সাদা পোশাকে ঐতিহাসিক জয় টাইগারদের
আর এইচ মানব : এবার সাদা পোশাকে ঐতিহাসিক জয় পেলো টাইগাররা। মিরপুর টেস্টে ওয়েস্ট ইন্ডিজকে ইনিংস ও ১৮৪ রানে হারিয়েছে বাংলাদেশ। টেস্ট ক্রিকেটে দেড় যুগের পথচলায় এই প্রথম প্রতিপক্ষকে ফলো অন করানো ও ইনিংস ব্যবধানে জয়ের অনির্বচনীয় দুটি স্বাদ দল পেল একদিনেই।
প্রথমবারের মতো কোনো দলকে ফলোঅন করানো বাংলাদেশ নিজেদের টেস্ট ইতিহাস লিখে নিলো নতুন করে। ইনিংস ব্যবধানে হারানোর স্বাদটা কেমন হয়, জানা হয়ে গেল সাকিব আল হাসানদের। সাজানো মঞ্চের নিপুণ অভিনয় শিল্পী সাকিব-মিরাজ-তাইজুলরা বাংলাদেশকে উপহার দিলেন ইনিংস ও ১৮৪ রানের বিশাল জয়। উইন্ডিজের বিপক্ষে পাওয়া এই জয়টাই বাংলাদেশের টেস্ট ইতিহাসের সবচেয়ে বড় সাফল্য। ২-০ ব্যবধানে সিরিজ জয়ে মিশে রইলো প্রতিপক্ষকে হোয়াইটওয়াশ করার অপার আনন্দও।
সাদা পোশাকে এতদিনের অভিজ্ঞতা বাংলাদেশকে শুধু বিব্রত করে এসেছে। ফলোঅন ব্যাপারটার সঙ্গে দেখা হলেও সেটা কেবল বিপক্ষেই গেছে। অনেক টেস্টেই ফলোঅনে পড়ে দুইবার করে ব্যাটিং করতে হয়েছে বাংলাদেশকে। আর মেনে নিতে হয়েছে ইনিংস পরাজয়। ফলোঅনে পড়ে দ্বিতীয়বার ব্যাটিং করাটা একপ্রকার উপহাস মেনে নেওয়ার মতোই। সেই উপহাস এবার উইন্ডিজকে জোর করে গেলালো সাকিব আল হাসানের দল।
চট্টগ্রাম টেস্ট আড়াই দিনেই জিতে নিয়েছিল বাংলাদেশ। মিরপুর টেস্টের ব্যাপ্তি একটু বেশি হলো। জেতার জন্য তৃতীয় দিনের দ্বিতীয় শেসনও শেষ করতে হয়েছে বাংলাদেশকে। তবে আক্রমণের ধরন সেই একই, স্পিন বিষে ক্যারিবীয়দের নীল করে দেওয়া। চট্টগ্রাম টেস্টে উইন্ডিজের সবগুলো উইকেট নিয়েছিল বাংলাদেশের স্পিনাররা। সেই ভরসায় মিরপুর টেস্টে কোনো পেসারই দলে রাখেনি বাংলাদেশ। প্রথমবারের মতো পেসার ছাড়া টেস্ট খেলতে নামা বাংলাদেশকে হতাশ করেননি স্পিনাররা। নিমেষেই ধসিয়ে দিয়েছেন উইন্ডিজের ব্যাটিং লাইন আপ।
শেষ পাঁচ বছরে উপমহাদেশে মাত্র একটি টেস্টে জয় পাওয়া উইন্ডিজ মিরপুর টেস্টের পুরোটা সময় কেবল পরীক্ষাই দিয়ে গেছে। টস হারে শুরু তাদের, শেষটাও হারে। বাকি সবখানে কেবলই বাংলাদেশের বিজয়ের উপাখ্যান। প্রথম ইনিংসে দারুণ ব্যাটিং করা বাংলাদেশ মাহমুদউল্লাহ রিয়াদের সেঞ্চুরি এবং সাদমান ইসলাম, অধিনায়ক সাকিব আল হাসান ও লিটন দাসের হাফ সেঞ্চুরিতে ৫০৮ রান তোলে। যা দুই ইনিংস মিলিয়েও করতে পারেনি সফরকারীরা। প্রথম ইনিংসে ১১১ রান তোলা উইন্ডিজ দ্বিতীয় ইনিংসে করে ২১৩ রান।
উইন্ডিজের প্রথম ইনিংসের পরই বাংলাদেশের জয়ের মঞ্চ তৈরি হয়ে যায়। ম্যাচ সেরা মিরাজের স্পিন জাদুতে প্রথম ইনিংসেই ৩৯৭ রানের লিড পেয়ে যায় সাকিব আল হাসানের দল। যা বাংলাদেশের টেস্ট ইতিহাসের সর্বোচ্চ লিড। এই লিডই যথেষ্ট মনে করেছে বাংলাদেশ। তাই দ্বিতীয়বারের মতো উইন্ডিজকে ব্যাটিংয়ে পাঠানো হয়। শিমরন হেটমায়ারের ৯৩ রানের পরও উইন্ডিজ পারেনি ইনিংস পরাজয় এড়াতে। টেস্টে এটা বাংলাদেশের চতুর্থ সিরিজ জয়, তৃতীয় হোয়াইটওয়াশের স্বাদ। বাংলাদেশের জেতা চার সিরিজের মধ্যে দুটি উইন্ডিজ ও দুটি জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে।
বাংলাদেশের প্রথম ইনিংসের জবাব দিতে নেমে এক মিরাজেই কুপোকাত ক্যারিবীয়রা। উইকেট শিকারের শুরুটা করে দেন সিরিজ সেরা সাকিব। এরপর চলেছে মিরাজ শো। দ্বিতীয় দিনই তিন উইকেট তুলে নেন তরুণ এই ডানহাতি স্পিনার। সঙ্গে সাকিবের দুই উইকেট। পাঁচ উইকেটে ৭৫ রান তুলে দ্বিতীয় দিন শেষ করে উইন্ডিজ। তৃতীয় দিনের সকালে সেই যমদূত মিরাজের সামনেই পড়তে হয়েছে সফরকারীদের। এদিন আরও বিধ্বংসী চেহারায় ছিলেন এই স্পিন জাদুকর।
টপাটপ চার উইকেট তুলে নিয়ে ইনিংসে নিজের ক্যারিয়ার সেরা বোলিংয়ে পৌঁছে যান মিরাজ। ৫৮ রান খরচায় ৭ উইকেট, এক ইনিংসে এটাই তার সেরা বোলিং। এর মধ্য দিয়ে টেস্টে ৭৮ উইকেটের মালিক মাশরাফি বিন মুর্তজাকে ছাড়িয়ে যান তিনি। টেস্টে মিরাজের এখন ৮৪ উইকেট। যা বাংলাদেশি বোলারদের মধ্যে চতুর্থ। তার সামনে আছেন তাইজুল ইসলাম, মোহাম্মদ রফিক ও বাংলাদেশের একমাত্র বোলার হিসেবে ২০০ টেস্ট উইকেটের মাইলফলক স্পর্শ করা সাকিব।
ফলোঅনে পড়ে দ্বিতীয় ইনিংসে ব্যাটিংয়ে নামা উইন্ডিজ সেই একই পথে হেঁটেছে। এই ইনিংসেও যমদূত হয়ে হাজির হন মিরাজ। তুলে নেন পাঁচ উইকেট। যে পাঁচ উইকেটে নিজের গড়া রেকর্ড ছাড়িয়ে যান মিরাজ। দুই বছর আগে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ঢাকা টেস্টে ১২ উইকেটে নিয়ে বাংলাদেশি বোলারদের মধ্যে এক ম্যাচে সর্বোচ্চ উইকেট নেওয়ার রেকর্ড গড়েছিলেন তরুণ এই স্পিনার। উইন্ডিজের বিপক্ষে ১২ উইকেট নিয়ে ওই বোলিং ফিগারকে পেছনে ফেলেছেন তিনি।
প্রথম ইনিংসের মতো দ্বিতীয় ইনিংসেও শুরু করে দিয়েছেন অধিনায়ক সাকিব। সঙ্গে তাল মিলিয়েছেন তাইজুল। আর মিরাজ এসে যোগ দিলে লণ্ডভণ্ড হয়ে যায় সফরকারীদের ব্যার্টিং লাইন আপ। ২৯ রানের মধ্যেই চার উইকেট হারিয়ে বসে ক্রেইগ ব্রাথওয়েটের দল। চার উইকেটের মধ্যে তাইজুল দুটি এবং সাকিব ও মিরাজ একটি করে উইকেট নেন। এরপরে আসল খেল দেখান মিরাজ। আবারও তার স্পিনে দিশেহারা হয়ে ওঠে ক্যারিবীয়রা।
এই ইনিংসে বাংলাদেশকে বেশ ভুগিয়েছেন শিমরন হেটমায়ার। অন্য প্রান্তে ভাঙনের সুর বেজে গেলেও সেদিকে নজর দেননি তিনি। খেলে গেছেন ওয়ানডে স্টাইলে। তার এমন ব্যাটিংয়ের সুবাদেই মূলত দ্বিতীয় ইনিংসে ২১৩ রান তোলে উইন্ডিজ। ৯২ বলে একটি চার ও নয়টি ছক্কায় ৯৩ রান করা হেটমায়ারকেও ফেরান মিরাজ। তার বিদায়ের পর ৩৭ রানে অপরাজিত থাকা কেমার রোচ ও ২০ রান করা শেরমন লুইস কিছুটা পথ পাড়ি দেন। কিন্তু তাতে বিশেষ কোনো লাভ হয়নি। মিরাজ পাঁচটি, তাইজুল তিনটি, সাকিব ও নাঈম হাসান একটি করে উইকেট নেন।