সিঙ্গাপুর থেকে না ফেরার দেশে বিএনপি নেতা হান্নান
বিশেষ প্রতিনিধি : বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ও সাবেক মন্ত্রী আ স ম হান্নান শাহ সিঙ্গাপুরের একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা গেছেন।বিগত জরুরি অবস্থার সময়ে পাশে থাকায় সাবেক সেনা কর্মকর্তা হান্নান শাহ ছিলেন বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার আস্থাভাজনদের একজন।বিএনপি চেয়ারপারসনের প্রেস উইংয়ের সদস্য শায়রুল কবির খান জানান, সিঙ্গাপুরের র্যাফেলস হার্ট সেন্টারে চিকিৎসাধীন ছিলেন হান্নান শাহ। মঙ্গলবার ভোরে সেখানেই তার মৃত্যু হয়। তার বয়স হয়েছিল ৭৪ বছর।
শায়রুল কবির বলেন, স্যারের ছোট ছেলে শাহ রিয়াজুল হান্নান টেলিফোনে কাঁদতে কাঁদতে আমাদের খবরটা দেন।বিএনপি নেতারা জানান, গত ৬ সেপ্টেম্বর মহাখালী ডিওএইচএস এর বাসা থেকে আদালতে হাজিরা দিতে বের হওয়ার সময় হান্নান শাহ হৃদরোগে আক্রান্ত হলে তাকে ঢাকার সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে (সিএমএইচ) ভর্তি করা হয়।
পরে চিকিৎসকদের পরামর্শে ১১ সেপ্টেম্বর এয়ার অ্যাম্বুলেন্সে করে তাকে সিঙ্গাপুরে নেওয়া হয়। সেখানে তার হৃদযন্ত্রে অস্ত্রোপচার (এনজিওপ্লাস্টি) করা হয়েছিল।বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সাবেক কর্মকর্তা হান্নান শাহ ব্রিগেডিয়ার জেনারেল হিসেবে অবসরে যাওয়ার পর বিএনপিতে সক্রিয় হন। ১৯৯১ সালে খালেদা জিয়ার মন্ত্রিসভার সদস্য ছিলেন তিনি।
হান্নান শাহের মৃত্যুতে পৃথক বার্তায় শোক প্রকাশ করে তার আত্মার মাগফেরাত কামনা করেছেন বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া ও মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। তারা শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতিও সমবেদনা জানিয়েছেন।স্ত্রী নাহিদ হান্নান, মেয়ে শারমিন হান্নান সুমি এবং দুই ছেলে শাহ রেজাউল হান্নান ও শাহ রিয়াজুল হান্নানকে রেখে গেছেন হান্নান শাহ।
বড় ছেলে রেজাউল জানান, সিঙ্গাপুরের আনুষ্ঠানিকতা শেষ করে বুধবার সন্ধ্যায় তার বাবার মরদেহ ঢাকায় নিয়ে আসা হবে। বৃহস্পতিবার সকাল ১০টায় মহাখালী ডিওএইচএস মসজিদে, সাড়ে ১১টায় সংসদ ভবনের দক্ষিণ প্লাজায় এবং জোহরের পর নয়া পল্টনে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে তার জানাজা হবে।
ওই দিন হান্নান শাহের মরদেহ সিএমএইচের হিমঘরে রেখে শুক্রবার সকালে সড়ক পথে গাজীপুরে নিয়ে যাওয়া হবে। সকাল ৯টায় জয়দেবপুর রাজবাড়ী মাঠে, সাড়ে ১০টায় কাপাসিয়া পাইলট উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে এবং জুমার পর প্রয়াতের নিজ গ্রাম চালা বাজার উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে জানাজা শেষে বাবার করবের পাশেই তাকে দাফন করা হবে।
হান্নান শাহের মৃত্যুর খবর পেয়ে সকালে মহাখালী ডিওএইচএসে তার বাসায় যান বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল। তিনি তার বড় ছেলে শাহ রেজাউল হান্নানসহ পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে কথা বলেন এবং তাদের সমবেদনা জানান।
১৯৪১ সালের ১১ অক্টোবর গাজীপুরের কাপাশিয়ার ঘাগটিয়া গ্রামে জন্ম নেন হান্নান শাহ। তার বাবা ফকির আবদুল মান্নান ১৯৬৫ থেকে ১৯৬৮ সাল পর্যন্ত পাকিস্তান সরকারের মন্ত্রী ছিলেন। হান্নানের ছোট ভাই শাহ আবু নাঈম মোমিনুর রহমান ছিলেন সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের বিচারপতি।
বিএনপি নেতাদের তথ্য অনুযায়ী, ১৯৬২ সালে পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে কমিশন পাওয়া হান্নান শাহ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময়ে অন্য বাঙালি সেনা কর্মকর্তাদের সঙ্গে পাকিস্তানের কারাগারে বন্দি ছিলেন। ১৯৭৩ সালের সেপ্টেম্বরে দেশে ফিরে তিনি বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে যোগ দেন।
১৯৮১ সালের ৩০ মে চট্টগ্রাম সার্কিট হাউজে একদল সেনা সদস্যের হাতে প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান নিহত হওয়ার পর উত্তপ্ত পরিস্থিতির মধ্যে রাঙ্গুনিয়া থেকে তার মরদেহ ঢাকায় নিয়ে আসেন তখনকার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আসম হান্নান শাহ।
এইচ এম এরশাদ সরকারের সময় তিনি সেনাবাহিনী থেকে অবসরে যান।অবসরের পর এরশাদের সময়ে বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশনের (বিএডিসি) চেয়ারম্যানের দায়িত্বও পেয়েছিলেন হান্নান শাহ। ১৯৮৩ সালে ওই পদ ছেড়ে তিনি আনুষ্ঠানিকভাবে বিএনপিতে যোগ দেন।
শুরুতে মহানগর বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক, ১৯৮৬ থেকে ১৯৯৩ সাল পর্যন্ত দলের সাংগঠনিক সম্পাদক (ঢাকা বিভাগ) ও ১৯৯৩ থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার উপদেষ্টা কাউন্সিলের সদস্য হিসেবে তিনি দায়িত্ব পালন করেন।হান্নান শাহ ১৯৯১ সালের নির্বাচনে গাজীপুর-৪ আসন (কাপাসিয়া) থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হলে তাকে পাট ও বস্ত্র মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দেন তখনকার প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া। ২০০১ সালের নির্বাচনে জিতে বিএনপি আবারও ক্ষমতায় গেলেও সেবার হেরে যান হান্নান।
২০০৭ সালের শুরুতে সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর দুই বছরের জরুরি অবস্থার মধ্যে খালেদা জিয়া যখন কারাগারে, সে সময় বিএনপিকে সংগঠিত রাখতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন হান্নান শাহ। দলের সংস্কারপন্থি অংশের বিরুদ্ধে সে সময় গণমাধ্যমেও সোচ্চার ছিলেন তিনি।
এরপর ২০০৯ সালে বিএনপির পঞ্চম জাতীয় কাউন্সিলে দলের সবোর্চ্চ ফোরাম জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য করা হয় হান্নান শাহকে, এ বছর অনুষ্ঠিত ষষ্ঠ কাউন্সিলেও তা বহাল থাকে।নব্বইয়ের স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের সময় কয়েকবার কারাগারে যেতে হয়েছিল আসম হান্নান শাহকে। বর্তমান সরকারের সময়েও তাকে কারাগারে যেতে হয়েছে, নাশকতাসহ বিভিন্ন অভিযোগে ৩০টির বেশি মামলা হয়েছে তার বিরুদ্ধে।