ছাত্রলীগ কর্মী সবুজ আলীর বাড়ীতে শোকের মাতম-
ছাত্রলীগ কর্মী সবুজ হত্যার বিচার চাইল এমপি নূর-
নীলফামারী থেকে সফিউল আলম বাবুল : কোটা সংস্কার আন্দোলনে সংঘর্ষে নিহত ঢাকা কলেজের মেধাবী শিক্ষার্থী রাজধানী ঢাকায় নিহত ছাত্রলীগ কর্মী সবুজ আলীর নিজ বাড়ি নীলফামারীতে চলছে শোকের মাতম। ছেলেকে হারিয়ে বারবার মূর্ছা যাচ্ছেন সবুজের মা সূর্য্য বানু। বাবা আব্দুর রহিম বাদশা বাড়িতে নেই। এখনো জানেন না ছেলের মৃত্যুর খবর। বুধবার (১৭ জুলাই) দুপুরে তার বাড়িতে গিয়ে দেখা যায় ছেলেকে হারিয়ে পাগলপ্রায় সবুজের মা। জরাজীর্ণ ঘরের বিছানায় শুয়ে ছেলেকে নিয়ে প্রলাপ করছেন তিনি।
নিহত সুবুজ আলী নীলফামারী সদর উপজেলা চওড়া বড়গাছা ইউনিয়নের আরাজী দলুয়া বাংলাবাজার গ্রামের আব্দুর রহিম ওরফে বাদশা মিয়ার তৃতীয় ছেলে। কোটা সবুজের বাবা আব্দুর রহিম বাদশা ভ্যানচালক এবং সূর্য্য বানু অন্যের বাড়িতে কাজ করেন। দুজনের সামান্য আয়ে ছেলেকে পড়াচ্ছিলেন ঢাকা কলেজে। স্বপ্ন দেখছিলেন ছেলে লেখাপড়া শেষে একটি ভালো চাকরি করে সংসারের হাল ধরবে। কিন্তু নিমিষেই বাবা-মায়ের সেই স্বপ্ন নিভে গেল।
বুধবার বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, পাগলপ্রায় অবস্থায় সবুজের মা আহাজারী করে বলছেন, ‘আমার পুত কো, আমার বেটা কো। দয়াল আল্লাহ আমার বেটাক দেও গো, আমার কাছে ফিরাই দেও। ও বাবারা আমার বাবাটাক আইনা দেও। আমার বেটাক আইনা দেও বাবা। আমি কত দুঃখিনী মা, আমি কত দুঃখ-কষ্ট কইরা বেটাক লেখাপড়া করাইছি। আমার বেটাক দেও গো।’
প্রতিবেশীরা জানান, দুই মাস আগে সবুজের টাকার প্রয়োজন হওয়ায় জীবীকা নির্বাহের একমাত্র অবলম্বন ভ্যানটি বিক্রি করে তাকে টাকা পাঠিয়েছিলেন বাবা। এখন জীবন-জীবীকার তাগিদে ঢাকার মানিকগঞ্জে শ্রমিকের কাজ করছেন। সবুজের মৃত্যুর খবর বাড়িতে এলেও মোবাইল ফোনে তার বাবাকে পাওয়া যাচ্ছে না।
স্থানীয়রা জানান, একমাত্র বাড়ির ভিটের আটশতক জমি ছাড়া তেমন কোনো সম্পদ নেই সবুজের পরিবারের। বাবার ভ্যান চালানোর আয়ে চলে তাদের পরিবার। চার ভাই এক বোনের মধ্যে সবুজ আলী তৃতীয়। সবার বড়ভাই সুজাব আলী একজন প্রতিবন্ধী। মেজভাই নূর নবী ঢাকায় পোশাক কারখানায় চাকরি করে কিছুটা টাকা যোগান দেন সংসারে। একমাত্র বোন বাছিরন বেগমের বিয়ের হয়েছে। সবুজ আলী ঢাকা কলেজে পরিসংখ্যান বিভাগে অনার্স শেষে মাস্টার্সে অধ্যায়নরত ছিলেন। তার ছোট ভাই শাহ সুলতান নীলফামারীর পাশ্ববর্তী পঞ্চগড় জেলার দেবীগঞ্জ সরকারি কলেজে পড়েন একাদশ শ্রেণিতে।
বুধবার দুপুরে জেলা শহর থেকে প্রায় ১৪ কিলোমিটার দূরে সবুজ আলীর বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, ছেলের মৃত্যুর শোকে মা সূর্য্য বানু শয্যাশায়ী। তিনি বলেন, ‘আমার সবুজ বেটা যদি একদিন ফোন না ধরে, আমি পাগল হয়ে যাই। আমার চোখে সমস্যা, হাঁটতে পারি না। আহারে কইলজার টুকরা, মানুষের বাড়িতে বাড়িতে কাজ কইরা, ভিক্ষা কইরা আমি সন্তানের লেহাপড়া করাইছি গো। আমার এই সন্তানের ন্যায্য বিচার আমি চাই। আমার সন্তানকে কি করলো, আমার সন্তান, আমার বেটা চাই। আমার সন্তান কোনদিন গ্রামে ঝগড়া করেনি, আমার সবুজ শান্ত।সবুজের ছোট ভাই শাহ সুলতান বলেন, গত ১৩ জুলাই সকাল পৌনে আটটার দিকে পরিবারের সঙ্গে ভাইয়ের শেষ কথা হয়েছিল। সেদিন নিজে ফোন করে মাসহ সবার খোঁজখবর নিয়েছিলেন।
চওড়াবড়গাছা ইউনিয়নের এক নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক হাফিজুল ইসলাম বলেন, সবুজ আলী আমার প্রতিবেশী। তার বাবা ভ্যান চালিয়ে অনেক কষ্টে ছেলের লেখাপড়ার খরচ জোগান দিচ্ছিলেন। ছেলের মাস্টার্স ভর্তির টাকার প্রয়োজনে গত দুইমাস আগে সে ভ্যানটি বিক্রি করে দেন। এরপর সংসার চালাতে দিনমজুরীর কাজে বর্তমানে রয়েছেন মানিকগঞ্জ জেলায়। ছেলের মৃত্যুর খবর দেওয়ার জন্য আমরা মোবাইলে তাকে চেষ্টা করে পাচ্ছি না।
তিনি বলেন,সবুজ শান্ত স্বভাবের। এলাকায় তাকে সকলে ভালো ছেলে হিসেবে চেনে। লেখাপড়ায় ভালো হওয়ায় বাবা মায়ের স্বপ্ন ছিল বড় হয়ে সংসারের হাল ধরবে। কিন্তু সে স্বপ্ন আর পূরণ হলো না পরিবারের।প্রতিবেশী অনার্স পড়ুয়া শিক্ষার্থী কাওছার আলী বলেন,‘সবুজ আলী আমার এলাকার বড়ভাই। তিনি ২০১৮-২০১৯ শিক্ষা বর্ষে পরিসংখ্যান বিভাগে ভর্তি হয়েছিলেন ঢাকা কলেজে। সম্প্রতি অনার্স শেষে মাস্টার্সে ভর্তি হয়েছেন বলে আমি জানি। কলেজের উত্তর ছাত্রাবাসের ২০৫ নম্বর কক্ষে থেকে থাকতেন তিনি।’
এদিকে সবুজের হত্যার বিচার দাবি করে নীলফামারীতে সংসবাদ সম্মেলন করেছে সদর উপজেলা আওয়ামী লীগ। সবুজ আলী ঢাকা কলেজ ছাত্রলীগের নেতা দাবি করা হয় ওই সংবাদ সম্মেলনে। বুধবার বেলা সাড়ে ১২টার দিকে জেলা আওয়ামী লীগের দলীয় কার্যালয়ে ওই সংবাদ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়।সংবাদ সম্মেলনে বক্তব্য দেন নীলফামারী-২ (সদর) আসনের সংসদ সদস্য আসাদুজ্জামান নূর। সংবাদ সম্মেলনে দাবি করা হয়, বিএনপি-জামায়াত শিবিরের বর্বরোচিত হামলায় সবুজ আলী নিহত হয়েছেন।
এ সময় সংসদ সদস্য আসাদুজ্জামান নূর বলেন, ‘সবুজ আলী আমাদের সন্তান। একজন দরিদ্র পরিবারের সন্তান। তার বাবা একজন ভ্যান চালক, যার ভাই ঢাকায় গার্মেন্টসের একজন শ্রমিক। সবুজ আলীকে ঘিরে ওই পরিবারের অনেক স্বপ্ন ছিল। সেই স্বপ্নটা কিন্তু এক নিমেষে নিভে গেল। একটা ছাত্রলীগের কর্মীকে কারা হত্যা করতে পারে। নিশ্চই দেশ বিরোধী শক্তি। যারা ৭১এ এই দেশের বিরোধীতা করেছে, যারা জ্বালাও পোড়াও রাজনীতি করে, অবরোধে রাজনীতি করে, হত্যার রাজনীতি করে, বাংলাদেশে অরাজকতার সৃষ্টি করার চেষ্টা করেছিল। যারা জঙ্গিবাদের জন্ম দিয়েছে।’
সংবাদ সম্মেলনে সভাপতিত্ব করেন সদর উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মো. আবুজার রহমান।অন্যান্যের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মো. মমতাজুল হক, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আমজাদ হোসেন, সদর উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মো. ওয়াদুদ রহমান, পৌর আওয়ামী লীগের সভাপতি মসফিকুল ইসলাম, সাধারণ সম্পাদক আরিফ হোসেন মুন, জেলা যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক শাহিদ মাহমুদ, সদর উপজেলা পরিষদের ভাইস চেয়ারম্যান জ্যেতির্ম রায় খোকন ও শান্তনা চক্রবর্তী প্রমুখ।