• মঙ্গলবার , ২৬ নভেম্বর ২০২৪

সরকারি অস্ত্র সামারি’কালে দুই ডিবি কর্তা র‌্যাবের গোয়েন্দা জালে পাকরাও


প্রকাশিত: ৩:৫০ এএম, ১১ অক্টোবর ১৬ , মঙ্গলবার

নিউজটি পড়া হয়েছে ১৮৩ বার

 

চট্টগ্রাম প্রতিনিধি : সরকারি অস্ত্র অবৈধভাবে বিক্রির কারসাজি ছক বানিয়ে মাধ্যমে মোটা অংকের টাকা হাতিয়ে নেয়া দুই ডিবি কর্মকর্তা ধরা পড়েছে র‌্যাবের গোয়েন্দাdb-rab_ জালে। এদের সঙ্গে ধরা পড়েছে তিন অস্ত্র ব্যবসায়ী।পরে ঘটনার প্রেক্ষাপটে আইনগত ব্যবস্থা নিতে জড়িতদের ডিবির হেফাজতে দেয়া হয়েছে। আটক পুলিশ কর্মকর্তার নাম উজ্জ্বল কান্তি দাসের পরিচয়পত্র ও অস্ত্র গোয়েন্দা পুলিশের জব্দ তালিকায় রয়েছে।

এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে চট্টগ্রামস্থ র‌্যাব-৭ এর অধিনায়ক লে. কর্নেল মিফতাহ উদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘এ নিয়ে তিনি কোনো মন্তব্য করতে চান না’।চট্টগ্রাম মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার দেবদাস ভট্টাচার্য বলেন, ‘বিষয়টি যেভাবে বলা হচ্ছে তেমন নয়। তবে ঘটনার বিস্তারিত আমি এ মুহূর্তে বলতে পারছি না’।

তথ্যানুসন্ধানে জানা গেছে, কামরুল ও দিদার নামে চট্টগ্রামের কুখ্যাত দুই অস্ত্র ব্যবসায়ীকে গ্রেফতারে ফাঁদ পাতে র‌্যাব। এজন্য র‌্যাব-৭ এর একটি গোয়েন্দা দল অবৈধ অস্ত্র ক্রেতার ছদ্দবেশ নেয়। আসল পরিচয় গোপন করে নানা কৌশলে অস্ত্র ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথাবার্তা চালাতে থাকে তারা। এক পর্যায়ে র‌্যাবের ছদ্দবেশী গোয়েন্দা দলের কাছে অস্ত্র বেচতে রাজি হয় অবৈধ অস্ত্রের কারবারিরা। তারা একটি উন্নতমানের ৯এমএম পিস্তল ও ১২ রাউণ্ড গুলির দাম হাঁকে দুই লাখ টাকা।

কিন্তু র‌্যাব এত দামে অস্ত্র কিনতে রাজি না হওয়ার ভান করে। নানা দর কষাকষির পর দাম ফাইনাল হয়। ১২ রাউণ্ড গুলিসহ একটি পিস্তলের দাম নির্ধারিত হয় এক লাখ বিশ হাজার টাকা। দাম চূড়ান্ত হওয়ার পর অস্ত্র ডেলিভারির স্থান ও দিনক্ষণ চূড়ান্ত করা হয়। এবার ক্রেতার বেশে র‌্যাব সদস্যরা অস্ত্র ব্যবসায়ীদের মুখোমুখি হওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। এজন্য র‌্যাব-৭ এর মেজর এসএম সুদীপ্ত শাহিনের নেতৃত্বে একটি টিম গঠন করা হয়। অস্ত্র ব্যবসায়ীদের সঙ্গে শলাপরামর্শ অনুযায়ী ৬ অক্টোবর অস্ত্র হস্তান্তরের স্থান নির্ধারণ করা হয় চট্টগ্রামের নিউমার্কেট এলাকায়।

সেখানে এবিপি নামের একটি ফাস্টফুডের দোকানে অস্ত্র ডেলিভারি দেয়া হবে। অভিযানের পরিকল্পনা অনুযায়ী আগে থেকেই এবিপি রেস্টুরেন্টের আশপাশে অবস্থান নেন অস্ত্রধারী র‌্যাব সদস্যরা। এছাড়া সাদা পোশাকে অস্ত্র ক্রেতার ছদ্দবেশী কয়েকজন র‌্যাব সদস্য অবস্থান নেন রেস্টুরেন্টের ভেতরে। কথা অনুযায়ী ওইদিন বিকাল ৬টার দিকে অস্ত্র ব্যবসায়ী কামরুল ও দিদার রেস্টুরেন্টে এসে ঢোকেন। আসার পর তারা একে অপরের পরিচয় নিশ্চিত করে কুশল বিনিময় করেন। এরপর র‌্যাব অস্ত্রের কথা জানতে চাইলে বলা হয়, অস্ত্র বহনকারী তাদের অপর একটি টিম পথিমধ্যে আছে।

এ সময় কামরুল ও দিদার অস্ত্র হস্তান্তর ও টাকা লেনদেন নিয়ে কথাবার্তা বলতে থাকেন। কথাবার্তার একপর্যায়ে কামরুল র‌্যাবকে বলেন, ‘এ জায়গাটি নিরাপদ নয়। চলেন অন্য কোনো নিরাপদ জায়গায় গিয়ে লেনদেনটি সেরে ফেলি।’ তাদের এ প্রস্তাবে সাড়া না দিয়ে র‌্যাব জানায়, ‘এখানে কোনো অসুবিধা হবে না।’ কথাবার্তার ফাঁকে অস্ত্র ও গুলির জন্য অপেক্ষা করতে থাকে র‌্যাব। কিন্তু অজ্ঞাত কারণে কামরুল ও দিদার জানিয়ে দেয় নিরাপত্তার কারণে তারা এখানে অস্ত্র ডেলিভারি দিতে পারবে না।

র‌্যাবকে সাফ কথা জানিয়ে তারা দু’জনই তৎক্ষণাৎ রেস্টুরেন্ট থেকে বেরিয়ে যান। এ সময় আসামিসহ অস্ত্র একসঙ্গে পেতে র‌্যাবও কৌশলের আশ্রয় নেয়। তাৎক্ষণিক তাদের গ্রেফতার থেকে বিরত থাকে র‌্যাব। কিছুক্ষণ পর দুই অস্ত্র ব্যবসায়ীর সঙ্গে আবারও মোবাইল ফোনে যোগাযোগ শুরু হয়। ফের অস্ত্র হস্তান্তরের স্থান নিয়ে কথাবার্তা শুরু হয়।

দ্বিতীয় দফায় উভয়পক্ষ নিউ মার্কেটের ভেতর এলাহী স্টোর নামের একটি দোকানের সামনে অস্ত্র ও গুলি ডেলিভারির কথা পাকাপাকি করে। কথা অনুযায়ী এলাহী স্টোর ও এর আশপাশে আবারও কৌশলগত অবস্থান নেয় র‌্যাব। কিছুক্ষণ অপেক্ষার পর ৭টা ৪০ মিনিটে ঘটনাস্থলে হাজির হন অস্ত্র ব্যবসায়ী কামরুল। এবার তিনি দিদারকে রেখে অপরিচিত আরেক ব্যক্তিকে সঙ্গে নিয়ে আসেন।

এরপর র‌্যাবের সঙ্গে দ্বিতীয় কথাবার্তা শুরু হয়। কিছুক্ষণ পর কামরুল ফোন করে দিদারকে ঘটনাস্থলে আসতে বলেন। রাত ৮টা ৪৫ মিনিটে ঘটনাস্থলে হাজির হন দিদার। র‌্যাব এবার দিদারের কাছে জানতে চায়, ‘অস্ত্র আসতে আর কত দেরি হবে’। দিদার জানায়, রাত ১০টার মধ্যে অস্ত্র হ্যান্ডওভার করতে পারব। কথাবার্তার একপর্যায়ে সময়মতো একটি কালোব্যাগ নিয়ে সেখানে হাজির হন এক ব্যক্তি। নিজেকে তপনকান্তি দে বলে পরিচয় দেন।

এরপর তিনি তার ব্যাগ থেকে অস্ত্র ও গুলি বের করে সাদা পোশাকে থাকা র‌্যাব কর্মকর্তাদের দেখান। এরপর অভিযানে নেতৃত্বদানকারী মেজর সুদীপ্ত শাহিন অস্ত্র ও গুলি বুঝে নেন। র‌্যাব সদস্যরা তপনকান্তি ও দিদারের হাতে অস্ত্রের দাম হিসাবে এক লাখ ২০ হাজার টাকা তুলে দেন। লেনদেন শেষে তপনকান্তি দে র‌্যাব সদস্যদের কাছে বিদায় চান। এ সময় র‌্যাব সদস্যরা তপনকান্তি দে ও দিদারকে আটক দেখিয়ে নিজেদের প্রকৃত পরিচয় প্রকাশ করেন।

সূত্র জানায়, এ সময় হঠাৎ সেখানে অজ্ঞাত দুই ব্যক্তি হাজির হন। তারা নিজেদের গোয়েন্দা পুলিশ বলে পরিচয় দেন। এ সময় র‌্যাব তাদের চ্যালেঞ্জ করে। এবার দুই আগন্তুকের একজন দ্রুত ডিবি জ্যাকেট পরে নেন। অপরজন নিজেকে ডিবির এসআই উজ্জ্বলকান্তি দাস বলে পরিচয় দেন। তিনি পুলিশের একটি পরিচয়পত্রও দেখান। অবিশ্বাস্য হলেও সত্য তিনি আসামিদের ছেড়ে দিতে বলেন। কিন্তু র‌্যাব সাফ জানিয়ে দেয়, এদের ছাড়া তো দূরের কথা এবার তোদেরও গ্রেফতার করা হবে।

আর যায় কোথায়, মুহূর্তেই পরিস্থিতি সিনেমাটিক অ্যাকশনে রূপ নেয়। উজ্জ্বল তার কোমর থেকে পিস্তল বের করে র‌্যাব সদস্যদের দিকে তাক করেন। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে র‌্যাব সদস্যরাও তাদের নিজ নিজ অস্ত্র বের করে পজিশন নেন। উভয়পক্ষের মধ্যে এ সময় উত্তপ্ত কথা বিনিময় হয়। র‌্যাব ডিবি কর্মকর্তা উজ্জ্বলের কাছে ঘটনাস্থলে আসার কারণ জানতে চায়। উজ্জ্বল র‌্যাবকে জানান, আটককৃত তপন তার মাসতুত ভাই। আত্মীয়কে ছাড়িয়ে নিতে তিনি ঘটনাস্থলে এসেছেন।

এ সময় র‌্যাবের মেজর সুদীপ্ত শাহিন নিজের পদমর্যাদাসহ পরিচয় দিয়ে অস্ত্র নামানোর জন্য এসআই উজ্জ্বলকে ধমক দেন। কিন্তু কোনো কিছুর তোয়াক্কা না করে তিনি গানফাইট স্টাইলে আরও শক্ত অবস্থান নেন। এভাবে দু’পক্ষ পরস্পরের দিকে অস্ত্র তাক করে ঘণ্টাব্যাপী অবস্থান করে। একপর্যায়ে ডিবি কর্মকর্তা উজ্জ্বল অস্ত্র নামিয়ে দুঃখ প্রকাশ করে সৃষ্ট পরিস্থিতির জন্য ক্ষমা চান। কিন্তু র‌্যাবের চোখে তিনি তখন গুরুতর অপরাধের আসামি।

এদিকে ঘটনাটি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে না জানিয়ে নিজেদের মধ্যে মিটমাট করে ফেলার প্রস্তাব দেন উজ্জ্বল। এবার র‌্যাব শক্ত অবস্থান নিয়ে এ চক্রের প্রত্যেকের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেয়ার প্রস্তুতি নেয় এবং বিষয়টি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে অবহিত করে। একইসঙ্গে র‌্যাব সদস্যরা অভিযুক্তদের সবাইকে ক্যাম্পে নিয়ে যান।

সেখানে র‌্যাবের লাগাতার জিজ্ঞাসাবাদে ডিবি কর্মকর্তা উজ্জ্বল চাঞ্চল্যকর তথ্য দেন। তিনি র‌্যাবকে জানান, তার সঙ্গে থাকা আনিসুরও ডিবি কর্মকর্তা। তার পুরো নাম আনিসুর রহমান। যিনি ডিবির এএসআই। আটককৃত আসামি তপনকান্তি দে’র কাছ থেকে যে অস্ত্রটি জব্দ করা হয়েছে সেটি ডিবি পুলিশের অস্ত্র। তিনি জানান, পিস্তল ও গুলি আনিসুরের নামে ইস্যুকৃত সরকারি অস্ত্র।

দুই ডিবি কর্মকর্তা আরও জানান, তারা মূলত অস্ত্র বিক্রেতা সেজে ক্রেতার কাছ থেকে টাকা হাতিয়ে নেন। টাকা নেয়ার পর নিজেদের আসল পরিচয় দিয়ে গ্রেফতারের ভয় দেখান। ওই সময় আরও বেনিফিট হওয়া যায়। এবারও তারা এমন পরিকল্পনা করেছিলেন। কিন্তু তারা উল্টো র‌্যাবের ফাঁদে যে পা দিয়েছেন তা বুঝতে পারেননি।

দুই পুলিশ কর্মকর্তার এমন জবানবন্দি শুনে হতবাক র‌্যাব কর্মকর্তারা। তারা অনেকটা কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়েন। এর মধ্যে ওইদিনই বিষয়টি আইনশৃংখলা বাহিনীর উচ্চপর্যায়ে চলে যায়। এরপর ভাবমূর্তি রক্ষার জন্য পুরো ঘটনা চেপে যাওয়ার নির্দেশনা আসে। কিন্তু র‌্যাব এতবড় ঘটনা সহজে ছেড়ে দিতে নারাজ।

তাই জব্দ তালিকা প্রস্তুত করে জড়িতদের ডিবি হেফাজতে হস্তান্তর করে। গোয়েন্দা পুলিশের পক্ষে পরিদর্শক গাজী ফৌজুল আজিম ঘটনার সঙ্গে জড়িত ৫ জনকে বুঝে নেন। এদের মধ্যে রয়েছেন ডিবির এসআই উজ্জ্বলকান্তি দাস, এএসআই আনিসুর রহমান এবং অস্ত্র ব্যবসায়ী তপনকান্তি দে, দিদার হোসেন ও কামরুল ইসলাম।