সৌদি ডলারে বিক্রি নেইমাররা
স্পোর্টস রিপোর্টার : সৌদি ডলারে বিক্রি হয়ে যাচ্ছে রোনালদো নেইমারদের মত বিশ্বের সব দামি খেলোয়াড়রা। বিশ্বের দামি খেলোয়াড়রা নিজের ও পরিবারের ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করেই লাইন ধরে যোগ দিচ্ছে সৌদি ক্লাবে। সৌদি ডলারের কাছে হার মানছে ইউরোপের সব দামি ক্লাব। সৌদি প্রো লিগের ক্লাবে বিশ্বের সব দামি খেলোয়াড়রা লাইন ধরেছেন।
সৌদি যাত্রা ঠেকাতে হিমশিম খাচ্ছে ইউরোপের বড় বড় ক্লাবগুলো। ইউর্গেন ক্লপ, পেপ গার্দিওলার মত কোচদের মুখেও শোনা গিয়েছে শঙ্কার বাণী। সৌদি ক্লাবগুলোকে রুখতে ফিফার হস্তক্ষেপও চেয়েছেন অনেকেই।
কিন্তু ঠিক কী কারণে ফুটবলারদের এমন সৌদিমুখী চিন্তাভাবনা? এমন প্রশ্নের উত্তরে ফুটবলারদের মুখে অবশ্য বিভিন্ন কথাই শোনা যায়। ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদো জানিয়েছিলেন, তিনি চ্যালেঞ্জ নিতে চান। নেইমারের ভাষ্য, তিনি চেয়েছেন ফুটবল বিপ্লবের অংশ হতে। কিন্তু সবকিছুর মূলে যে সৌদি অর্থই বড় ভূমিকা রাখছে, সেটা কিন্তু কারোরই অজানা নয়। লোভটা হচ্ছে কোটি কোটি সৌদি ডলার।
মাত্র এক মৌসুম আগেই ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের মত ক্লাবের রাডারে ছিলেন নাইজেরীয় তারকা ওডিয়ন ইঘালো। এরপরেই যেন হারিয়ে গেলেন ইউরোপিয়ান ফুটবল থেকে। একবছর পর জানা গেল সৌদি লিগে পা রেখেছেন ইঘালো। সম্ভবত ইউরোপ থেকে তারকা ভেড়ানোর সৌদি পরিকল্পনার প্রথম ফলাফল ছিলেন এই ফরোয়ার্ড।
এরপরেই এলো বিশ্বকাপ। মাঠের খেলার বাইরে শিরোনাম হলেন ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদো। সাংবাদিক পিয়ার্স মরগ্যানের সঙ্গে সাক্ষাৎকারে একের পর এক বোমা ফাটিয়েছেন। ম্যান ইউনাইটেড কোচ এরিক টেন হাগের সঙ্গে ঝামেলার কথাও প্রকাশ্যে এলো সেবারেই। এরপরেই ইউরোপ ছেড়েছেন রোনালদো। বড় অঙ্কের বিনিময়ে গিয়েছেন সৌদি ক্লাব আল-নাসরে।
এতটুকু পর্যন্ত ঠিকই ছিল সব। এরপরের মৌসুমেই দেখা গেল ফুটবল বিশ্বের অন্যরকম এক বিপ্লব। করিম বেঞ্জেমা, সাদিও মানে, এনগোলো কান্তে, ইয়াসিন বোনোর মত প্রতিষ্ঠিত তারকারাও যোগ দিয়েছেন সৌদি আরবের লিগে। আছেন নেইমারের মত ফর্মের তুঙ্গে থাকা খেলোয়াড়রাও।
নতুন ক্লাবে যোগ দিয়ে প্রায় সকলেই যেন মুখস্থ বুলি আওড়েছেন। সৌদি আরবে ফুটবলের বিপ্লব ঘটাতে চান, জানিয়েছেন ফুটবলে নতুন চ্যালেঞ্জ নিতে চান। তবে সবকিছুর মূলে যে সৌদি অর্থ, সে কথাও প্রকাশ করেছেন অনেকেই। সবার আগে বোমা ফাটিয়েছেন একেবারের শুরুতে সৌদিতে যাওয়া ইঘালো। নাইজেরিয়ান এই ফুটবলারের দাবি, টাকার জন্যই সৌদিতে গিয়েছেন রোনালদো।
ওমা স্পোর্টস টিভিকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে ইঘালো বলেন, ‘তরুণ বয়সে অবশ্যই আপনার আবেগ থাকবে। ওই সময় আপনি টাকার বিষয়টি আমলেই নেবেন না। কিন্তু যখন আমার মতো বয়স হবে, ক্যারিয়ারের শেষ প্রান্তে এসে আমি জানি না ক্যারিয়ার এক বছর থাকবে, নাকি দুই বছর। কখন সৃস্টিকর্তা সেটি বন্ধ করতে বলবেন।’
একইসুরে কথা বলেছেন পর্তুগালের তারকা রুবেন নেভেস। ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগে ওলভারহ্যাম্পটনের সঙ্গে ভালোই ছিলেন তিনি। তবে, সেখান থেকে ক্যারিয়ারের সেরা সময়েই চলে গেলেন সৌদি আরবে। কেন গিয়েছেন, সেটার জবাবও দিয়েছেন অকপটে,
‘নিজের পরিবারের জন্য যে জীবনের স্বপ্ন আমি দেখেছি, তা উপহার দিতে। আমার জন্য, এটাই ছিল মূল কারণ। এজন্যই আমার এই প্রস্তাব নিতে কোনপ্রকার সংশয় ছিল না।
তবে এরপরের কথাতেই যেন সব বাস্তবতাকে তুলে ধরলেন ওলভসের সাবেক অধিনায়ক, ‘আমার স্ত্রী আর তিন সন্তান আছে। তাদের যত্ন নেয়াটাই আমার সবচেয়ে বড় ট্রফি।’ আল হিলালে যোগদান তার আর পরিবারের জন্য সবচেয়ে ভাল সিদ্ধান্ত বলেও জানিয়েছিলেন তিনি।
প্রায় একইরকম অবস্থান থেকেই সৌদি আরবের ক্লাবে ছুটেছেন কালিদু কৌলিবালি, এনগোলো কান্তে, ম্যাথিয়াস পেরেইরাদের মত খেলোয়াড়রা।
এবার দেখা যাক রুবেন নেভেসের অবস্থানের দিকে। ওলভস ইংলিশ লিগের মাঝারি পর্যায়ের ক্লাব। প্রিমিয়ার লিগের বিগ সিক্সের বাইরে যে ক্লাবের সম্ভাবনা জোরালো থাকে, তাদেরই একটি এই ক্লাব। রুবেন নেভেসের বর্তমান বয়স ২৬। মার্কেট ভ্যালুতে দাম ৪১ মিলিয়ন।
এমন একজন খেলোয়াড়কে সহসাই ১৬ মিলিয়ন বেতন আর ৫০ মিলিয়ন ট্রান্সফার ফিতে কিনে নেবে এমন ক্লাব খুব একটা নেই। কিন্তু সেই প্রস্তাবই দিয়েছে সৌদি ক্লাব আল-হিলাল। নেভেসের সেই প্রস্তাব ফিরিয়ে দেওয়ার সামর্থ্য ছিল না।
শুধু রুবেন নেভেসই না। প্রাপ্য এবং যোগ্যতার চেয়েও অস্বাভাবিক পরিমাণে বেতন দেওয়া হচ্ছে আরও অনেককেই। এনগোলো কান্তের কথাই ধরা যাক। চোটজর্জর মৌসুম শেষ করে চেলসিতে ফিরে এসেছিলেন। তবে ফর্ম বিবেচনায় ইউরোপের বড় কোন ক্লাবে যাওয়া হতো না বিশ্বকাপজয়ী তারকার। সেই সময়েই আল-ইত্তিফাক তাকে দলে টেনেছে ৮৬ মিলিয়ন ইউরোর অবিশ্বাস্য এক অফারে।
প্রাপ্যের চেয়ে ৬ থেকে ৭ গুণ বেশি দামে দল পাচ্ছেন তারকারা
ক্রোয়েশিয়ার ৩০ বছর বয়সী মধ্যমাঠের খেলোয়াড় মার্সেলো ব্রোজোভিক ইন্টার মিলানের হয়ে চ্যাম্পিয়নস লিগের ফাইনালে খেলেছেন। এরপর নতুন চ্যালেঞ্জ খুঁজতে শুরু করেন তিনি। বার্সেলোনা তাঁকে নিতে চেয়েছিল, কিন্তু সৌদি আরবের আল নাসর তাঁকে অনেক বেশি অর্থের প্রস্তাব দেয়। সেই প্রস্তাব ফেরানো প্রায় অসম্ভব ছিল ক্রোয়েট তারকার জন্য।
একইরকম প্রস্তাবে সৌদি প্রো লিগে নাম লিখিয়েছেন জর্ডান হেন্ডারসন, এভার বানেগা, ম্যাথিউস পেরেইরা কিংবা অ্যান্ডারসন তালিসকার মত খেলোয়াড়রা। এদের অনেকেই গিয়েছেন ইউরোপে ব্যর্থ হয়ে। আবার অনেকেই সম্ভাবনাকে দিয়েছেন বিসর্জন।
সৌদি আরবের এমন ট্রান্সফারের ক্ষেত্রে বড় ভূমিকা রেখেছে বয়স। ৩২ বছর বা তার বেশী বয়সের খেলোয়াড়দের দিকে আলাদা মনোযোগ দিয়েছে ক্লাবগুলো। এসব খেলোয়াড়দের গতি আর শারীরিক সক্ষমতার জন্য খুব একটা মূল্যায়ন করতে নারাজ ইউরোপের শীর্ষ লিগের ক্লাবগুলো।
একারণেই বড় অর্থের লোভ দেখিয়ে টেনে নেওয়া হচ্ছে সৌদি প্রো লিগে। ৩৫ বছরের করিম বেনজেমা, ৩৩ বছরের ইয়াসিন বোনো, ৩১ বছরের ফিরমিনো কিংবা ৩২ বছরের রিয়াদ মাহরেজদের দেওয়া হয়েছে অবিশ্বাস্য সব প্রস্তাব।
এদের অনেকেই ইউরোপে নিজেদের ক্যারিয়ারে পূর্ণতা দিয়েছে। আগামী দুই তিন বছরের মধ্যেই বুটজোড়া তুলে রাখার পরিকল্পনাও আছে কারো কারো। শেষ সময়ে এসে বড় অঙ্কের বেতন নিতে তাই দুবার ভাবতে হয়নি তাদের।
তবে এতকিছুর মাঝেও কয়েকজন খেলোয়াড় নিতান্ত নিরূপায় হয়েই নাম লিখিয়েছেন সৌদি ক্লাবে। যাদের মাঝে আছেন স্বয়ং রোনালদোও। পিয়ার্স মরগ্যানের সঙ্গে দেয়া সাক্ষাৎকারের পর তার ওপর আগ্রহ হারায় ম্যান ইউনাইটেড। চেলসি-বায়ার্নসহ আরও কিছু ক্লাবে গুঞ্জন উঠলেও ব্র্যান্ড ভ্যালু আর ইমেজের কথা ভেবেই সিআরসেভেনকে দলে নেয়নি কেউই।
সাদিও মানের অবস্থা আরও করুণ। লিভারপুল ছেলে জার্মান ক্লাব বায়ার্নে গিয়েছিলেন নতুন চ্যালেঞ্জ নিতে। সেখানে নিজের ফর্ম হারিয়েছেন, ইনজুরির কারণে ছিলেন হাসপাতালে। ফিরে এসে দলীয় কোন্দলের কারণে সতীর্থ লেরয় সানের সঙ্গে মারামারিও করেছেন। সৌদি ক্লাব আল-নাসরের প্রস্তাবেও তাই হ্যাঁ বলতে বাধ্যই ছিলেন তিনি।
আর সবশেষ নেইমারের অবস্থান তো সকলেরই জানা। পিএসজি ছেড়ে দিতে চেয়েছে, ইনজুরিপ্রবণ এবং পার্টিপ্রেমী নেইমারকে দলে চাননি বার্সা কোচ জাভি। আল-হিলাল ছাড়া তাই আর উপায়ও ছিল না এই ব্রাজিলিয়ান তারকার।
সবমিলিয়ে সৌদি আরবের টাকার অঙ্কটা ঠিক কত বড় তা পরিষ্কার হয়েছিলো লিওনেল মেসির কথায়। নিজের সৌদি যাত্রা নিয়ে বলেছিলেন, টাকার জন্য হলে আমি সৌদি আরবেই খেলতে পারতাম। মেসি ইন্টার মায়ামিতে খোদ অ্যাপলের আয়ের অংশই পেয়ে যাচ্ছেন। তবে সৌদি ক্লাবের প্রস্তাব ছিল আরও বড়।
ক্যারিয়ারের শেষে বাড়তি আয়ের উৎস ফুটবলারদের জন্য কিছুটা সীমিত বলা চলে। খুব নামী না হলে ব্র্যান্ড ভ্যালুও ক্ষয়ে আসে দিনে দিনে। জীবনের সেই দিনগুলোতেও ফুটবলারদেরও প্রয়োজন হয় অর্থের। ফুটবলাররাও যে রক্তে মাংসেরই গড়া মানুষ। মোটা অঙ্কের অমন প্রস্তাবনা ফেরানোর সাধ্য কজন মানুষের হয়!