অঞ্জন সরকার : ভোর পাঁচটা। হাল্কা কুয়াশায় মুখ ঢেকে আছে জঙ্গলটা। দু’একটা শুকনো পাতা নেমে আসছে গাছের গা বেয়ে। তাদের মাটিতে মেশার নিঃশব্দ শব্দটাও অনুভব করতে পারছি। একটা নরম কমলা-হলুদ আলো ছড়িয়ে যাচ্ছে চারপাশে। আমি বসে আছি যে গাছটার গায়ে হেলান দিয়ে, তাকে ঘিরে থাকা ঘন সবুজ…একেবারে নিঃস্তব্ধ। গত রাতে জঙ্গলের বুকে জমে থাকা কান্নারা ফোঁটা ফোঁটা জল হয়ে ঝরছে নিডল পাইনের পাতা বেয়ে, আমার চুলের ভিতর দিয়ে বুকের মাঝে সেঁধিয়ে যাচ্ছে। একটা হিমালয়ান ঈগল সাদায়-বাদামিতে মেশা পালকে গা ঢেকে বাতাসে ভর করে ভেসে এল…বসল ঠিক আমার সামনে একটা বড় পাইনের ডালে। ঘাড় বেঁকিয়ে দেখল ওর ডানার দিকে, দিনের প্রথম আলো সরে যাচ্ছিল সেখান থেকে। তারপর ঠোঁটটাকে উঁচু করে তুলল রাত্রির রঙের পরশ বুকে করে রাখা আকাশের দিকে, যেন ঠোঁট ছোঁয়াল সেখানে। মরমে ভেঙে যেতে থাকল আকাশ। আমার ক্যামেরায় বন্দি হল সেই ভালবাসাবাসি। কিন্তু ওই নিস্তব্ধতার মাঝে শাটারের সামান্য ধাতব শব্দ কানে তুলে নিল ঈগলটা। এক নিমেষে ডানা মেলল সে … একটা তীক্ষ্ণ শীৎকার ছড়িয়ে যেতে থাকল জঙ্গল জুড়ে। শব্দের বৃত্তটা বড় হতে থাকল…আমি দু’চোখ মেলে ঈগলটার হারিয়ে যাওয়া দেখতে থাকলাম। সকাল হচ্ছিল কিতামের জঙ্গলে।কাল এসেছি কিতামে। দক্ষিণ সিকিমে। দার্জিলিং মেলে এনজেপি। সেখান থেকে শিলিগুড়ি তেনজিং নোরগে বাসস্ট্যান্ডের উল্টো দিকে এসএনটি বাসস্ট্যান্ডের সামনে জোরথাং-এর শেয়ার জিপে সওয়ারি হয়ে জোরথাঙের আগেই মানপুরের কাফেটেরিয়া দ্বীপে নামা। সত্যি সত্যি রাস্তার ওপর একটা বিশ্রাম নেওয়ার জায়গা বা কফিশপ। দারুণ না? সেখানে আমার জন্য অপেক্ষায় থাপা সাহেব তার লাল স্যান্ট্রো নিয়ে। আলাপ শেষ হতেই তার গাড়িতে কিতামে তারই আস্তানায়। দুপুরের খাওয়া শেষে পায়ে পায়ে কিতামের গ্রাম। সিকিমের ট্র্যাডিশনাল বাড়ি, লিচুগাছ, ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের দুষ্টুমি…পাহাড়ের ঢাল বেয়ে নেমে আসা ঝরনার মতো তাদের হাসি, কুশল বিনিময়। তারপর আবার চলা। বহু দূরের পাহাড়ে নামচি, অন্য দিকে কালিম্পং, দার্জিলিং…ঠিক যেন ক্যানভাসে আঁকা। রাতে তারাই যেন পাহাড়ের বুকে আলোর চুমকি। অনেকটা রাত অবধি থাপার বাড়ির ছাদে বসে গল্প হয় তার পরিবারের, তার কাজের জীবনের। চুপটি করে সেই গল্প শোনে আকাশের শামিয়ানায় আটকে থাকা তারারা, জঙ্গলের গাছেরা…। শীত নামে…।
পর দিন খুব সকালে গেলাম ‘কিতাম বার্ড স্যাংচুয়ারি’তে। জঙ্গলের পথে ওঠানামা। থাপা বলে দিয়েছিল, ‘‘প্রায় ছ’-সাত কিলোমিটার পথ হবে। থকে গেলে একটা ফোন করবেন, গাড়ি নিয়ে হাজির হয়ে যাব।’’ যদিও তার দরকার হয়নি। সেই জঙ্গলে নজরে এসেছে নানা রঙের মিনিভেট, হিমালয়ের বুলবুল, হিমালয়ের কোকিল। আরও নাম-না-জানা কত রকমের পাখি। কী তাদের রঙের বাহার! দেখা হয়েছিল এক ‘ইন্ডিয়ান হর্নবিল’ বা ধনেশপাখির সঙ্গে। সাদা-কালোয় মোড়া শরীর হাল্কা হলুদ রঙা ঠোঁটে আরও হাল্কা লালের ছোঁয়া। ঘাড়টা ঘোরাল এক বার, কী দৃপ্ত! একটা দুর্দান্ত প্রোফাইল। জঙ্গলের সবুজ ক্যানভাসে ছবি হয়ে গেল পাখিটা। বার্ড ওয়াচার আর ফটোগ্রাফারদের জন্য আদর্শ শীতকালের এই কিতামের স্যাংচুয়ারি। ফিরলাম আস্তানায়। গরম গরম লুচি, পনিরের সব্জি আর লেবু চা দিয়ে জমাট প্রাতরাশ। তারপর আবার বেরিয়ে পড়া। নামচি, নামচিবাজার হয়ে সাঁইমন্দির ঘুরে আমি আজ যাব আমার নতুন ডেরায়..সুন্বুক।
আকাশে রং ছড়িয়ে ভোর হচ্ছে কিতামে।
সেই মানপুর কাফেটেরিয়াতে থাপাসাহেব আমার দায়িত্ব দিলেন প্রহ্লাদকে। সুম্বুকে ওঁর বাড়িতেই আমার থাকার ব্যবস্থা। প্রহ্লাদজির অটোতে চেপে বসি। কিছু ক্ষণের মধ্যেই সুম্বুক। ছোট্ট একটা পাহাড়ি গ্রাম। প্রহ্লাদের বাড়িটা মূল রাস্তা থেকে একটু নীচে। প্রহ্লাদ, তার স্ত্রী, বোন আর বাচ্চাদের সে আপ্যায়ন আমি কখনও ভুলব না। যেন এক টুকরো প্রাচীন ভারত…যেখানে এখনও ‘অতিথি নারায়ণ’ ধারণাটা তাঁদের মজ্জায়। দুপুরের খাওয়া শেষে প্রহ্লাদের সঙ্গে পায়ে পায়ে সুম্বুক। জঙ্গলের পথ বেয়ে নীচে প্রাচীন দুর্গা, শিবমন্দির। অজস্র ফুল প্রজাপতির পাখার আঘাতে অশান্ত। ফিরছি যখন এক ঝাঁক ময়ূর। গ্রামের ধানখেত ধরে চলতে চলতে তারা ডানা সপসপিয়ে একেবারে জঙ্গলের গাছের উঁচু ডালে। ক্যামেরাবন্দি করি তাদের। সূর্য তখন পাটে বসেছে।
সুম্বুকের রাতের নিস্তব্ধতা অসম্ভব রকমের মন কেমন করা। সে আমাকে শিখিয়েছে নৈঃশব্দ্যেরও কিছু শব্দ থাকে। সে শব্দ কান দিয়ে শোনা যায় না। শুধু অনুভব করা যায় সমস্ত শরীর-মন দিয়ে। সে দিন অনেক রাত অবধি আমি শুনেছি নিঃশব্দ রাতের কথা। পরদিন সকাল সকাল জঙ্গলের পথে এক চক্কর ঘুরে এসে জলখাবার ও স্নান সেরে আমরা রওনা দিলাম ‘ফুলদাঁড়া’র পথে। স্থানীয়রা বলেন, ফুলের উপত্যকা। এপ্রিল-মে মাসে এ অঞ্চল ফুলে ভরে থাকে। ফুল দেখতে না পেলেও এখানে দাঁড়িয়ে দু’চোখ ভরে কাঞ্চনজঙ্ঘাকে দেখেছি, ধ্যানগম্ভীর, সামদ্রুপতসের, পদ্মনাভর মূর্তিকে সামনে রেখে। অপূর্ব সে দৃশ্য। অনেকটা সময় বসেছিলাম সেখানে, নীরবে। জঙ্গলের পথ ধরে পৌঁছলাম এক লেকের ধারে। আগে সেখানে নীচ থেকে জল উঠত, বাঁধিয়ে দেওয়ায় সে জলের উৎস প্রায় বন্ধ। ইচ্ছা আর সময় থাকলে এখান থেকে রাবাংলা ঘুরে নিতে পারেন। প্রহ্লাদকে বললে সে ব্যবস্থা করে দেবে। ফিরতি পথে যখন সাদামের দিকে যাচ্ছি তখন পথের ধারের সবুজ মন ভরায়। উডস্পাইডারদের জলে আটকে থাকা রংচঙে প্রজাপতিটা মন খারাপ করায়। প্রকৃতি কখনও কখনও এমন বাস্তব! সাদাম হয়ে ‘তারেভীর’। পথে ছোট ছোট গ্রাম, চার্চ সরে সরে যায়। তারেভীরের ওপর থেকে যদি একেবারে শেষের দিকে তাকানো যায় তবে তাকে অনেকটা চিনের প্রাচীরের মতো লাগে। বড় সুন্দর করে বাঁধানো। এ পথের একেবারে শেষে পাহাড়টা হঠাৎ যেন ঝাঁপ দিয়েছে অতলে। একটুর জন্য হলেও বুকের ভিতরটা কেমন করে উঠবেই। ওর ওপরে একেবারে সীমানায় দাঁড়িয়ে দু’হাত দু’দিকে ছড়িয়ে বুক ভরে শ্বাস নিয়ে দু’চোখ বুজুন, একেবারে টাইটানিকের সেই দৃশ্য!
পাখনা মেলেছে পাহাড়ি প্রজাপতি।
ফেরার পথে প্রহ্লাদ-দম্পতি আমাকে গাড়ি করে বাসস্ট্যান্ডে পৌঁছে দিতে এসেছে। সন্ধ্যানীল আকাশের বুকে সাদা মেঘের তুলি বুলিয়ে ছবি আঁকছে দিনান্তের শেষ সূর্য। সুম্বুকের সেই আকাশে ইমনের শেষ ঝালার আর্তি যেন ছড়িয়ে দিচ্ছে কোনও দক্ষ শিল্পীর সন্তুরের তারে আঙুলের ছোঁয়া। প্রহ্লাদের স্ত্রী বিমলার চোখে রঙ্গিতের জল ছলোছলো। এ দু’দিনেই এমন করে এই বুড়োটাকে ভালবেসে ফেলল না কি বোকা মেয়েটা! এক থোকা গোলাপি-সবুজ পাহাড়ি ফুল সমেত ছোট্ট গাছটা আমার হাতে তুলে দিয়ে একটুকরো মিষ্টি হাসি ঠোঁটে নিয়ে আমার দিকে তাকাল সে মেয়ে। সুম্বুকের নিঃশব্দতার শব্দ তার দু’চোখেও….।
কী ভাবে যাবেন: কলকাতা থেকে যে কোনও ট্রেনে এনজেপি। সেখান থেকে শিলিগুড়ি এসএনটি বাসস্ট্যান্ডের সামনে থেকে জোরথাঙের শেয়ার জিপ। নামুন মানপুরে। আগে থেকেই ‘হোম স্টে’তে জানিয়ে রাখুন। ওঁরাই গাড়ি নিয়ে আসবেন।
কখন যাবেন:
অক্টোবর থেকে মে মাসের প্রথম সপ্তাহ অবধি ভাল সময়। শীতে কিন্তু ভাল ঠান্ডা থাকে।
কোথায় থাকবেন:
এখানে সব জায়গাতেই ‘হোম স্টে’।
যোগাযোগ করবেন:
১) উইকএন্ডডেস্টিনেশনস ডট ইনফো (ওয়েবসাইট) অথবা অরিজিৎ কর্মকার (ফোন ০৮৯০২২৩২৫৫৯)
২) কিতাম: থাপা হোম স্টে (এস থাপা, ফোন ০৯৫৯৩৩৭৪৫২৫)
৩) সুম্বুক: প্রহ্লাদ হোম স্টে (প্রহ্লাদ রাই। ফোন ০৯৭৩৩১০৬৬৪৬)
হোম স্টে-র খরচ:
থাকা ও সারা দিনে চার বার খাওয়া সমেত জনপ্রতি প্রতি দিন ৭৫০ থেকে ৯০০ টাকা।