সাতকানিয়ায় মব জাস্টিজে- সালিশের নামে হত্যা
চট্টগ্রাম প্রতিনিধি : সাতকানিয়ায় মব জাস্টিজের নেপথ্যে আধিপত্য বিস্তার বলে সন্দেহ করছে পুলিশ। সোমবার রাত সাড়ে ১০টার দিকে উপজেলার এওচিয়া ইউনিয়নের ছনখোলা পশ্চিমপাড়া এলাকায় মসজিদের মাইকে ডাকাত এসেছে ঘোষণা দেওয়ায় লোকজন জড়ো হয়ে দু’জনকে পিটিয়ে হত্যা করে।নিহতরা হলেন– কাঞ্চনা ইউনিয়নের লতাপীর বাজার এলাকার নেজাম উদ্দিন (৪৪) ও ফুলতলা কাজীর জামে মসজিদ এলাকার আবু সালেক (৩৫)। এলাকায় দু’জনই জামায়াতে ইসলামীর ‘ক্যাডার’ হিসেবে পরিচিত। এ ঘটনায় গুলিবিদ্ধ হয়েছেন পাঁচজন। পুলিশের দাবি, নেজামের ছোড়া গুলিতে তারা আহত হয়েছেন।
যদিও এ হত্যাকাণ্ড নিয়ে পরস্পরবিরোধী বক্তব্য পাওয়া যাচ্ছে। স্থানীয়রা জানিয়েছেন, উপজেলা আওয়ামী লীগের সদস্য ও এওচিয়া ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম মানিকের খোঁজে তারা সেখানে গিয়েছিলেন। এ সময় এলাকায় ডাকাত এসেছে সন্দেহে মাইকে ঘোষণা দেওয়া হলে লোকজন তাদের ঘেরাও করে পিটুনি দিয়ে হত্যা করে।
তবে জামায়াতে ইসলামীর দাবি, মানিকের নির্দেশে তাঁর দুই ভাইয়ের নেতৃত্বে এই হত্যাকাণ্ড হয়েছে। নিহত দু’জনের স্বজনের দাবি, এটি পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড। সালিশ করার নামে ডেকে নিয়ে তাদের হত্যা করা হয়েছে। তারা জামায়াতের চট্টগ্রাম মহানগর আমির ও সাতকানিয়া-লোহাগাড়া আসনের সাবেক সংসদ সদস্য শাহজাহান চৌধুরীর অনুসারী। গুলিতে আহতরা হলেন– মো. ওবাইদুল্লাহ, নাসির, আব্বাস, মামুন সওদাগর ও মো. সাঈদ।
স্থানীয় ও প্রত্যক্ষদর্শী সূত্রে জানা যায়, রাতে তারাবির নামাজের পর কয়েকটি সিএনজিচালিত অটোরিকশায় করে নেজাম, সালেকসহ অন্তত ২০ জন ছনখোলা পশ্চিমপাড়া এলাকায় যান। এ সময় এলাকাবাসী তাদের দেখতে পেয়ে মসজিদের মাইকে এলাকায় ‘ডাকাত পড়েছে’ বলে বারবার ঘোষণা করতে থাকেন। কিছুক্ষণের মধ্যে দেড় শতাধিক লোক জড়ো হয়ে তাদের ঘিরে ফেলে। এ সময় জড়ো হওয়া লোকজনকে লক্ষ্য করে এলোপাতাড়ি গুলি করেন নেজামের অনুসারীরা। এক পর্যায়ে নেজাম ও সালেকদের সঙ্গে থাকা লোকজন পালিয়ে যান। নেজাম ও সালেককে ঘিরে ধরে লাঠিসোটা ও দেশিয় অস্ত্র দিয়ে পিটিয়ে তাদের হত্যা করা হয়।
ছনখোলা এলাকার লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, গণপিটুনির সময় কয়েকজনের মাথায় হেলমেটও দেখা গেছে এবং প্রায় ২০ মিনিটের মধ্যে শতাধিক রাউন্ড গুলি বর্ষণ করা হয়। এ সময় এলাকার লোকজন আতঙ্কিত হয়ে পড়ে। ঘটনার পরপর পুলিশ ও সেনাবাহিনীর সদস্যরা সেখানে যান।
সাতকানিয়া থানার ওসি জাহেদুল ইসলাম দৈনিক সত্যকথা প্রতিদিন কে বলেন, ‘রাতে পাঁচ থেকে ছয়টি সিএনজিচালিত অটোরিকশা করে নেজাম ও তার লোকজন সেখানে যায়। এ সময় ডাকাত এসেছে ঘোষণা দিলে লোকজন জড়ো হয়ে তাদের ঘিরে ফেলে। অন্যরা পালিয়ে গেলেও নেজাম তার রিভলবার দিয়ে গুলি করা শুরু করে। এতে পাঁচজন গুলিবিদ্ধ হন। তখন এলাকার লোকজন ক্ষিপ্ত হয়ে তাদের ঘিরে ধরে গণপিটুনি দিয়ে হত্যা করে।’
তারা সেখানে কেন গিয়েছিলেন– জানতে চাইলে ওসি বলেন, ‘এলাকার লোকজন জানিয়েছেন, নেজাম লোকজন ও অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে আগেও সেখানে মহড়া দিয়েছিলেন। সেখানকার লোকজনকে মারধরসহ নানা অপরাধে জড়িত ছিলেন তিনি।’ ঘটনাস্থল থেকে একটি বিদেশি রিভলবার ও ছয় রাউন্ড গুলির খোসা উদ্ধার করা হয়েছে বলে তিনি জানান।
স্থানীয় লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ২০১৬ সালের ১৬ অক্টোবর ছনখোলা এলাকায় কথিত ‘বন্দুকযুদ্ধে’ পুলিশের তালিকাভুক্ত সন্ত্রাসী আবুল বশর ওরফে বদাইয়া নিহত হন। বশরও জামায়াতের ক্যাডার হিসেবে পরিচিত ছিলেন। বশরের ঘনিষ্ঠ ছিলেন নেজাম উদ্দিন। বশর নিহত হওয়ার ঘটনায় সাবেক চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম মানিকের হাত রয়েছে বলে অনেকেই দাবি করেছেন।
আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকাকালে এওচিয়া এলাকায় সাম্রাজ্য গড়ে তোলেন মানিক। তাঁর বাহিনীও ছিল। সেই সময় নেজাম বিদেশ চলে যান। গত ৫ আগস্ট সরকার পতনের পর নেজাম এলাকায় আসেন। তিনি এলাকায় ‘বাহিনী’ গড়ে তোলেন। তারা মানিকের সাম্রাজ্য দখলে নেন। এ ছাড়ার তাঁর বাহিনীর সদস্যদের চাঁদাবাজি ও সন্ত্রাসের কারণে এওচিয়া, কাঞ্চনা, আমিলাইশ, চরতি ও মাদার্শা ইউনিয়নের একাংশের লোকজন অতিষ্ঠ ছিল।
সাবেক সংসদ সদস্য শাহজাহান চৌধুরীর আশীর্বাদপুষ্ট হওয়ায় পুলিশ তাঁকে ঘাঁটাত না। ৫ আগস্টের পর বশর হত্যার প্রতিশোধ নিতে মানিকের ঘরবাড়ি-খামারসহ বিভিন্ন স্থাপনা ভাঙচুর ও লুটপাট চালানো হয়। সম্প্রতি এ ঘটনাগুলোর প্রতিকার চেয়ে নজরুল ইসলামের স্ত্রী রুনা আকতার জেলা প্রশাসনের কাছে একটি আবেদন করেন। এতে অভিযোগ করা হয়, নেজাম ও তাঁর সহযোগী ইকবাল, ফারুকের নেতৃত্বে জামায়াত ক্যাডার হিসেবে পরিচিত অন্তত ৫০ জন গত ডিসেম্বরের শুরু থেকে টানা ১৫ দিন মানিকের মাছের খামার থেকে ৫০ থেকে ৬০ ট্রাক মাছ নিয়ে যায়। ১৮ ডিসেম্বর মধ্যরাতে ৩০ থেকে ৩৫টি ট্রাক নিয়ে এসে মানিকের মালিকানাধীন কেবিএম ব্রিক ফিল্ড থেকেও ২ কোটি টাকার ইট নিয়ে যায়।
সোমবার রাতে মানিক ও তাঁর সহযোগীদের খোঁজে নেজাম ছনখোলা এলাকায় গিয়েছিলেন বলে জানিয়েছেন স্থানীয়রা। এলাকার ধনাঢ্য লোকদের কাছে চাঁদাবাজির কারণেও লোকজন ক্ষুব্ধ ছিলেন নেজামের ওপর।এর আগে ১০ জানুয়ারি নেজাম উদ্দিনকে হত্যার উদ্দেশ্যে গুলি করা হয়েছিল বলে জানান তাঁর স্ত্রী আরজু আক্তার। তখন তিনি বেঁচে গেলেও এরশাদ মোহাম্মদ নামে তাঁর এক সহযোগীর গায়ে গুলি লাগে। এই ঘটনার জন্য ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়ে মো. রিফাত নামে একজনকে দায়ী করেন নেজাম উদ্দিন। রিফাতও জামায়াতের রাজনীতিতে সম্পৃক্ত বলে জানিয়েছেন স্থানীয়রা।
বলেছিলেন সালিশ করতে যাবেন কিন্তু-
গতকাল মঙ্গলবার চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ মর্গের সিঁড়িতে বসে আহাজারি করছিলেন নেজাম উদ্দিনের স্ত্রী আরজু আক্তার। তিনি জানান, আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকাকালে এলাকাছাড়া ছিলেন তাঁর স্বামী। এক পর্যায়ে তিনি বিদেশ চলে যান। ২০১৯ সালে দেশে এলেও গ্রামে ফেরেননি। আনোয়ারা উপজেলায় শ্বশুরবাড়িতে থাকতেন। গত ৫ আগস্ট তিনি এলাকায় ফেরেন। এর পর এলাকার লোকজন সামাজিক নানা ঘটনায় বিচারের জন্য তাঁর কাছে আসতেন। সোমবার রাতে তারাবির নামাজের আগে তিনি ঘর থেকে বের হয়েছিলেন। বলেছিলেন, সালিশ করতে যাবেন। রাত ১টার দিকে শোনেন তাঁকে ডাকাত বলে পিটিয়ে মেরে ফেলেছে।
আরজু আক্তারের পাশেই বসা ছিলেন আবু সালেকের বড় বোন সালমা বেগম। তিনি বলেন, ‘নেজাম ভাইয়ের সঙ্গে বিচার-আচারে আমার ভাই সঙ্গে যেতেন। সোমবার রাতেও সঙ্গে গিয়েছিলেন। তাদের বিচারের নামে পরিকল্পিতভাবে ডেকে নিয়ে হত্যা করা হয়েছে।’ তবে কারা বিচারের জন্য ডেকে নিয়ে গিয়েছিল, তা জানাতেন পারেননি এই দু’জন।
জামায়াত বলেছে-এটি পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড–
সাতকানিয়া জামায়াতের এক বিবৃতিতে বলা হয়, গত ৫ আগস্ট ফ্যাসিবাদী সরকারের পতনের পর মানিক এলাকা ছেড়ে গেলেও তার বাহিনী থেকে যায়। তার ভাই হারুন ও মমতাজের প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে সন্ত্রাসীরা এখনও নানা অপকর্মে জড়িত। সোমবার রাতে পরিকল্পিতভাবে হত্যার উদ্দেশ্যে আওয়ামী লীগের দুঃশাসনে নির্যাতিত ও ব্যবসায়ী নেজাম উদ্দিন ও আবু ছালেককে বিচারের কথা বলে ডেকে নিয়ে হত্যা করা হয়েছে।