• সোমবার , ২৩ সেপ্টেম্বর ২০২৪

সরকারের ইলিশ তেলেসমাতি


প্রকাশিত: ৩:২২ এএম, ২৩ সেপ্টেম্বর ২৪ , সোমবার

নিউজটি পড়া হয়েছে ৬ বার

মাছে ভাতে বাঙ্গালী ইলিশ খেতে পায় না!
অথচ সে ইলিশ চলে যাচ্ছে ইন্ডিয়ায়।
 

” মৎস্য-প্রাণিসম্পদ উপদেষ্টা বলেন,
আগে দেশের মানুষকে ইলিশ
খাওয়াতে হবে, পরে রপ্তানি। ”

” অর্থ ও বাণিজ্য উপদেষ্টা বলেছেন
ইমোশনাল কথা বলে লাভ নেই। ”

শফিক রহমান : মাছে ভাতে বাঙ্গালী ইলিশ খেতে পায় না! অথচ সে ইলিশ চলে যাচ্ছে ইন্ডিয়ায়। শনিবার ইন্ডিয়ায় ইলিশ পাচারকালে ২৮ লাখ টাকার মাছ ধরা পড়েছে। এর আগেও ইলিশ পাচার থেমে থাকেনি। ইন্ডিয়ায় ইলিশ রপ্তানি বন্ধে সরকার কঠোর হলেও শেষমেষ ইলিশ দিতে মত বদলে ফেলে। রবিবার অর্থ ও বাণিজ্য উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ দৈনিক সত্যকথা প্রতিদিন কে জানিয়েছেন, সরকারের সর্বোচ্চ মহলের সিদ্ধান্তেই ভারতে ইলিশ রপ্তানি করা হচ্ছে। তিনি বলেছেন, যে পরিমাণ ইলিশ রপ্তানি হয়েছে তা চাঁদপুর ঘাটের একদিনের ইলিশও না। তিনি আরও রহস্যর কথা বলেছেন। তা হলো ইমোশনাল কথা বলে লাভ নেই!

যাহোক রাজধানীতে ইলিশের সংকট না থাকলেও দাম চড়া। দাম কেন বেশী তা নিয়ে রয়েছে নানা তেলেসমাতি! এদিকে ভারতে ইলিশ মাছ রপ্তানি বন্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে আইনি নোটিশ পাঠিয়েছেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী মো. মাহমুদুল হাসান। রোববার বাণিজ্যসচিব, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদসচিব, জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের চেয়ারম্যান ও আমদানি-রপ্তানি কার্যালয়ের প্রধান নিয়ন্ত্রক বরাবর আইনি নোটিশটি পাঠানো হয়েছে বলে জানিয়েছেন রিটকারী আইনজীবী মাহমুদুল হাসান।আইনি নোটিশ পাওয়ার তিন দিনের মধ্যে ভারতে ইলিশ রপ্তানি বন্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে বিবাদীদের প্রতি অনুরোধ জানানো হয়েছে। তা না হলে এ বিষয়ে ব্যবস্থা নিতে হাইকোর্টে রিট করা হবে বলে নোটিশে উল্লেখ করা হয়েছে।

প্রশ্ন উঠেছে দেশের মানুষ ইলিশ খেতে না পেলে রপ্তানি কেন? বেশির ভাগ খুচরা বাজারের বিক্রেতারা বলছেন, পাইকারি বাজারের বিক্রেতাদের ওপর। পাইকারি বিক্রেতারা নিজেদের কাঁধে দোষ নিতে নারাজ। তারা বলেন ঘাটেই দাম বেশি। নাম প্রকাশ না করার শর্তে কয়েকজন ব্যবসায়ী বলেন, ইলিশ মাছের বাড়তি দামের অন্যতম কারণ অতিরিক্ত ‘রপ্তানি’ ও ‘সিন্ডিকেট’।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এ অবস্থার জন্য প্রধানত দায়ী ইলিশের উচ্চমূল্য। নদী বা সাগর থেকে আহরণের পর সাধারণ ক্রেতার হাতে পৌঁছানোর আগে কয়েক হাত ঘুরে ইলিশের দাম অনেক বেড়ে যায়। জেলে, মহাজন, আড়তদার, পাইকার- এসব সিন্ডিকেট ঘুরে সবশেষ যখন পাড়া-মহল্লার বাজারে পৌঁছায় তখন ইলিশের দাম হয় সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে। মাছের আকার যত বড় হয়, পাল্লা দিয়ে দামও তত বেশি নেওয়া হয়।রফিকুল ইসলাম (ছদ্মনাম) নামে ইলিশের এক পাইকার বলেন, বাংলাদেশ থেকে প্রতিবছর উল্লেখযোগ্য পরিমাণ ইলিশ ভারতে রপ্তানি করা হয়। বিশেষ করে পশ্চিমবঙ্গের বাজারে ইলিশের প্রচুর চাহিদা রয়েছে। এই রপ্তানির ফলে দেশের বাজারে ইলিশের ঘাটতি দেখা যায়। যার ফলে দেশে ইলিশের দাম বেড়ে যায়।

রোববার (২২ সেপ্টেম্বর) রাজধানীর কারওয়ান বাজারে কয়েকটি মাছের আড়তে ঘুরে দেখা যায়, পাইকারি বাজারে ইলিশের পর্যাপ্ত সরবরাহ রয়েছে। বরিশাল, ভোলা, চাঁদপুর, কক্সবাজারসহ বিভিন্ন এলাকা থেকে পিক-আপ ও ট্রাকে করে আনা হয়েছে প্রচুর পরিমাণে ইলিশ। ব্যবসায়ীরা জানান, সপ্তাহ জুড়েই বাজারে প্রচুর ইলিশ এসেছে। তবে সে অনুযায়ী দাম কমেনি।বেশি সরবরাহ থাকার পরও কেন বাড়তি দাম দিয়ে ইলিশ কিনতে হচ্ছে? এ প্রশ্নের সদুত্তর কেউ দিতে পারেননি। এ বিষয়ে কথা বলতেও অনাগ্রহ প্রকাশ করেন অধিকাংশ পাইকার।

বাজারে আসা ইলিশ ৪টি ভাগে বিভক্ত। প্রথম ক্যাটাগরিতে রয়েছে সবচেয়ে বড় সাইজের মাছ। এসব মাছের ওজন ১ কেজি কিংবা এর কিছুটা বেশি। যার পাইকারি দাম ধরা হচ্ছে কেজি ১৫০০-১৬০০ টাকা। এসব মাছই একই বাজারে খুচরা ১৭০০-১৮০০ টাকা কেজি দামে বিক্রি করা হচ্ছে। এরপর রয়েছে মাঝারি আকৃতির ইলিশ। যার ওজন ৭০০-৮০০ গ্রাম। এসব মাছের পাইকারি দাম ধরা হচ্ছে ৯০০-১১০০ টাকা। যা পরবর্তীতে খুচরা বাজারে ১৩০০-১৫০০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে।

তৃতীয় ক্যাটাগরিতে আছে ৫০০-৬০০ গ্রাম ওজনের ইলিশ। এগুলো পাইকারিতে ৬০০-৭০০ এবং খুচরায় ৯০০-১০০০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে। ৪র্থ ক্যাটাগরিতে আছে জাটকা বা ছোট সাইজের (দেখতে কিছুটা পুরাতন) ইলিশ। এগুলো পাইকারিতে ৫০০ টাকা কেজি এবং খুচরায় ৬০০-৭০০ টাকা কেজি দরে বিক্রি করতে দেখা গেছে।  ইলিশের রং, আকার-আকৃতি, তাজাভাব বিবেচনায় দামের ক্ষেত্রে আরও কিছুটা তারতম্য দেখা গেছে।

ব্যবসায়ীরা বলেন, ইলিশ মাছের দাম সবসময়ই বেশ চড়া থাকে। বিশেষ করে বড় ইলিশের ক্ষেত্রে। কারণ, যখন বেশি পরিমাণে ইলিশ ধরা পড়ে তখন বাজারে ছাড়া হয় না। সেগুলো কোল্ড স্টোরেজে রাখা হয়। পরবর্তীতে যখন সংকট তৈরি হয় তখন সেগুলো বাজারে ছাড়া হয়। ভরা মৌসুমে কিংবা রপ্তানি কম হলে ইলিশ বেশি থাকে। কিন্তু তারপরও সেগুলো বাজারজাত করা হয় না।
এদিকে নদীর পানি দূষণ, নাব্যতার সংকট এবং জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ইলিশের প্রজনন ক্ষেত্র সংকুচিত হয়ে আসছে বলে জানান কয়েকজন ব্যবসায়ী। তারা বলেন, এখন আর আগের মতো ইলিশ পাওয়া যায় না। ইলিশের উৎপাদন কম হচ্ছে। এ কারণে বাজারে ইলিশের প্রাপ্যতাও কমে যাচ্ছে। এতে করে পাইকারি বাজারেই দাম চড়া থাকছে।

সামনের দিনে ইলিশ মাছের দাম আরও বাড়বে বলে মন্তব্য করেছেন ব্যবসায়ীরা। তারা বলছেন, দেশে ইলিশ মাছের উচ্চ চাহিদা থাকা সত্ত্বেও উচ্চমূল্য, রপ্তানি এবং প্রাপ্যতার সংকটের কারণে দাম বাড়তি থাকে। ইলিশের রপ্তানি বন্ধ থাকায় দাম কমার যে সম্ভাবনা তৈরি হয়েছিল সেটিও মিইয়ে গেছে ফের ইলিশ রপ্তানির ঘোষণায়।
মোসলেম উদ্দিন নামে এক ব্যবসায়ী বলেন, ভারতের পশ্চিমবঙ্গে ইলিশের চাহিদা সবচেয়ে বেশি। বিশেষত দুর্গাপূজার সময়ে বাংলাদেশ থেকে ইলিশ রপ্তানির হার বেড়ে যায়। কিন্তু রপ্তানি বন্ধ থাকলে দেশের অভ্যন্তরীণ চাহিদা মেটানো যায় এবং একইসঙ্গে ইলিশ মাছের প্রজনন প্রক্রিয়াও সুরক্ষিত থাকে। তাই দাম কমানোর জন্য দেশের অভ্যন্তরীণ বাজারে ইলিশের প্রাপ্যতা সুরক্ষিত রাখতে রপ্তানিতে সীমাবদ্ধতা রাখা উচিত।

ইলিশ সংরক্ষণ ও প্রজননক্ষেত্রের উন্নয়নে উপযুক্ত ব্যবস্থা না নিলে পরবর্তী সময়ে দাম আরও বাড়তে পারে বলে মনে করছেন তিনি।এদিকে ইলিশ রক্ষায় বিজ্ঞানভিত্তিক প্রজনন সময় বিবেচনায় নিয়ে আশ্বিন মাসের পূর্ণিমাকে ভিত্তি ধরে আগামী ১৩ অক্টোবর থেকে ৩ নভেম্বর পর্যন্ত ইলিশ আহরণ, পরিবহন, বিপণন ও মজুত বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার।

এ বিষয়ে প্রাণিসম্পদ উপদেষ্টা ফরিদা আখতার বলেন, বাংলাদেশে ইলিশ মাছ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বৈজ্ঞানিকভাবে এ মাছ সংরক্ষণের দিন নির্ধারণ করা হয়। ইলিশ মাছ সুরক্ষায় বিজ্ঞানীরা পূর্ণিমা ও আমবস্যার সঙ্গে মিল রেখে তারিখ ঠিক করে থাকেন। আজকের বৈঠকে যে তারিখটা নির্ধারণে সবাই একমত হয়েছি, সেটা হলো ১৩ অক্টোবর থেকে ৩ নভেম্বর। এই ২২ দিন ইলিশ ধরা ও বিক্রি করা যাবে না।

ইমোশনাল কথা বলে লাভ নাই-

সরকারের সর্বোচ্চ মহলের সিদ্ধান্তেই ভারতে ইলিশ রপ্তানি করা হচ্ছে বলে জানিয়েছেন অর্থ ও বাণিজ্য উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ।তিনি বলেছেন, যে পরিমাণ ইলিশ রপ্তানি হয়েছে তা চাঁদপুর ঘাটের একদিনের ইলিশও না। রোববার সচিবালয়ে নিজের কার্যালয়ে সাংবাদিকদের এসব কথা বলেন তিনি।উপদেষ্টা বলেন, ভারতের সঙ্গে আমাদের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক আছে। ইলিশ রপ্তানিতে বাণিজ্যিক সুবিধা আছে। ফরেন কারেন্সি আসে। রপ্তানি না করলে চোরাচালান হয়। ভারতে ইলিশ রপ্তানিতে বাহবা পেয়েছি। রপ্তানিতেও গ্রেটার ইন্টারেস্ট আছে।

তিনি আরো বলেন, পজিটিভলি দেখেন। পেঁয়াজ আসছে না? ওরা ডিউটি কমিয়ে দিয়েছে। ইমোশনাল কথা বলে লাভ নাই। সর্বোচ্চ মহলের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করে ভারতে ইলিশ রপ্তানির সিদ্ধান্ত হয়েছে। অনেক ভেবেচিন্তে এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।শনিবার বাণিজ্য মন্ত্রণালয় থেকে পাঠানো এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, বাঙালি সনাতন ধর্মাবলম্বীদের সবচেয়ে বড় উৎসব দুর্গাপূজা উপলক্ষে ভারতে তিন হাজার মেট্রিক টন ইলিশ মাছ রপ্তানির অনুমোদন দিয়েছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়।

গত কয়েক বছর ধরে দুর্গাপূজা উপলক্ষে ভারতে ইলিশ রপ্তানি করে আসছিলো আওয়ামী লীগ সরকার। পয়লা বৈশাখ আসার আগ দিয়েও এই মাছে দাম চলে যায় সাধারণ ক্রেতার নাগালের বাইরে। চলতি বছরে এই মাছের দাম কমেনি। সরকার পতনের আগে রাজধানীর বিভিন্ন বাজারে প্রতি কেজি ইলিশ বিক্রি হয়েছে এক থেকে দেড় হাজার টাকা। সরকার পতনের পর সেই দাম আরো বেড়েছে।

এখনো রপ্তানি বন্ধের সিদ্ধান্তে মৎস্য উপদেষ্টা-

মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ উপদেষ্টা ফরিদা আখতার আগে একাধিকবার বলেছেন, দেশের মানুষের চাহিদা মিটিয়ে তারপর ইলিশ মাছ বিদেশে রপ্তানি করা হবে। দেশের মানুষ ইলিশ পাবে না, আর রপ্তানি হবে সেটা হতে পারে না।রোববার সেই কথারই পুনরাবৃত্তি করে তিনি বলেন, ভারতে ইলিশ রপ্তানির সঙ্গে মৎস্য প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের কোনও সম্পর্ক নাই। আমি এখনও আমার আগের সিদ্ধান্তেই আছি যে, আগে দেশের মানুষকে ইলিশ খাওয়াতে হবে, পরে রপ্তানি।