• সোমবার , ২৫ নভেম্বর ২০২৪

সোনার হরিণের খোঁজে আন্তঃদেশীয় পাচারচক্রে বাংলাদেশের মানুষ


প্রকাশিত: ২:২০ পিএম, ২৩ মে ১৫ , শনিবার

নিউজটি পড়া হয়েছে ২১৩ বার

men trafiking-www.jatirkhantha.com.bdটিপু রহমান. দক্ষিণ থাইল্যান্ড: বেকারত্ব অভাবের তাড়না সংসারে অস্বচ্ছলতায় বাংলাদেশের বিপুল সংখ্যক জনগোষ্ঠী বিদেশে পাচার হয়ে যাচ্ছে।পাচারচক্রে জড়িত রয়েছে আন্তঃদেশীয় একটি প্রভাবশালী চক্র।এদের যোগসাজশে বাংলাদেশের ১৬ জেলার মানুষ সোনার হরিণের খোঁজে পাচার হয়ে যাচ্ছে বিদেশে।সরেজমিনে খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে এসব তথ্য।

জাতিসংঘের হিসাব অনুযায়ী, শুধু চলতি বছরের প্রথম তিন মাসেই মিয়ানমার ও বাংলাদেশের ২৫ হাজার মানুষ সাগরপথে দেশ ছেড়েছেন। এদের অন্তত ৩০০ জন মারা গেছে। সরেজমিনে দক্ষিণ থাইmen trafiking-2www.jatirkhantha.com.bdল্যান্ডের পাঁচটি বন্দিশালা ঘুরে সমুদ্রপথে এসে আটক হওয়া বাংলাদেশের ১৫ জেলার মানুষের হদিস মিলেছে । জেলাগুলো হলো কক্সবাজার, চট্টগ্রাম, সিরাজগঞ্জ, বগুড়া, সুনামগঞ্জ, নরসিংদী, নারায়ণগঞ্জ, কিশোরগঞ্জ, যশোর, খুলনা, সাতক্ষীরা, চুয়াডাঙ্গা, ঝিনাইদহ, মাগুরা ও কুষ্টিয়া।

নিজ দেশে নিপীড়নের শিকার হয়ে দেশান্তরি হচ্ছে মিয়ানমারের রহিঙ্গারা। তবে বাংলাদেশিরা কেন দেশান্তরি হচ্ছেন তা এক প্রশ্নই থেকে যায়। মূলত, অভাব ও বেকারত্ব বাংলার মানুষকে দেশান্তরি করতে বাধ্য করছে। দু’বেলা ভাত জোটেনা এমন মানুষের সংখ্যা দেশে কম নেই। তাই সকলে অবৈধ পথে পাড়ি জমাতে চায় ইন্দোনেশিয়া , মালয়েশিয়া ও থাইল্যান্ডে।

‘অভাব, কাজ নাই, সংসার চলে না’ বলছিলেন চুয়াডাঙ্গার সেলিম উদ্দিন। একই গ্রামের রফিকসহ তিনি ভাগ্য বদলের জন্য মালয়েশিয়ায় যেতে দালালদের হাত ধরে ঘর ছাড়েন। এখন ঠাঁই হয়েছে সংখলা প্রদেশের রাত্তফোম জেলার বন্দিশালায়। ৯ মে থাইল্যান্ডের জঙ্গল থেকে আরও অনেকের সঙ্গে তাদের উদ্ধার করে সেখানকার পুলিশ।

গত সপ্তাহে দক্ষিণ থাইল্যান্ডের বিভিন্ন বন্দিশালায় থাকা অন্তত ৫০ জন বাংলাদেশির সঙ্গে কথা হয়েছে। ফোনে কথা হয়েছে থাই জঙ্গল থেকে মুক্তিপণ দিয়ে দেশে ফেরা কয়েকজনের সঙ্গেও। বেশির ভাগ মানুষেরই দাবি, তাঁরা ঘর ছেড়েছেন অভাব আর বেকারত্ব ঘোচাতে। কেউ কেউ ভালো উপার্জনের প্রলোভনে পড়ে বা প্রতারণার শিকার হয়েও পাচারকারীদের খপ্পরে পড়েছেন।

আর এর সুযোগ নিয়েছে মানব পাচারকারীরা। বাংলাদেশ, মিয়ানমার, থাইল্যান্ড ও মালয়েশিয়া এই চার দেশের চক্র মিলে গড়ে উঠেছে মুক্তিপণ-বাণিজ্য।তবে সবার সমুদ্রযাত্রার কাহিনী এক নয়। তিন ধরনের ঘটনা শোনা গেছে থাই বন্দিশালায় আটক ভুক্তভোগীদের মুখে।

মুক্তিপণ দিয়ে সম্প্রতি দেশে ফেরা নূর নবী জানালেন, তাঁকে জোর করে তুলে নিয়েছে দালালেরা। সেটা কীভাবে সম্ভব? নুর নবী বলেন, তাঁরা তিন বন্ধু কক্সবাজার সমুদ্রসৈকতে পর্যটকদের ছবি তুলে জীবিকা নির্বাহ করেন। অপর দুজন হলেন ফেনীর রফিক ও চট্টগ্রামের মিঠু।

২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের আগে টানা হরতাল-অবরোধের কারণে কক্সবাজার ছিল পর্যটকশূন্য। আয়-রোজগার ছিল না। তখন ডিসেম্বর মাস। টেকনাফের এক দালাল প্রস্তাব দেয়, মালয়েশিয়ায় অনেক কাজের সুযোগ আছে। কোনো টাকা লাগবে না। মালয়েশিয়া গিয়ে মাসে মাসে বেতন পেয়ে কিস্তিতে টাকা শোধ করলে চলবে। কিস্তির টাকা দিয়েও বাড়িতে ৫-১০ হাজার টাকা করে পাঠানো যাবে।

নূর নবীর দাবি, এতে তিনি রাজি হননি। রফিক ও মিঠু রাজি হন। দুই বন্ধুকে বিদায় জানাতে তিনি টেকনাফ পর্যন্ত যান। তখন তাঁকেও জোর করে নিয়ে যায়। তিনি বলেন, ‘এত চিৎকার করলাম, কেউ এগিয়ে এল না। বড় ট্রলারে তুলে আমাদের আটকে রাখে। সেখানে আরও অনেক রোহিঙ্গা ও বাংলাদেশি ছিল। তিন দিন পর ট্রলার ছাড়ে। আট দিন, আট রাত পর ট্রলারটি থাইল্যান্ডে পৌঁছায়। এরপর পায়ে হেঁটে ও গাড়িতে তাঁদের নেওয়া হয় মালয়েশিয়ার সীমানায় বাদাম বেসার জঙ্গলে।

নূর নবী জানান, তত দিনে ক্ষুধা, পিপাসায় তাঁরা সবাই ক্লান্ত, তার ওপর মারধর।এরপর দালালেরা থাই ফোন দিয়ে দেশে ভাইয়ের সঙ্গে কথা বলিয়ে দেয় নূর নবীকে। মুক্তিপণ চায় ২ লাখ ৪০ হাজার টাকা। ভাই গ্রামে জমি বেচে দালালদের টাকা পাঠান। এরপর নির্যাতন থামলেও মুক্তি মেলেনি। একদিন পুলিশ এসে ক্যাম্প থেকে ধরে নিয়ে যায়। তারপর জেল খেটে দেশে ফেরা।

গত এক বছরের অভিজ্ঞতা থেকে তিনি বলেন, ‘এখন যাঁরা আইস্যে না, এঁরার ৭০ ভাগই বাংলাদেশের বাচ্চা ছেলে।’ তিনি বলেন, রোহিঙ্গাদের কিছু নেই। টাকা দিতে পারে না। মাসকে মাস জঙ্গলে আটকা থাকতে হয়। কিন্তু বাংলাদেশিদের কাছ থেকে দ্রুত মুক্তিপণ পাওয়া যায়। এ কারণে বাংলাদেশিদের প্রতি পাচারকারী চক্রের আগ্রহ বেশি।

২০০৯ সাল থেকে সাগরপথে মানব পাচার নিয়ে অনুসন্ধানী প্রতিবেদন করে আসছেন ফুকেটের সাংবাদিক চুটিমা সিদাসাথিয়ান। তাঁর অনুমান, থাই উপকূল দিয়ে গত এক বছরে যত মানুষ পাচারের শিকার হয়েছে, তাদের অর্ধেক বাংলাদেশি। সম্প্রতি যারা এ দেশে আটক বা উদ্ধার হয়েছে, তাদের অর্ধেকের বেশি বাংলাদেশি।

গত ২০ দিনে থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়ায় উদ্ধার হওয়া ব্যক্তিদের পরিসংখ্যানও চুটিমার আন্দাজকে সমর্থন করে।

ব্রিটিশ সাময়িকী দ্য ইকোনমিস্ট-এর এক প্রতিবেদনে দাবি করা হয়েছে, আন্দামান সাগরে আটকে পড়া অবৈধ অভিবাসীদের অর্ধেকই বাংলাদেশি। তারা অর্থনৈতিক কারণেই দেশান্তরি হয়েছে।

এ বিষয়ে গত বৃহস্পতিবার কথা হয় কেরাম এশিয়ার আঞ্চলিক সমন্বয়ক হারুণ অর রশিদের সঙ্গে। অভিবাসী শ্রমিকদের অধিকার নিয়ে মালয়েশিয়ায় কাজ করেন তিনি। অভিবাসী-সংক্রান্ত জাতিসংঘের এক সভায় যোগ দিতে এখন তিনি থাইল্যান্ডে। তাঁর দাবি, মালয়েশিয়ার এমন কোনো কর্নার পাবেন না, যেখানে সাগরপথে আসা বাংলাদেশি নেই।

হারুণ অর রশিদ বলেন, মুক্তিপণ দিয়ে যেসব বাংলাদেশি মালয়েশিয়া পৌঁছাতে সক্ষম হন, পুলিশের হাতে ধরা পড়ে তাঁদের একটা অংশের ঠাঁই হয় এ দেশের কারাগারে, অন্যদের বেশির ভাগেরই কর্মস্থল হয় রাবার বাগান বা পাম অয়েল প্ল্যান্টেশনে। কেউ কেউ রেস্তোরাঁয় বা কারখানায় কাজ পান। কিন্তু সারাক্ষণ থাকেন পুলিশ-আতঙ্কে। কঠোর পরিশ্রম করেও কম বেতন পান।

অনেক দিন ধরে দেশে এমন ধারণা প্রচলিত আছে যে বাংলাদেশি নামে যারা সাগরপথে যাচ্ছে, তাদের বড় অংশ এ দেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর।

এ প্রতিবেদক দক্ষিণ থাইল্যান্ডের পাঁচটি বন্দিশালা ঘুরে সমুদ্রপথে এসে আটক হওয়া বাংলাদেশের ১৫ জেলার মানুষের হদিস পেয়েছেন। জেলাগুলো হলো কক্সবাজার, চট্টগ্রাম, সিরাজগঞ্জ, বগুড়া, সুনামগঞ্জ, নরসিংদী, নারায়ণগঞ্জ, কিশোরগঞ্জ, যশোর, খুলনা, সাতক্ষীরা, চুয়াডাঙ্গা, ঝিনাইদহ, মাগুরা ও কুষ্টিয়া।

এখন প্রশ্ন উঠেছে, বাংলাদেশে তো মিয়ানমারের মতো জাতিগত সহিংসতা নেই। সামরিক সরকারও নেই। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গত মঙ্গলবার কমনওয়েলথভুক্ত ৩৭ সাংসদের একটি প্রতিনিধিদলকে বলেছেন, বাংলাদেশের গণতন্ত্র এখন শক্ত ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়ে আছে।

বিবিএসের সাময়িক প্রাক্কলন অনুযায়ী, মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) বাড়ছে। গত অর্থবছরের প্রবৃদ্ধির হার ছিল ৬ দশমিক শূন্য ৬ শতাংশ। চলতি অর্থবছরে তা হবে ৬ দশমিক ৫১ শতাংশ। তার পরও বাংলাদেশিরা কেন রোহিঙ্গাদের কাতারে শামিল হচ্ছেন?

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ইমতিয়াজ আহমদ বলেন, রোহিঙ্গাদের পাচার হওয়া এবং বাংলাদেশিদের পাচার হওয়ার মধ্যে মৌলিক পার্থক্য আছে। রোহিঙ্গারা কোনো দেশের নাগরিক না। তারা চরম কোণঠাসা হয়ে আছে।

কিন্তু বাংলাদেশের সরকার প্রায়ই বলে, দেশে উন্নয়নের জোয়ার বইছে। শিগগিরই মধ্যম আয়ের দেশ হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু সে দেশের নাগরিকেরা এভাবে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে যাচ্ছে, তা ওই দাবির সঙ্গে সাংঘর্ষিক। অধ্যাপক ইমতিয়াজ মনে করেন, সমুদ্রপথে মানব পাচারের ঘটনায় বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি খারাপ হতে বাধ্য।