• শুক্রবার , ২৭ ডিসেম্বর ২০২৪

সাংসদ পিনু খানের লম্পট ছেলের মস্তানিতে জোড়া খুন॥ নিঃস্ব দুটি পরিবারের আর্তনাদ


প্রকাশিত: ১:২৫ পিএম, ১০ জুন ১৫ , বুধবার

নিউজটি পড়া হয়েছে ২৮৬ বার

sansadবিশেষ প্রতিবেদক.ঢাকা: সাংসদ পিনু খানের লম্পট ছেলের মস্তানিতে জোড়া খুন হলে মামলাটি ধামাচাপা দেয়ার জোর চেষ্ঠা চলছে বলে অভিযোগ উঠেছে। বলা হয়েছে সাংসদের ছেলে মাতাল অবস্থায় এ অপকর্ম করেছে। ঘটনাটি দুই মাস আগে হলে পুলিশ তদন্তে করেছে ঢিলেঢালা।পরে মামলা গোয়েন্দা বিভাগে গেলে সেখানে চলছে জোর তদবির।
সূত্র জানায়, গত ১৩ এপ্রিল রাত পৌনে দুইটায় নিউ ইস্কাটনে এ ঘটনা ঘটে। এতে একজন অটোরিকশাচালক এবং একজন রিকশাচালক নিহত হন। বখতিয়ার আলম রনি নামের এই যুবকের বয়স ৪২, মা মহিলা আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক ও সংরক্ষিত আসনের সাংসদ পিনু খান। ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশ এ তথ্য জানিয়ে বলেছে, ঘটনার সময় বখতিয়ার নেশাগ্রস্ত ছিলেন।

ডিবি পুলিশ বলেছে, বখতিয়ার ও তাঁর গাড়ির চালক ইমরান ফকিরকে এ মামলায় গ্রেপ্তার করা হয়েছে। ইমরান আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। দুজনকেই গত ৩১ মে গ্রেপ্তার করা হয়। বখতিয়ারকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য মঙ্গলবার চার দিনের রিমান্ডে নিয়েছে ডিবি। ১ জুন তাঁর রিমান্ড আবেদন মঞ্জুর হলেও ‘অসুস্থতার’ কারণে তাঁকে হেফাজতে নিতে পারেনি ডিবি।
ওই রাতের গুলিতে অটোরিকশাচালক ইয়াকুব আলী ও রিকশাচালক আবদুল হাকিম প্রথমে আহত হন।

ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় হাকিম ১৫ এপ্রিল বিকেলে এবং ২৩ এপ্রিল ইয়াকুব মারা যান। ইয়াকুব দৈনিক জনকণ্ঠর অটোরিকশাচালক। এ ঘটনায় ১৫ এপ্রিল রাতে রমনা থানায় হত্যা মামলা করেন নিহত হাকিমের মা মনোয়ারা বেগম। এজাহারে তিনি গাড়ি থেকে একজন ব্যক্তি গুলি চালিয়েছেন বলে উল্লেখ করেন, তবে গুলিবর্ষণকারীর নাম-বর্ণনা বা গাড়ির বর্ণনা উল্লেখ করেননি।
ঘটনা দুই মাস আগের, গ্রেপ্তার হন নয় দিন আগে, মা সাংসদ বলে পুলিশ জিজ্ঞাসাবাদ করতে পারেনি

ডিবির দায়িত্বে থাকা ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি-অপরাধ) যুগ্ম কমিশনার কৃষ্ণপদ রায় এই মামলায় বখতিয়ার ও ইমরানকে গ্রেপ্তারের বিষয়টি নিশ্চিত করেন।
এ বিষয়ে  জানতে সাংসদ পিনু খানের মোবাইলে ফোন করা হলে তিনি মিটিংয়ে ব্যস্ত আছেন বলে জানান। তিনি বিকেল চারটায় ফোন করতে বলেন। তাঁর মোবাইলে চারবার ফোন করা হলেও তিনি ফোন ধরেননি। পরে খুদে বার্তা (এসএমএস) পাঠিয়েও সাড়া মেলেনি। তিনি থাকেন নাখালপাড়ায় এমপি হোস্টেলে। বখতিয়ার ধানমন্ডিতে থাকেন এবং শেয়ার ব্যবসা করেন বলে জানা গেছে।

ডিবির তদন্তসংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, মামলাটি প্রথমে তদন্ত করে রমনা থানার পুলিশ। থানার পুলিশের পাশাপাশি ডিবি ছায়া তদন্ত করে। ডিবির কর্মকর্তারা ঘটনাস্থলে গিয়ে প্রত্যক্ষদর্শী ও আশপাশের বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলেন। তাঁরা গুলিবর্ষণকারীর ও তাঁর গাড়ির বর্ণনা পান। ২৪ মে মামলার তদন্তভার পায় ডিবি। এরপর ডিবি পুরোপুরি মাঠে নামে। তদন্তকারীরা গুলিবর্ষণকারী ও তাঁর গাড়ি শনাক্ত করতে তথ্যদাতা নিয়োগ করেন এবং তথ্যপ্রযুক্তির সহায়তা নেন। তাঁরা বখতিয়ারের প্রাডো গাড়িটি শনাক্ত করেন এবং গাড়িটির চালকের অবস্থান সম্পর্কে নিশ্চিত হন। ৩১ মে দুপুরে ধানমন্ডিতে বখতিয়ারের বাসার কাছ থেকে গাড়ির চালক ইমরান ফকিরকে আটক করা হয়। তাঁকে ডিবি কার্যালয়ে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়।
তদন্তসংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, ইমরান জিজ্ঞাসাবাদে তথ্য দেন, ১৩ এপ্রিল রাতে নেশাগ্রস্ত বখতিয়ার তাঁর লাইসেন্স করা পিস্তল দিয়ে এলোপাতাড়ি গুলি চালিয়েছিলেন। এই তথ্যের ভিত্তিতে ৩১ মে রাতে ধানমন্ডির বাসা থেকে বখতিয়ারকে গ্রেপ্তার করা হয়। তাঁর কাছ থেকে হত্যাকাণ্ডে ব্যবহৃত পিস্তল, পিস্তলের ২১টি গুলি ও দুটি মুঠোফোন জব্দ করা হয়। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে বখতিয়ার জানান, ঘটনার সময় তিনি নেশাগ্রস্ত ছিলেন। এক বন্ধুকে মগবাজার মোড়ে নামিয়ে গাড়ি ঘুরিয়ে বাংলামোটরের দিকে যাচ্ছিলেন। নির্মাণাধীন এলএমজি টাওয়ারের সামনে যানজটে আটকা পড়ে গাড়ি। এতে বিরক্ত হয়ে তিনি গাড়ির জানালা খুলে পিস্তল দিয়ে এলোপাতাড়ি গুলি করেন। পিস্তলটির ব্যালাস্টিক পরীক্ষার জন্য পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) পরীক্ষাগারে পাঠানো হয়েছে। এখনো প্রতিবেদন পাওয়া যায়নি। বখতিয়ারের প্রাডো গাড়িটি জব্দ করার জন্য আদালতে আবেদন করা হয়েছে।

ডিবি সূত্র জানায়, ১ জুন আদালতে দেওয়া স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে ইমরানও একই ধরনের কথা বলেছেন। জবানবন্দি দেওয়ার পর তাঁকে কারাগারে পাঠানো হয়। সেদিন বখতিয়ারকে ১০ দিনের রিমান্ডে নেওয়ার আবেদন জানালে আদালত চার দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন। জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ডিবি কার্যালয়ে নেওয়ার পর ১ জুন সন্ধ্যায় তিনি বুকে ব্যথা অনুভব করার কথা জানান। প্রথমে তাঁকে রাজারবাগ পুলিশ লাইনস হাসপাতালে এবং সেদিনই জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। ৩ জুন পাঠানো হয় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে। ৬ জুন তাঁকে হাসপাতাল থেকে ছাড়পত্র দেওয়া হয়। পরে আদালতে নেওয়া হলে তাঁকে কারাগারে পাঠানো হয়। আদালতের অনুমতি নিয়ে গতকাল বিকেলে বখতিয়ারকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য কারাগার থেকে ডিবি কার্যালয়ে নেওয়া হয়।

মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা ডিবির উপপরিদর্শক (এসআই) দীপক কুমার দাস আদালতে দেওয়া প্রতিবেদনে বলেন, বখতিয়ারের বিরুদ্ধে জোড়া খুনের সঙ্গে জড়িত থাকার যথেষ্ট সাক্ষ্যপ্রমাণ পাওয়া গেছে। তিনি ও তাঁর গাড়িচালক দুজন নিরীহ মানুষকে হত্যা করেছেন। বখতিয়ার অসুস্থতার ভান করে কালক্ষেপণ করেছেন। হাসপাতালে পরীক্ষা করে তাঁর কোনো রোগ পাওয়া যায়নি। তিনি রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী হওয়ায় জামিনে মুক্ত হলে মামলার বাদী ও সাক্ষীদের ভয়ভীতি দেখিয়ে, চাপ সৃষ্টি করে তদন্তে বিঘ্ন ঘটাতে পারেন বলে ওই প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়।
নিহত হাকিমের মা ও মামলার বাদী মনোয়ারা বেগম গৃহকর্মী। সকালে মধুবাগ ঝিলপাড়ে তাঁর বস্তিঘরে গিয়ে তাঁকে পাওয়া যায়নি। প্রতিবেশীরা জানান, তিনি কাজে গেছেন। ছেলে জীবিত থাকাকালে মনোয়ারা কাজ করতেন না। ছেলের আয়েই চলতেন। কিন্তু এখন পেটের দায়ে বাধ্য হয়ে কাজ করছেন। ছেলের জন্য তিনি রোজই কাঁদেন।
হাকিম যে গ্যারেজের রিকশা চালাতেন, তার মালিক বাবু মিয়া জানান, মামলার খোঁজ নিতে মনোয়ারা দুই-তিন দিন পরপর তাঁর কাছে আসেন। তিনি নিজেই তেমন কিছু জানেন না বলে কিছু জানাতে পারেন না।