব্দুল আজিজ আল-সৌদ-এর আমন্ত্রণে ১৬ থেকে ১৯ অক্টোবর সৌদি আরবে ৪ দিনের সরকারি সফর করেন।সফরে সৌদি বাদশাহ এবং ক্রাউন প্রিন্সের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক বৈঠকসহ প্রধানমন্ত্রী মদীনা শরীফে রাসুলুল্লাহ (সাঃ) এর পবিত্র রওজা মোবারক জিয়ারাত করেন এবং সফরসঙ্গীগণ মক্কা শরীফে পবিত্র ওমরাহ পালন করেন। সফরকালে বিনিয়োগ সংক্রান্ত দুই দেশের মধ্যে ৫টি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়।
সমঝোতা স্মারকগুলোর মধ্যে রয়েছে- বাংলাদেশে সৌদি বিনিয়োগে সিমেন্ট কারখানা, ডাই-অ্যামোনিয়াম ফসফেট করখানা, সৌদি-বাংলাদেশ বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল’ প্রতিষ্ঠা, সৌরবিদ্যুৎ ও বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম উৎপাদন কারখানা স্থাপন।প্রধানমন্ত্রী বলেন, সৌদি আরবে ইতোপূর্বে উচ্চপর্যায়ের সফরগুলোতে সেদেশের শ্রমবাজারে বাংলাদেশীদের নিয়োগ সংক্রান্ত বিষয়টি প্রাধান্য পেত। কিন্তু, এবারের সফরে গতানুগতিক ধারার বাইরে অভিন্ন অর্থনৈতিক স্বার্থরক্ষায় কার্যকর অংশিদারিত্ব প্রতিষ্ঠা, মুসলিম বিশ্বে স্থিতিশীলতা ও শান্তি প্রতিষ্ঠায় সহযোগিতামূলক তৎপরতা বৃদ্ধি, প্রতিরক্ষা ও নিরাপত্তা খাতে দ্বিপাক্ষিক সহযোগিতা ইত্যাদি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে গঠনমূলক আলোচনা হয়।
এ সফরকালে সৌদি আরবের বাদশাহ তাঁর সকল সফরসঙ্গীদের রাজকীয় আতিথেয়তা প্রদান করেন বলেও প্রধানমন্ত্রী উল্লেখ করেন।সফরের অনুপুঙ্খ বর্ণনা দিয়ে তিনি বলেন, ১৬ অক্টোবর সন্ধ্যায় রিয়াদে পৌঁছলে রিয়াদের ভাইস গভর্নর এবং সৌদি আরবের তথ্যমন্ত্রী কিং খালিদ আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের রয়াল টার্মিনালে তাঁকে স্বাগত জানান। এরপর দু’দেশের জাতীয় পতাকা শোভিত মোটর শোভাযাত্রা সহযোগে অতিথিদের কিং সৌদ গেস্ট প্যালেসে নিয়ে যাওয়া হয়।
১৭ অক্টোরব দুপুরে তিনি বাদশাহ সালমান বিন আব্দুল আজিজের সঙ্গে রিয়াদের আরগায় রাজপ্রাসাদে ঘণ্টাব্যাপী দ্বিপাক্ষিক বৈঠক করেন। প্রধানমন্ত্রী বলেন, অত্যন্ত উষ্ণ ও হৃদ্যতাপূর্ণ পরিবেশে এ বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়।তিনি রাজপ্রাসাদে পৌঁছলে সৌদি বাদশাহ তাঁকে স্বাগত জানিয়ে বৈঠকের জন্য নির্ধারিত কক্ষে নিয়ে যান। সেখানে তাঁরা একান্তে মত বিনিময় করেন। এরপর তাঁর সম্মানে আয়োজিত রাজকীয় মধ্যাহ্নভোজে অংশ নেন তিনি।
শেখ হাসিনা বলেন, মধ্যাহ্নভোজের পর আনুষ্ঠানিক দ্বিপাক্ষিক বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠকে সৌদি আরবের পক্ষে অন্যান্যের মধ্যে রিয়াদের গভর্নর, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, বাদশাহ’র পরামর্শক সভার প্রতিমন্ত্রী, রয়াল কোর্টের উপদেষ্টা, পররাষ্ট্রমন্ত্রী, অর্থমন্ত্রী, তথ্যমন্ত্রীসহ ঊর্ধ্বতন সামরিক ও বেসামরিক কর্মকর্তাবৃন্দ উপস্থিত ছিলেন।
তিনি বলেন, দ্বিপাক্ষিক বৈঠকের শুরুতেই বাদশাহ আমাকে স্বাগত জানান। তিনি সৌদি আরবকে আমার দ্বিতীয় বাড়ি হিসেবে উল্লেখ করে বলেন এখানে আপনি সব সময়ের জন্য স্বাগত।‘বাংলাদেশ ও সৌদি আরবের সম্পর্কের ক্ষেত্রে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে অভূতপূর্ব গতি সঞ্চারিত হওয়ায় বাদশাহ সন্তোষ প্রকাশ করেন,’ বলেন তিনি।প্রধানমন্ত্রী বলেন, সৌদি বাদশাহ আগামী দিনগুলোতে এ সম্পর্ক আরও সম্প্রসারণে দ্বিপাক্ষিক যোগাযোগ ও সহযোগিতার ধারা অব্যাহত রাখা প্রয়োজন বলে উল্লেখ করেন। বিশেষতঃ বাণিজ্য, বিনিয়োগ, সংস্কৃতি, প্রতিরক্ষা ও নিরাপত্তাখাতে দু’দেশের সহযোগিতার সুযোগগুলো আরও কাজে লাগানোর উপর তিনি গুরুত্ব আরোপ করেন।
সরকার প্রধান বলেন, বাদশাহ বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের ভূয়সী প্রশংসা করেন। এক পর্যায়ে তিনি বাংলাদেশের উন্নয়নের অগ্রযাত্রা ও দীর্ঘমেয়াদী স্থিতিশীলতা রক্ষায় আগামীতে আমাদের সরকারের ধারাবাহিকতার প্রয়োজনীয়তার কথা উল্লেখ করেন।’শেখ হাসিনা বলেন, তিনি এ সময় সৌদি আরবের বাদশাহকে বাংলাদেশ সফরের আমন্ত্রণ জানালে তিনি তা সাদরে গ্রহণ করেন এবং নিকট ভবিষ্যতে বাংলাদেশ সফরের আগ্রহ ব্যক্ত করেন।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ঐদিন সন্ধ্যায় তিনি সৌদি আরবের উপ-প্রধানমন্ত্রী ও প্রতিরক্ষামন্ত্রী যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান বিন আব্দুল আজিজের সঙ্গে বৈঠক করেন। অত্যন্ত সৌহার্দ্যপূর্ণ পরিবেশে সেই বৈঠকটি অনুষ্ঠিত হয়।তিনি বলেন, এই বৈঠকে সৌদি আরবের পক্ষে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, বাদশার পরামর্শক সভার প্রতিমন্ত্রী, পররাষ্ট্রমন্ত্রী, তথ্য মন্ত্রী, রয়াল কোর্টের প্রতিরক্ষা সংক্রান্ত উপদেষ্টাসহ ঊর্ধ্বতন সামরিক ও বেসামরিক কর্মকর্তাবৃন্দ উপস্থিত ছিলেন।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমি বাংলাদেশের উন্নয়নে বিশেষতঃ খাদ্য নিরাপত্তা, আবাসন, শিক্ষা, দারিদ্র্য দূরীকরণের ক্ষেত্রে আমার সরকারের গৃহীত বিভিন্ন উদ্যোগের বিষয় তুলে ধরি। যুবরাজ বাংলাদেশের উন্নয়নের অংশীদার হওয়ার ইচ্ছা ব্যক্ত করেন।শেখ হাসিনা বলেন, আমি বাংলাদেশে আরও অধিক পরিমাণে সৌদি বিনিয়োগের আহ্বান জানাই। এ পর্যায়ে সৌদি যুবরাজ বাংলাদেশে বিনিয়োগের বিষয়ে গভীর আগ্রহ প্রকাশ করেন এবং এ লক্ষ্যে তিনি আগামী দু’মাসের মধ্যে একটি উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন ব্যবসায়ী ও বিশেষজ্ঞ প্রতিনিধি দল বাংলাদেশে পাঠাবেন বলে জানান।
‘আঞ্চলিক ও আর্ন্তজাতিক বিভিন্ন ইস্যু বিশেষতঃ ইসলামী বিশ্বে শান্তি প্রতিষ্ঠা ও উন্নয়নের বিষয়ে বাংলাদেশ ও সৌদি আরব একযোগে কাজ করবে বলে আমরা প্রত্যয় ব্যক্ত করি। প্রতিরক্ষা খাতকে আমরা আগামী দিনে দু’দেশের সহযোগিতার একটি সম্ভাবনাময় ক্ষেত্র হিসেবে চিহ্নিত করি,’ যোগ করেন প্রধানমন্ত্রী।
তিনি বলেন, সৌদি আরবের সীমান্ত এলাকায় মাইন-অপসারণ, প্রশিক্ষণ ও সামরিক এলাকায় নির্মাণ কাজে সহযোগিতার জন্য বাংলাদেশের আগ্রহের কথা তাঁকে অবহিত করলে তিনি এ প্রস্তাবকে স্বাগত জানান। সৌদি যুবরাজকে প্রধানমন্ত্রী এসময় বাংলাদেশ সফরের আমন্ত্রণ জানালে তিনি তা গ্রহণ করেন এবং দু’দেশের সুবিধাজনক সময়ে বাংলাদেশ সফরের ইচ্ছা প্রকাশ করেন।
তিনি বলেন, এরআগে সকালে তিনি রিয়াদে ব্যবসায়ীদের এক সভায় অংশগ্রহণ করেন। কাউন্সিল অব সৌদি চেম্বারস এই আলোচনা সভার আয়োজন করে। সভায় সৌদি আরব এবং বাংলাদেশের বিশিষ্ট ব্যবসায়ী নেতৃবৃন্দ অংশগ্রহণ করেন। সভায় দু’দেশের মধ্যে বাণিজ্য ও বিনিয়োগ বৃদ্ধির উপায় ও কৌশল নিয়ে মত বিনিময় হয়।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, সৌদি ব্যবসায়ী নেতৃবৃন্দ বাংলাদেশে অধিক হারে বিনিয়োগে গভীর আগ্রহ প্রকাশ করেন। এ সভা শেষে বাংলাদেশে সৌদি বিনিয়োগে সিমেন্ট কারখানা, ডাই-অ্যামোনিয়াম ফসফেট করখানা, ‘সৌদি-বাংলাদেশ বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল’ প্রতিষ্ঠা, সৌর বিদ্যুৎ ও বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম উৎপাদন কারখানা স্থাপন ইত্যাদি বিষয়ে মোট ৫টি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়।তিনি বলেন, একইদিন বিকেলে তিনি রিয়াদে বাংলাদেশ দূতাবাসের জন্য নবনির্মিত চ্যান্সারি কমপ্লেক্স উদ্বোধন করেন এবং সুধী সমাবেশে বক্তব্য রাখেন।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ১৭ তারিখ রাতে তিনি এবং তাঁর সফরসঙ্গীগণ একটি বিশেষ বিমানে মদীনায় গিয়ে মদীনা শরীফে রাসুলুল্লাহ (সাঃ) এর পবিত্র রওজা মোবারক জিয়ারাত করেন।এ সময় তিনি দেশ ও জাতির কল্যাণ ও অগ্রগতি কামনা করে বিশেষ মোনাজাত করেন।তিনি বলেন, ১৮ অক্টোবর সকালে মদীনা হতে বিশেষ বিমানে জেদ্দায় যাই। দুপুরে জেদ্দাস্থ কনস্যুলেট জেনারেল-এর জন্য সম্প্রতি ক্রয়কৃত জমিতে কনস্যুলেট ভবনের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করি। এ সময় আমি প্রবাসী বাংলাদেশীদের সঙ্গে মতবিনিময় করি। ওইদিন এশার নামাজের পর প্রধানমন্ত্রী এবং তাঁর সফরসঙ্গীগণ মক্কা শরীফে পবিত্র ওমরাহ পালন করেন।