সরকারের ঘুষ কেলেংকারির ভিডিও নিয়ে তোলপাড়
বিশেষ প্রতিবেদন : কোনও রকম তদন্ত ছাড়াই মঙ্গলবারও মুখ্যমন্ত্রী রায় দিয়েছেন, নারদ নিউজের ঘুষ-ভিডিও জাল, তৃণমূলের বিরুদ্ধে চক্রান্ত। আর মঙ্গলবার কলকাতা হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতি মঞ্জুলা চেল্লুর বলেন, ‘‘এই ফুটেজ জাল হলে তা যেমন সমাজের পক্ষে বিপজ্জনক, আবার খাঁটি হলেও তাই। নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের উপর মানুষের আস্থা নিয়েই প্রশ্ন তুলে দিয়েছে এই ফুটেজ। জনমানসেও প্রভাব ফেলেছে। সেই কারণেই এই ফুটেজের ফরেন্সিক পরীক্ষা হওয়া উচিত।’’
নারদ নিউজের গোপন ক্যামেরায় তোলা ভিডিও ফুটেজে দেখা গিয়েছে, ২০১৪-র লোকসভা ভোটের আগে রাজ্যের ডজনখানেক মন্ত্রী-সাংসদ-মেয়র একটি ভুয়ো কোম্পানির প্রতিনিধির কাছ থেকে লক্ষ লক্ষ টাকা নিচ্ছেন। বিধানসভা ভোটের মুখে গত ১৪ মার্চ থেকে দফায় দফায় প্রকাশিত এই ভিডিওগুলি বিশেষ করে শহরাঞ্চলের মানুষের মনে ভয়ানক ক্ষোভের সঞ্চার করেছে। যা সামাল দিতে নাজেহাল শাসক দল। পায়ের তলার মাটি কেঁপে যাওয়ায় বার বার অবস্থান বদলাতে হয়েছে তৃণমূল নেত্রীকে। গোড়ায় তিনি ফুটেজকে জাল আখ্যা দিয়েছিলেন। পরে প্রচারসভায় ওন্দার প্রার্থী অরূপ খাঁকে দেখিয়ে বলেছেন, ‘‘ও কিন্তু চোর নয়।’’ বাগদার প্রার্থী উপেন বিশ্বাসের পাশে দাঁড়িয়ে বলেছেন, ‘‘উনি কিন্তু সৎ লোক।’’ মানুষের ক্ষোভ কমার লক্ষণ নেই দেখে অভ্যন্তরীণ দলীয় তদন্তের ফাঁপা আওয়াজ দিয়ে অবস্থা সামাল দেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন। তার পরে রবিবার কার্যত ভেঙে পড়ে বলেছেন, ‘‘আগে জানলে নিশ্চয়ই ভাবতাম। প্রার্থী ঘোষণার পরে তো আর বদলাতে পারি না!’’ তাঁর এই মন্তব্য নিয়ে দলের মধ্যে বিক্ষোভ দেখা দেওয়ায় এ দিন আবার পুরনো সুরেই ফিরে গিয়েছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। নারদ-ভিডিও-য় টাকা নিতে দেখা গিয়েছে যে সুলতান আহমেদকে, মঙ্গলবার হাওড়ার জয়পুরে একটি নির্বাচনী সভায় তাঁকে পাশে নিয়ে মমতা বলেছেন, ‘‘পাঁচ বছর আমাদের বিরুদ্ধে কেউ দুর্নীতির অভিযোগ তুলতে পারেনি। আর এখন ভোটের সময় চোর-ডাকাত-গুন্ডা বলা হচ্ছে!’’
এই প্রেক্ষাপটে নারদ-ভিডিও নিয়ে এ দিন প্রধান বিচারপতির মন্তব্য শাসক দলকে নিশ্চিত ভাবেই আরও অস্বস্তিতে ফেলবে। কারণ, শুধু জনপ্রতিনিধিদের প্রতি মানুষের আস্থা নিয়ে প্রশ্ন তোলাই নয়, নারদ-তদন্তে রাজ্য সরকারের প্রতি নিজের অনাস্থার ইঙ্গিতও এ দিন দিয়েছেন প্রধান বিচারপতি। তিনি বলেন, ‘‘ (নারদ নিউজের) ফুটেজ যে কলকাতায় বা এ রাজ্যে পরীক্ষা করা যাবে না, তা আমি বিলক্ষণ জানি। এক জন অবসরপ্রাপ্ত আইপিএস অফিসারকে আমি চিনি, যিনি সৎ এবং এই ফুটেজ পরীক্ষা করতে পারবেন।’’ তবে কে এই অফিসার, মঙ্গলবার তা জানাননি প্রধান বিচারপতি।
নারদ-ভিডিও নিয়ে তিনটি জনস্বার্থ মামলার শুনানিতে মঙ্গলবার প্রধান বিচারপতি নির্দেশ দিয়েছেন, ওই ফুটেজ, মোবাইল ফোন, পেন ড্রাউভ এবং সিডি আপাতত কোনও রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কের লকারে থাকবে। লকার থাকবে হাইকোর্টের গড়ে দেওয়া তিন সদস্যের কমিটির হেফাজতে। তবে, লকারের চাবি থাকবে হাইকোর্টের রেজিস্ট্রারের কাছে। ব্যাঙ্কের নাম গোপন রাখারও নির্দেশ দিয়েছেন প্রধান বিচারপতি।
প্রধান বিচারপতির ডিভিশন বেঞ্চ এর আগে নারদ নিউজের কর্তা ম্যাথু স্যামুয়েলকে নির্দেশ দিয়েছিল, স্টিং অপারেশনের অসম্পাদিত ভিডিও ফুটেজ এবং যে যন্ত্রে ওই ফুটেজ তোলা হয়েছে, তা যেন ২২ মার্চ আদালতে জমা দেওয়া হয়। ম্যাথু আবেদনে বলেছিলেন, নিরাপত্তার কারণে তাঁর নিজের পক্ষে আদালতে হাজির হয়ে ফুটেজ ও যন্ত্র জমা দেওয়াটা অসুবিধার। তা জেনে ডিভিশন বেঞ্চ তিন সদস্যের একটি কমিটি গড়ে দেয়। ওই কমিটিতে রয়েছেন জয়ন্ত কোলে নামে হাইকোর্টের এক রেজিস্ট্রার, রাজ্য পুলিশের আইজি অনিল কুমার এবং সিবিআইয়ের দুর্নীতি দমন শাখার পুলিশ সুপার নগেন্দ্র প্রসাদ। ডিভিশন বেঞ্চের নির্দেশ মেনে ম্যাথুর কাছ থেকে যাবতীয় জিনিসপত্র সংগ্রহ করে এ দিন তা আদালতে জমা দিয়েছেন রেজিস্ট্রার। অনিল কুমার ও নগেন্দ্র প্রসাদও আদালতে হাজির ছিলেন।
মামলার আবেদনকারীদের আইনজীবী বিকাশরঞ্জন ভট্টাচার্য, রাজ্যের অ্যাডভোকেট জেনারেল (এজি) জয়ন্ত মিত্র, অভিযুক্তদের আইনজীবী কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায়, কিশোর দত্ত, জয়দীপ করদের উদ্দেশে প্রধান বিচারপতি এ দিন বলেন, ‘‘রেজিস্ট্রারের কাছে ম্যাথু জানিয়েছেন, মোবাইল ক্যামেরাটিতেই সব ফুটেজ তোলা হয়েছে। তার পরে সেটি ল্যাপটপে ভরা হয়। ল্যাপটপ থেকে তোলা হয় পেন ড্রাইভে। অসম্পাদিত ফুটেজের সিডি-ও নিয়ে আসা হয়েছে।’’
এর পরেই এজি ও অন্যান্য আইনজীবীদের কাছে পরবর্তী পদক্ষেপ সম্পর্কে জানতে চান প্রধান বিচারপতি। এজি বলেন, ‘‘সব পক্ষের শুনানি শেষ হওয়ার পরই আদালত সিদ্ধান্ত নিক। তত দিন সংগৃহীত জিনিসপত্র থাকুক রেজিস্ট্রারের জিম্মায়।’’ তা শুনে বিকাশবাবু বলেন, ‘‘শুনানি শেষ হতে তো বছর গড়িয়ে যাবে। ফুটেজের ফরেন্সিক পরীক্ষা করতে দেরি করা উচিত হবে না। বিষয়টি খুবই জরুরি।’’
এর পরেই প্রধান বিচারপতি মন্তব্য করেন, যে হেতু ফুটেজটি জনমানসে বিরাট প্রভাব ফেলেছে, এ’টি জাল না আসল, সেটা নির্ণয় করাটা জরুরি। ডিভিশন বেঞ্চের অন্য বিচারপতি অরিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়ও বলেন, ‘‘ফুটেজের সত্যতার বিষয়টি সামনে আসা উচিত।’’
অভিযুক্তদের আইনজীবীদের কাছে প্রধান বিচারপতি জানতে চান, তাঁদের কিছু বলার আছে? আইনজীবী জয়দীপ কর নালিশ করেন— ‘‘ম্যাথু তাঁর প্রথম হলফনামায় বলেছেন, এ’টি (ভিডিও) টেপ। এখন বলছেন মোবাইল ক্যামেরায় তোলা ফুটেজ।’’ তা শুনে ম্যাথুর আইনজীবী বলাই চট্টোপাধ্যায় বলেন, ‘‘আদালত ম্যাথুকে দ্বিতীয় হলফনামা পেশ করতে নির্দেশ দিয়েছিল। সেই হলফনামায় ফুটেজই বলা হয়েছে। হলফনামার প্রতিলিপিও সব পক্ষকে দেওয়া হয়েছে।’’
অভিযুক্ত তৃণমূল নেতাদের আর এক আইনজীবী কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, ‘‘এই ফুটেজ ২০১৪ সালের। দু’বছর পরে কেন তা প্রকাশ করা হল, তার ফয়সালাও হওয়া উচিত।’’ কল্যাণবাবুর আরও আর্জি— আদালত যেন এখনই মামলার কোনও রায় না দেয়।
তা শুনেই প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘‘ফরেন্সিক রিপোর্ট হাতে পেলেও আদালত এখনই তা প্রকাশ করবে না। কিন্তু ফুটেজ সত্য বা মিথ্যা যাই হোক— দোষীরা কি শাস্তি পাবে না?’’ কল্যাণবাবুদের উদ্দেশে তিনি বলেন, ‘‘ম্যাথুর দ্বিতীয় হলফনামা নিয়ে কোনও আপত্তি থাকলে, তা ২৭ এপ্রিলের মধ্যে হলফনামা আকারে পেশ করতে হবে।’’ এই মামলার পরবর্তী শুনানিও হবে ওই দিনই।