• মঙ্গলবার , ১৯ নভেম্বর ২০২৪

সাধুদের নপুংসক’কারী কেএই গুরুরাম


প্রকাশিত: ১২:৩৫ এএম, ২৬ আগস্ট ১৭ , শনিবার

নিউজটি পড়া হয়েছে ৬৯ বার

guru-ram-www.jatirkhantha.com.bd.111ডেস্ক রিপোর্টার :  ভারতের যে বিতর্কিত ধর্মগুরু গুরমিত রাম রহিমকে শুক্রবার হরিয়ানার একটি আদালত ধর্ষণের মামলায় দোষী সাব্যস্ত করেছে, যা নিয়ে হরিয়ানা আর পাঞ্জাবে রীতিমতো যুদ্ধকালীন পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে, তিনি সত্যিই একটি বর্ণময় চরিত্র।
guru ram
হরিয়ানা-পাঞ্জাবে অন্তত ৫ লক্ষ সরাসরি ভক্ত আছে গুরমিত রাম রহিমের। তাদের দাবী, সারা বিশ্বে গুরু রাম রহিমের ছয় কোটি ভক্ত আছে।তবে বিতর্ক সব সময় রাস রহিম সিংকে তাড়িয়ে বেরিয়েছে বা তিনি নিজেই বিতর্কের জন্ম দিয়েছেন। তিনি ডেরা সাচ্চা সৌদা নামের একটি সম্প্রদায়ের নেতা – হরিয়ানার সিরসায় তাঁর প্রকাণ্ড হাই-টেক আশ্রম।তাঁকে সবসময়ে ঘিরে থাকে সশস্ত্র ব্যক্তিগত রক্ষীর দল।

শিখ, হিন্দু, মুসলিম সব ধর্মের চেতনার মিশেলেই তৈরি হয়েছে তাঁর ধর্মীয় সম্প্রদায়।ডেরা সাচ্চা সৌদার প্রতিষ্ঠা হয়েছিল ১৯৪৮ সালে। শাহ মস্তানা নামের এক ধর্মগুরু এর পত্তন করেন।বর্তমান প্রধান গুরমিত সিং ১৯৯০ সালে সম্প্রদায়ের নেতৃত্বের ভার নেন।তিনি একাধারে ধর্মপ্রচারক, সমাজ সংস্কারক, গায়ক, সিনেমার নায়ক ও পরিচালক।

অনেকগুলি চলচ্চিত্র তিনি তৈরি করিয়েছেন, আর সেই সব ছবিতে নিজেই নানা রকম স্টান্ট দেখান তিনি। যেগুলো হরিয়ানা, পাঞ্জাব সহ উত্তরপ্রদেশের বিস্তীর্ণ অঞ্চলের যুবক, নারীদের মধ্যে খুবই জনপ্রিয়।বছর কয়েক আগে দেওয়া একটি সাক্ষাতকারে তিনি বলেছিলেন, “যুব সমাজ যদি ধর্মীয় আলোচনা সভাগুলোতে আসতে না চায়, তারা সেই সময়ে লুকিয়ে হয়তো সিনেমা দেখতে চলে যায়। তাই আমি সিনেমা হলেই তাদের কাছে পৌঁছিয়ে গেছি।”

হরিয়ানার সিরসায় তার ডেরা সাচ্চা সৌদা আশ্রমের প্রাঙ্গণে নিয়মিত বসে পপ কনসার্ট। সেখানে গান ডেরার প্রধান, গুরমিত রাম রহিম সিং নিজেই – তার তুমুল জনপ্রিয় ‘ইউ আর মাই লাভ চার্জারে’র মতো আরও অনেক গান! চাক-চিক্যময় পোশাক-আষাক পরে গানের ভিডিওতে পারফর্ম করার জন্য তাকে অনেকে ‘রকস্টার বাবা’ নামে অভিহিত করেছেন।

তিনি তিনটি সিনেমা তৈরি করেছেন যেগুলো অনেক বিতর্কের পর কয়েকটি ভারতীয় ভাষায় মুক্তি পায়। এই সিনেমাগুলির একটি, এমএসজি: মেসেঞ্জার অফ গড’ – এর ট্রেইলারে মিঃ সিংকে দেখা যায় বিভিন্ন স্টান্ট পারফর্ম করতে, অন্য গ্রহের বাসিন্দা, ভুত এবং হাতীর সাথে লড়াই করতে এবং খলনায়কদের শায়েস্তা করেতে।’তার সদম্ভে চলা-ফেরাটা নিঃসন্দেহে বলিউডী, যেটা তাকে ‘সব হিরোর বাপ’ বলে চালাতে যথেষ্ট,’ দ্য হিন্দুস্তান টাইমস-এর এক পর্যালোচনায় বলা হয়।

‘এমএসজি: মেসেঞ্জার অব গড’ সিরিজের যে সিনেমাগুলোতে বাবা রাম রহিম নিজেই নায়ক গুরুজির অভিনয় করেছেন, হাজার হাজার গাড়ির কনভয় নিয়ে সেই ছবি দেখতে এসে তাঁর ভক্তরা একাধিকবার দিল্লির কাছে গুরগাঁও অচল করে দিয়েছেন! তাঁর ভক্ত সমর্থকরা যে সবসময়ে শান্তিপূর্ণ জমায়েত করে তা নয়।

এর আগেও দাঙ্গা হাঙ্গামা থেকে শুরু করে তাঁদের গুরুজীকে নিয়ে প্রশ্ন তোলায় হত্যা পর্যন্ত হতে হয়েছে বেশ কয়েকজনকে – এমনটাই অভিযোগ।একটি শিশুর মৃত্যুকে কেন্দ্র করে অশান্তি-১৯৯৮ সালে বেগু গ্রামের একটি শিশু ডেরার জীপে চাপা পড়ে মারা যায়। গ্রামবাসীদের সঙ্গে ডেরার বিরোধ শুরু হয়। আর সেই খবর প্রকাশ করায় সাংবাদিকদের ধমক দেওয়া হয়, হুমকি দেওয়া হয়। পরে ডেরা সাচ্চা সৌদা আর সাংবাদিকদের মধ্যে আলোচনার মাধ্যমে বিষয়টির মিটমাট হয়।
যৌন নির্যাতনের অভিযোগ

২০০২ সালের মে মাসে ডেরা সাচ্চা সৌদার এক নারী ভক্ত গুরমিত রাম রহিমের বিরুদ্ধে যৌন নির্যাতনের অভিযোগ তুলে প্রধানমন্ত্রীর কাছে বেনামী চিঠি পাঠান। তার একটি প্রতিলিপি পাঠানো হয় পাঞ্জাব-হরিয়ানা হাই কোর্টের প্রধান বিচারপতির কাছেও পাঠান ওই নারী ভক্ত।

দুমাসের মধ্যেই ডেরা সাচ্চা সৌদার পরিচালন সমিতির এক সদস্য রণজিৎ সিং খুন হয়ে যান। পরিচালন সমিতির সদস্যরা সন্দেহ করতেন যে মিঃ সিংই তাঁর বোনকে দিয়ে ওই বেনামী চিঠি লিখিয়েছিলেন। তাঁর বোন ওই আশ্রমের এক সাধিকা ছিলেন।
ওই চিঠির ভিত্তিতেই হাইকোর্ট সিবিআই কে তদন্তের নির্দেশ দেয়।
সাংবাদিক হত্যা

২০০২ সালে সিরসা থেকে প্রকাশিত সান্ধ্য দৈনিক ‘পুরা সচ’ (সম্পূর্ণ সত্য) – এর সম্পাদক রামচন্দ্র ছত্রপতিকে তাঁর বাড়ির সামনেই গুলি করা হয়। অভিযোগের আঙ্গুল সেই ডেরার দিকেই ওঠে। সাংবাদিকরা বিভিন্ন জায়গায় ধর্না-প্রদর্শন করতে থাকেন। একমাস পরে, দিল্লির একটি হাসপাতালে মৃত্যু হয় মিঃ ছত্রপতির।

আবারও পাঞ্জাব-হরিয়ানার হাইকোর্ট সাংবাদিক ছত্রপতি এবং রণজিৎ সিং হত্যার মামলা দুটি একত্র করে সি বি আইকে তদন্ত করতে নির্দেশ দেয়।সুপ্রিম কোর্টও যখন ওই মামলা চালিয়ে যাওয়ার নির্দেশ দেয়, তারপরে গুরমিত রাম রহিমের হাজার হাজার ভক্ত-সমর্থক বিক্ষোভ প্রদর্শন করেছিল।

২০০৭ সালে বিভিন্ন সংবাদপত্রে প্রকাশিত ছবিতে দেখা যায় যে গুরমিত রাম রহিম এমন পোশাক পড়ছেন, যেগুলো দশম শিখ ধর্মগুরু গোবিন্দ সিংয়ের পোশাকের মতো। শিখ সম্প্রদায়ের মানুষরা বিক্ষোভ শুরু করেন, রাম রহিমের কুশপুতুল জ্বালিয়ে দেন।

সেখানেই ডেরা সমর্থকরা ওই শিখ প্রদর্শনকারীদের ওপরে হামলা চালায়। তারপর থেকে গোটা উত্তর ভারত জুড়েই ডেরা সমর্থক আর শিখদের মধ্যে সংঘর্ষ হয়েছে।
ডেরা সমর্থকের গুলি চালনা

এরকমই একটা শিখ সম্প্রদায়ের বিক্ষোভ কর্মসূচীতে গুলি চালানো হয়। ডেরা সমর্থকদের দিকে আবারও অভিযোগ ওঠে।
ওই গুলি চালনায় এক শিখ যুবক মারা গিয়েছিলেন। শিখ সম্প্রদায় গুরমিত রাম রহিমের গ্রেপ্তারীর দাবীতে আন্দোলন শুরু করেন। তখন থেকেই ডেরা প্রধান গুরমিত রাম রহিমের ওপরে পাঞ্জাবে প্রবেশ নিষিদ্ধ।
বিচারককে হুমকি

দুটো হত্যা আর ধর্ষণের মামলার তদন্ত করে সি বি আই যখন গুরমিত রাম রহিমকে দোষী সাব্যস্ত করে আদালতে রিপোর্ট দাখিল করে, বিচারক তাঁকে আদালতে হাজিরার নির্দেশ দেন ২০০৭ সালের ৩১ অগাস্টের মধ্যে।ওই বিশেষ আদালতের বিচারককে হুমকি চিঠি দেওয়া হয়। তার প্রেক্ষিতে তাঁর নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করা হয়।
প্রাক্তন ম্যানেজারের গুমখুন

২০১০ সালে ডেরার প্রাক্তন সন্ন্যাসী রামকুমার বিষ্ণোই হাইকোর্টের কাছে অভিযোগ জানিয়ে বলেন যে আশ্রমের প্রাক্তন ম্যানেজার ফকির চাঁদকে গুমখুন করা হয়েছে। তিনি ওই ঘটনায় সি বি আই তদন্ত দাবী করেন।

ডেরা প্রধান রাম রহিমই ওই গুমখুনের আদেশ দিয়েছিলেন বলেও অভিযোগ করা হয়। আদালত সি বি আই তদন্তের নির্দেশ দেওয়ার পরে ডেরা সমর্থকরা পাঞ্জাব, হরিয়ানা আর রাজস্থানে ব্যাপক হাঙ্গামা চালায়, প্রচুর সরকারী সম্পত্তি ধ্বংস করা হয়, বহু বাসে আগুন লাগিয়ে দেওয়া হয়। তবে সি বি আই ওই ঘটনায় কোনও প্রমাণ যোগাড় করতে পারে নি।

সাধুদের নপুংসক করে দেওয়ার অভিযোগ

হংসরাজ চৌহান নামের এক ব্যক্তি ২০১২ সালে হাইকোর্টে মামলা করেন এই অভিযোগে যে ডেরা প্রধান রাম রহিমের নির্দেশে আশ্রমের ৪০০ সাধুকে নপুংসক করে দেওয়া হয়েছে। সাংবাদিক ছত্রপতি হত্যায় অভিযুক্ত দুই ব্যক্তিও ডেরার নপুংসক সাধু ছিলেন বলেও সেই মামলায় জানানো হয়। তারা তখন জেলে বন্দী ছিল।

তাদের জেরা করে জানা যায় যে সত্যিই ওই দুই সাধুকে নপুংসক করে দেওয়া হয়েছিল। তবে তারা এটাও বলে যে তারা স্বেচ্ছায় নপুংসক হয়েছে। এই মামলাটি এখনও বিচারাধীন, তবে রাম রহিম সিং অভিযোগটি সরাসরি অস্বীকার করেছেন। এই কথা শতভাগ মিথ্যা। আমি কাওকে এসব করতে বলিনি’, টাইমস অফ ইন্ডিয়াকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন।