সরকারে অস্বস্তি-ট্রাম্পের বক্তব্যে বাংলাদেশে সংখ্যালঘু নির্যাতন
শফিক রহমান : ট্রাম্পের বক্তব্যে সরকারে অস্বস্তি দেখা দিয়েছে। বাংলাদেশ নিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সাম্প্রতিক টুইট পোস্টের জবাব দিয়েছেন সিনিয়র সচিব পদমর্যাদায় সদ্য নিয়োগ পাওয়া বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত মুশফিকুল ফজল আনসারী। পোস্টে বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে বর্বর সহিংসতা, মব দ্বারা আক্রমণ ও লুটপাটের শিকার হচ্ছে বলে দাবি করেন ট্রাম্প।
শুক্রবার (বাংলাদেশ সময়) রিপ্লাই টুইটে মুশফিকুল ফজল আনসারী লেখেন, ‘ডোনাল্ড ট্রাম্পকে ধন্যবাদ সংখ্যালঘুদের সুরক্ষা নিশ্চিত করার গুরুত্ব অনুধাবন করার জন্য, তা সংখ্যালঘুরা বিশ্বের যেখানেই হোন কিংবা যে ধর্মেরই।তবে প্রকৃত পরিস্থিতি বুঝতে সঠিক তথ্য যাচাই করা অত্যন্ত জরুরি। আজই সুইডেন-ভিত্তিক সংবাদ সংস্থা ‘নেত্র নিউজ’ একটি ফ্যাক্ট-চেক রিপোর্ট প্রকাশ করেছে, যাতে বাংলাদেশের পরিস্থিতি নিয়ে কিছু স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠীর প্রচারিত তথ্যের প্রকৃত চিত্র তুলে ধরেছে।’
পোস্টে রাষ্ট্রদূত মুশফিকুল ফজল আনসারী নেত্র নিউজের অনুসন্ধানী প্রতিবেদনের লিংক জুড়ে দেন। একইসাথে আক্রান্তদের যথাযথ সহায়তা প্রদান এবং শান্তি প্রতিষ্ঠায় সঠিক তথ্য নিশ্চিত করা গুরুত্বপূর্ণ বলে উল্লেখ করেন তিনি।যুক্তরাষ্ট্রের ২০২৪-এর নির্বাচনে প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্প সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্স ও ট্রুথ সোশ্যাল-এ অক্টোবর ৩১-এ এক পোস্টে লেখেন, ‘আমি হিন্দু, খ্রিস্টান এবং অন্যান্য সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে বর্বর সহিংসতার তীব্র নিন্দা জানাই, যারা বাংলাদেশে মব দ্বারা আক্রমণ ও লুটপাটের শিকার হচ্ছে, দেশটি সম্পূর্ণ বিশৃঙ্খলার মধ্যে রয়েছে।তিনি পোস্টে হিন্দুদের সুরক্ষা দিতে ব্যর্থ হওয়ায় বাইডেন-হ্যারিস প্রশাসনের সমালোচনা করেন।
প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব বলেন-
সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের বক্তব্যে স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠীগুলো সাময়িকভাবে বিজয়ী হতে পারে, তবে শিগগিরই তারা বুঝবে যে তা ভিত্তিহীন। গতকাল শুক্রবার রাতে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে এক পোস্টে এসব জানান প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম।
ওই পোস্টে তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশে যেসব ঘটনা ঘটছে, সে বিষয়ে ডোনাল্ড ট্রাম্প কী ভাবছেন, তা অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ। তিনি শিগগিরই নেতা হতে পারেন। তবে স্বচ্ছতার সাথে সত্যটা তুলে ধরা সরকারের কাজ। সামাজিক মাধ্যমে টাকা ঢেলে প্রচারণা বা নিউ ইয়র্কের গণপরিবহনে ব্যানার টাঙিয়ে বার্তা প্রচার কাজে আসবে না।’
বাংলাদেশে সংখ্যালঘু নির্যাতন নিয়ে ট্রাম্পের নিন্দা
শফিকুল আলম বলেন, ‘জুলাই গণ-অভ্যুত্থান নিয়ে বিশেষ করে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়কে লক্ষ্য করে সহিংসতা চালানোর বিষয়ে মিথ্যা বয়ান তৈরি করা হয়েছে। সে সময় কিছু ধর্মীয় সহিংসতা ঘটলেও সেগুলো বিচ্ছিন্ন ঘটনা। এসব নিয়ে ব্যাপকভাবে অতিরঞ্জন করা হয়েছে।’
যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট প্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্প গত বৃহস্পতিবার এক্সে এক পোস্টে বলেন, ‘আমি বাংলাদেশে হিন্দু, খ্রিষ্টান ও অন্য সংখ্যালঘুদের ওপর বর্বরোচিত সহিংসতার তীব্র নিন্দা জানাচ্ছি। দেশটিতে দলবদ্ধভাবে তাদের ওপর হামলা ও লুটপাট চালানো হচ্ছে। বাংলাদেশ এখন পুরোপুরিভাবে একটি বিশৃঙ্খল অবস্থার মধ্যে রয়েছে।’
প্রেস সচিবের সর্বশেষ বক্তব্য-
প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শনিবার বলেছেন, “বাংলাদেশের সংখ্যালঘু নির্যাতন নিয়ে ডনাল্ড ট্রাম্পের বক্তব্যটি সম্পূর্ণ ‘ডোমেস্টিক পলিটিক্যাল ইস্যু’। লবিস্টরা হয়ত এ বিষয়ে প্রভাব বিস্তার করেছে। বাংলাদেশে কোনো সংখ্যালঘু নির্যাতন হয়নি বলে দাবি করে তিনি বলেন, “বাংলাদেশে হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান ইউনিটি কাউন্সিল ৯ জন সংখ্যালঘু মারা যাওয়ার বিষয়ে যে রিপোর্ট দিয়েছে, তা বিশ্লেষণ করলে বোঝা যায় এখানে ধর্মীয় বিষয়ের চেয়ে রাজনৈতিক সম্পৃক্ততা বা অন্য কোনো কারণ ছিল।”
শনিবার রাজধানীর এফডিসিতে ‘মার্কিন নির্বাচনের প্রভাব’ বিষয়ে ডিবেট ফর ডেমোক্রেসি আয়োজিত ‘ছায়া সংসদে’ প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এ কথা বলেন।
যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচন বাংলাদেশে হঠাৎ বাড়তি নজর কেড়েছে গত ৩১ অক্টোবর রিপাবলিকান প্রেসিডেন্ট প্রার্থী ডনাল্ড ট্রাম্পের এক প্রতিক্রিয়ায়।সরকার পতনের পর বাংলাদেশে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের ওপর আক্রমণের অভিযোগের মধ্যে গত বৃহস্পতিবার কড়া প্রতিক্রিয়া জানান যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে রিপাবলিকান প্রার্থী ডনাল্ড ট্রাম্প।
সেদিন মাইক্রোব্লগিং সাইট এক্স-এ পোস্ট করে দেশটির সাবেক প্রেসিডেন্ট বাংলাদেশের ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের উপর ‘বর্বর সহিংসতা’ র অভিযোগ আনেন।
গত ৫ অগাস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর থেকে বিশেষ করে হিন্দু সম্প্রদায়ের সদস্যদের বাড়িঘর, ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে হামলার বেশ কিছু অভিযোগ পাওয়া গেছে। হিন্দু সম্প্রদায় তখন থেকেই ধারাবাহিক বিক্ষোভ চালিয়ে আসছে, যদিও সরকারের পক্ষ থেকে এসব অভিযোগকে ‘অতিরঞ্জিত’ বলে দাবি করা হয়েছে।
এর আগে বাংলাদেশে মানবাধিকার বিষয়ে গত কয়েক বছর ধরে যুক্তরাষ্ট্র নানা বক্তব্য দিয়ে এলেও এসব ঘটনায় তেমন কোনো প্রতিক্রিয়া আসেনি দেশটির পক্ষ থেকে। তবে ট্রাম্পের বক্তব্য ছিল বেশ কড়া। তিনি লেখেন, “আমি বাংলাদেশে হিন্দু, খ্রিষ্টান এবং অন্যান্য সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে ‘বর্বর সহিংসতার’ তীব্র নিন্দা জানাচ্ছি, যারা উচ্ছৃঙ্খল জনতা দ্বারা আক্রমণ ও লুটপাটের শিকার হয়েছেন। বাংলাদেশ এখন পুরোপুরি বিশৃঙ্খল।”
নিজে ক্ষমতায় থাকলে এমন ঘটনা ঘটত না বলে দাবি করে ডেমোক্রেট প্রেসিডেন্ট প্রার্থী কমলা হ্যারিস ও প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের সমালোচনা করেন তিনি।
সাবেক প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প বলেন, “আমার চোখের সামনে কখনই ঘটত না। সারা বিশ্বে ও আমেরিকায় হিন্দুদের অবহেলা করেছেন কমলা ও জো বাইডেন।”
যাহোক-ট্রাম্প যে মন্তব্যই করুন না কেন এবং যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনে যেই জিতুন না কেন, দেশটির সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্কে প্রভাব পড়ার আশঙ্কা দেখছেন না প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব। তিনি বলেন, “প্রফেসর ইউনূসের (প্রধান উপদেষ্টা) সাথে ডেমোক্রেট এবং রিপাবলিক দুই পার্টিরই সিনিয়র লিডারদের খুব ভালো সম্পর্ক। তার বন্ধু দুটি দলের মধ্যেই আছে।”
রাষ্ট্রদূতের অনুসন্ধান-
রাষ্ট্রদূত মুশফিকুল ফজল আনসারী তার পোস্টে নেত্র নিউজের অনুসন্ধানী প্রতিবেদনের লিংক জুড়ে দেন। এতে বলা হয়, নয় হিন্দুর হত্যাকাণ্ডে সাম্প্রদায়িক যোগসূত্র থাকার দাবি বিভ্রান্তিকর। আগস্ট মাসে “সাম্প্রদায়িক নৃশংসতা”র অংশ হিসেবে নয় জন হিন্দু হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন মর্মে বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদ যেই অভিযোগ তুলেছে, তার সত্যতা মেলেনি।
প্রতিবেদনে বলা হয়, শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর দেশজুড়ে “সাম্প্রদায়িক নৃশংসতা”র কবলে নয় জন হিন্দু হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন মর্মে ১৯ সেপ্টেম্বর বহুল-আলোচিত একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদ। কিন্তু অনুসন্ধানে দেখা গেছে, ওই মৃত্যুর ঘটনাগুলোর নেপথ্যে সাম্প্রদায়িক বা ধর্মীয় অভিসন্ধি থাকার কোনো স্পষ্ট লক্ষণ নেই। বরং, নয় জনের মধ্যে সাত জনই রাজনৈতিক সহিংসতা, গণ-সহিংসতা ও বৈষয়িক অপরাধমূলক হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন। ক্ষেত্রবিশেষে ঐক্য পরিষদ যেসব পত্রিকার খবরের বরাতে এমন দাবি করেছে, সেই খবরেই তাদের দাবির বিপরীতধর্মী বক্তব্য পাওয়া যায়। এমনকি সংগঠনটির স্থানীয় ও আঞ্চলিক নেতারাও কিছু দাবির সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করেছেন।