সড়কে ভেজাল পিচ গলছে!
শফিক রহমান : বাংলাদেশের সড়ক মহাসড়কের পিচ গলে যাওয়া নিয়ে নানা আলোচনা সমালোচনার মাঝে দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন,ভেজাল পিচ ব্যবহার হচ্ছে কিনা সেটাও সঠিকভাবে পরীক্ষা নিরীক্ষা করে দেখা দরকার।
বলা হচ্ছে চলমান তাপদাহে গলে যাচ্ছে সড়ক ও মহাসড়কের বিটুমিন (পিচ)। ঢাকা, খুলনা ও রাজশাহী বিভাগের জেলাগুলোতে তাপে পিচ গলে সড়ক নষ্ট হচ্ছে। তবে বিশেষজ্ঞ ও সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বিটুমিনের মান এবং সড়ক নির্মাণের দক্ষতায় রয়েছে প্রশ্ন। ফলে ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠছে সড়ক-মহাসড়ক।
সওজ কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, সড়কে ৬০-৭০ গ্রেডের পিচ ব্যবহার করা হয়। এর গলনাঙ্ক ৪৮ থেকে ৫২ ডিগ্রি সেলসিয়াস। অর্থাৎ, ৪৮ ডিগ্রি তাপমাত্রায় এই মানের পিচ গলে যায়। সরকারি প্রতিষ্ঠান ইস্টার্ন রিফাইনারির (ইআরএল) উৎপাদিত পিচের গলনাঙ্ক ৫২ থেকে ৫৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস। পলিমার মডিফায়েড বিটুমিনের (পিএমবি) গলনাঙ্ক ৭০ ডিগ্রির বেশি। বাস র্যাপিড ট্রানজিট (বিআরটি) এবং এলেঙ্গা-রংপুর মহাসড়কে পিএমবি ব্যবহার করা হয়েছে। এসব সড়কে পিচ গলছে না।
গত কয়েক দশকের মধ্যে এবার সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে দেশে। টানা তীব্র তাপপ্রবাহ সইতে পারেনি দেশের সড়কগুলোও। অতিরিক্ত গরমে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে সড়কের বিটুমিন গলে যায়। এ অবস্থায় প্রশ্ন ওঠে সড়ক নির্মাণে ব্যবহার করা বিটুমিনের মান নিয়ে। বলা হচ্ছে, সড়ক নির্মাণের সময় নিম্নমানের বিটুমিন ব্যবহার করা হয়েছে কি না সেটি পরীক্ষা-নিরীক্ষার বিষয়।
তবে জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বৈশ্বিক তাপমাত্রার সঙ্গে বাংলাদেশের তাপমাত্রা যেভাবে বাড়ছে তাতে দেশের সড়ক তৈরিতে নতুন পরিকল্পনা নিতে হবে। সামনে আবার তীব্র তাপপ্রবাহ দেখা দিলে সড়কের অবস্থা কী হবে তা নিয়ে শঙ্কিত সংশ্লিষ্টরা।
বাংলাদেশে সড়ক তৈরিতে বর্তমানে যে ধরনের বিটুমিন ব্যবহার করা হচ্ছে সেটি তীব্র গরম সহ্য করার উপযোগী নয়। নিম্নমানের সামগ্রী ব্যবহার ও নিম্নমানের নির্মাণকাজই গরমে সড়কের এমন ক্ষতির কারণ। বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ, সড়ক তৈরিতে প্রচলিত বিটুমিনের পরিবর্তে পলিমার মডিফাইড বিটুমিন (পিএমবি) ব্যবহার করতে হবে। এছাড়া দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনায় নতুন সড়ক তৈরির ক্ষেত্রে মনোযোগী হতে হবে বিটুমিনের বিকল্প হিসেবে কংক্রিটের সড়ক নির্মাণের দিকে।
দেশে সড়ক ও জনপথ (সওজ) অধিদপ্তরের আওতায় ২২ হাজার ৪৪৬ কিলোমিটার সড়ক রয়েছে। সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরের ২০২২-২৩ সালের বার্ষিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, এর মধ্যে ৩ হাজার ৯৯১ কিলোমিটার জাতীয় মহাসড়ক, ৪ হাজার ৮৯৭ কিলোমিটার আঞ্চলিক মহাসড়ক এবং ১৩ হাজার ৫৫৮ কিলোমিটার জেলা সড়ক।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, গত ১৫ ও ২০ এপ্রিল চুয়াডাঙ্গায় জেলা শহরের বিভিন্ন সড়কে রাস্তার পিচ গলে যায়। ওই দুদিন সেসব এলাকায় ৪২ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়। এরপর ২৫ এপ্রিল শরীয়তপুর-চাঁদপুর সড়কের ১৫টি স্থানে বিটুমিন গলে যায়। যানবাহনের চালকরা জানান, তখন ওই সড়ক দিয়ে গাড়ি চালাতে গেলে টায়ারের সঙ্গে বিটুমিন লেগে যাচ্ছিল। এছাড়া চুয়াডাঙ্গা-কালীগঞ্জ এবং চুয়াডাঙ্গা-ঝিনাইদহ সড়ক, যশোর-নড়াইল মহাসড়ক ও গাজীপুরের কালিয়াকৈর-ফুলবাড়িয়া আঞ্চলিক সড়কের বিভিন্ন জায়গায় বিটুমিন গলে যাওয়ার খবর পাওয়া যায়।
সওজ সূত্র জানায়, দেশের সড়কে ৬০-৭০ গ্রেডের বিটুমিন ব্যবহার করা হয়। এর গলনাঙ্ক ৪৮ থেকে ৫২ ডিগ্রি সেলসিয়াস। অর্থাৎ ৪৮ ডিগ্রি তাপমাত্রায় এই মানের পিচ গলে যায়। সরকারি প্রতিষ্ঠান ইস্টার্ন রিফাইনারির (ইআরএল) উৎপাদিত পিচের গলনাঙ্ক ৫২ থেকে ৫৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস। পলিমার মডিফাইড বিটুমিনের (পিএমবি) গলনাঙ্ক ৮০ ডিগ্রির বেশি।
বাস র্যাপিড ট্রানজিট (বিআরটি) এবং এলেঙ্গা-রংপুর মহাসড়কে পিএমবি ব্যবহার করার ফলে চলমান তাপপ্রবাহেও এসব সড়কে বিটুমিন গলছে না। তবে কোথাও কোথাও বিটুমিন কিছুটা গলার খবর পাওয়া গিয়েছে। এসব স্থানের বিটুমিন গলার কারণ অনুসন্ধান করছে সওজ।
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের শিক্ষক ও অ্যাকসিডেন্ট রিসার্চ ইনস্টিটিউটের সাবেক পরিচালক অধ্যাপক ড. মো. হাদিউজ্জামান দৈনিক সত্যকথা প্রতিদিন কে বলেন, টানা সাতদিন যদি তাপমাত্রা ৩৮ থেকে ৪২ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত থাকে তাহলে বিটুমিন সহনীয় পর্যায়ে থাকে।
সাতদিন পরে বিটুমিনের নিজের ভেতরের তাপমাত্রা ১০ থেকে ১৫ ডিগ্রি পর্যন্ত বেড়ে যায়। তখন বিটুমিন গলতে শুরু করে। আমাদের সড়কের কিছু কিছু জায়গায় বিটুমিন গলছে না, আবার কিছু কিছু জায়গায় গলে যাচ্ছে। সেক্ষেত্রে এটি পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা দরকার যে, সড়ক নির্মাণের সময় ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান নিম্নমানের বিটুমিন ব্যবহার করেছে কি না।
বুয়েটের এ অধ্যাপক বলেন, সড়কে একসময় সফট গ্রেটেড বিটুমিন ব্যবহার করা হতো, এখন হার্ড গ্রেটেড বিটুমিন ব্যবহার করা হয়। কিন্তু ১০ বছর আগেই আমাদের পলিমার মডিফাইড বিটুমিন ব্যবহারে চলে যাওয়া উচিত ছিল।
‘ঢাকা-চট্টগ্রাম হাইওয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হলে পিএমবি দিয়ে মেরামত করা হয়েছে। ঢাকা-রংপুর হাইওয়েতে পিএমবি ব্যবহার হচ্ছে। ঢাকা-সিলেট মহাসড়কে পিএমবি ব্যবহার হবে। এটি সর্বত্র ব্যবহার করা না গেলে কিছু রাস্তা টিকে থাকবে কিছু রাস্তা ক্ষতিগ্রস্ত হবে। সেক্ষেত্রে কিছুদিন পরপর রাস্তা সংস্কারের জন্য রাষ্ট্রকে অর্থ খরচ করতে হবে।
ড. হাদিউজ্জামান বলেন, কংক্রিটের সড়ক তৈরি করলে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের মন খারাপ হবে। কারণ, সড়ক কংক্রিটের হলে বছর বছর মেরামত করতে হবে না। কয়েক বছর পর পর নতুন করে নির্মাণ করতে হবে না। তাতে তাদের কাজ কমে যাবে। কিন্তু লাভ হবে রাষ্ট্র ও জনগণের। ফলে এখানে কম্প্রোমাইজ করার কোনো সুযোগ নেই।
বুয়েটের পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক এবং বিশ্ববিদ্যালয়টির অ্যাক্সিডেন্ট রিচার্চ ইনস্টিটিউটের (এআরআই) পরিচালক ড. মো. শামসুল হক দৈনিক সত্যকথা প্রতিদিন কে বলেন, বাংলাদেশের মহাসড়কে যে ভারী যানবাহন চলাচল করে তার জন্য বিটুমিনাস পিগমেন্ট কখনোই টেকসই সমাধান দিতে পারবে না৷ আমরা মহাসড়কে দেখি টোল প্লাজায় কংক্রিটের পিগমেন্ট দেয়, জলাবদ্ধতার জায়গায় কংক্রিটের পিগমেন্ট দেয়৷ বিটুমিন সব চাপ নিতে পারো না বলেই এসব জায়গায় কংক্রিটের পিগমেন্ট দেওয়া হয়৷ জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে অতিরিক্ত জলাবদ্ধতা হবে, আবার তাপমাত্রাও বাড়বে৷ এগুলো বিটুমিনের শত্রু৷ যে কারণে হাজার কোটি টাকা দিয়ে রাস্তা বানালেও কিছুদিন পরই মেরামতের প্রয়োজন হয়৷