সংসদে তোলপাড়: খন্দকারের বই
এমরান শফিক ঢাকা : ৭১ নিয়ে একে খন্দকারের বাড়াবাড়িতে জাতীয় সংসদে বইছে তুলকালাম অবস্থা।ঘটনার সূত্রপাত একটি জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত রিপোর্ট নিয়ে। এআওয়ামী লীগ ও জাতীয় পার্টির সাংসদদের মতে, তিনি ইচ্ছাকৃতভাবে ভুল ও অসত্য তথ্য দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃত করেছেন।
আজ বৃহস্পতিবার পয়েন্ট অব অর্ডারে দাঁড়িয়ে অনির্ধারিত আলোচনায় সাংসদেরা এ কথা বলেছেন।
সাংসদেরা এ কে খন্দকারের বইটি নিষিদ্ধের দাবি জানিয়ে বলেন, পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই অথবা অন্য কোনো প্রতিষ্ঠানের টাকায় উদ্দেশ্যমূলকভাবে তিনি এই বই লিখেছেন।
তবে আলোচকেরা জানান, তাঁরা কেউই বইটি পুরোপুরি পড়েননি। সবাই আংশিকভাবে পড়েছেন। কেউ কেউ পত্রিকা পড়ে জেনেছেন।
আওয়ামী লীগ সরকারের সাবেক মন্ত্রী ও মুক্তিযুদ্ধের উপ-সর্বাধিনায়ক এ কে খন্দকারের লেখা ‘১৯৭১: ভেতরে বাইরে’ বইটি সম্প্রতি প্রথমা থেকে প্রকাশিত হয়েছে। অনির্ধারিত আলোচনায় বইটির প্রসঙ্গ উত্থাপন করেন সাবেক মন্ত্রী আবুল কালাম আজাদ।
আলোচনায় মুক্তিযুদ্ধের সেক্টর কমান্ডার রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘ইচ্ছাকৃতভাবে ভুল করা হয়েছে। কোনো মহলের প্ররোচনা থাকতে পারে। এই বইয়ের বক্তব্য অসত্য ও ভুল। অন্য কারও ইচ্ছায় তিনি জাতির পিতাকে ছোট করার জন্য এটা করেছেন। একজন সেক্টর কমান্ডার হিসেবে এই বই প্রত্যাখ্যান করার জন্য সবাইকে আহ্বান জানাচ্ছি।’
রফিকুল ইসলাম আরও বলেন, ‘আমরা যুদ্ধ করেছি। খন্দকার সাহেব কলকাতায় হেড কোয়ার্টারে ছিলেন। তাঁর সঙ্গে আমার দীর্ঘদিনের পরিচয়। তিনি নানাভাবে কাজকর্ম করেন। সব সরকারের কাছ থেকে সুযোগ-সুবিধা নিয়েছেন। এই সরকারের থেকেও সুবিধা নিয়ে তারপর এই বইটি লিখেছেন। অথচ বইটি লেখা নিয়ে তাঁর সঙ্গে আমি দুই-তিন শ বার বসেছি। তখন তাঁর মুখ থেকে এমন কথা শুনিনি।’
রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘সামরিক বাহিনীর নেতৃত্বে নয়, বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধ হয়েছে। রাজনৈতিক নেতৃত্ব ছাড়া কোনো দেশের মুক্তিযুদ্ধ হতে পারে না।’
এ কে খন্দকারকে মুক্তিযুদ্ধের অন্য বই পড়ার পরামর্শ
বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ বলেন, ‘কেন এমন বই লিখেছেন এবং কেন এ সময় বেছে নিয়েছেন, তা আমি জানি। বঙ্গবন্ধু কন্যা যখন শোকে পাথর, তখন তিনি মোশতাককে সমর্থন করতে গিয়েছিলেন। এ ধরনের বই লিখে অন্যদের হাতে অস্ত্র তুলে দেওয়া হচ্ছে। তিনি আওয়ামী লীগের মন্ত্রী ছিলেন। মানুষের কৃতজ্ঞতাবোধ থাকা উচিত।’
তোফায়েল আহমেদ বলেন, ‘তিনি বই লিখলেন ১৯৬৯-এর গণ-অভ্যুত্থান নিয়ে। অথচ তিনি ’৬৯ সম্পর্কে কিছুই জানেন না। পাকিস্তানের অনেক পত্রিকায় আমার নাম ছাপা হয়েছে। অথচ উনি জানেন না। উনি লিখেছেন ইয়াহিয়া খানের সবচেয়ে বড় ভুল ছিল ঘূর্ণিঝড়ের পর ভোলায় না যাওয়া। …গণহত্যা ভুল ছিল না? ইয়াহিয়া খান ভোলায় গিয়েছিলেন। আমি সেখানে ছিলাম। উনি (এ কে খন্দকার) তা জানেন না।’
এ কে খন্দকারকে মুক্তিযুদ্ধের অন্যান্য বই পড়ার পরামর্শ দিয়ে তোফায়েল আহমেদ বলেন, ‘বঙ্গবন্ধু সাতই মার্চের ভাষণে জয় বাংলা বলেছিলেন। আমিসহ অনেকে সেদিন ছিলাম। আমার মঞ্চে থাকার সৌভাগ্য হয়েছিল। আমরা তো শুনলাম না বঙ্গবন্ধু “জয় পাকিস্তান” বলেছিলেন। উনি বলেছেন, আওয়ামী লীগের যুদ্ধ করার প্রস্তুতি ছিল না। এখানে অনেকে আছেন, আমরা ট্রেনিং নিয়েছি। হাওয়ার ওপর দেশ স্বাধীন হয়নি। প্রস্তুতি ছিল বলেই হয়েছে।’
এ কে খন্দকার পাকিস্তানের বুদ্ধিতে যুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন
এ কে খন্দকারের বইটি নিষিদ্ধের দাবি জানিয়ে জ্যেষ্ঠ সাংসদ শেখ ফজলুল করিম সেলিম বলেন, ‘এক শ্রেণির লোক পাকিস্তানের আইএসআইয়ের এজেন্ট। খন্দকার সাহেব পাকিস্তানের বুদ্ধি পরামর্শ নিয়ে যুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন। কোনো এজেন্সির কাছ থেকে মোটা টাকা পেয়েছেন। সে জন্য এ বই লিখেছেন। আইএসআইয়ের পয়সা খেয়েছেন কি না, সেটাও দেখতে হবে। তিনি তো বাংলাদেশে ছিলেন না। তিনি এরশাদের সময় সুবিধা নিয়েছেন। আওয়ামী লীগের সময় শেখ হাসিনাকে ধরে মন্ত্রিত্ব নিয়েছেন। এঁদের চরিত্র সম্পর্কে সচেতন থাকতে হবে। তাঁর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে।’
শিল্পমন্ত্রী আমীর হোসেন আমু বলেন, ‘বঙ্গবন্ধুই স্বাধীনতার প্রতীক ছিলেন। তাঁকে আঘাত করতে পারলে জাতিকে ভিন্ন ধারায় প্রবাহিত করা যাবে। এ অপশক্তি তা করতে চাইছে। তারা শুধু বঙ্গবন্ধুকে খাটো করছে না, তারা এ জাতির স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব নিয়ে টানাটানি করছে।’
জাসদের মঈন উদ্দীন খান বাদল বলেন, ‘শাসনতন্ত্রের বিরোধিতা যদি অপরাধ হয়, তবে এ কে খন্দকার সেই অপরাধ করেছেন। যখন সুবিধা নিলেন, তখন তো কোনো ফোরামে এসব কথা বলেননি। এখন বলছেন, হয়তো বইয়ের কাটতি বাড়াতে।’
সাবেক তথ্যমন্ত্রী আবুল কালাম আজাদ বলেন, ‘খন্দকার সাহেব লিখেছেন বঙ্গবন্ধু “জয় পাকিস্তান” বলেছেন। আমি সেখানে ছিলাম। বঙ্গবন্ধু জয় পাকিস্তান বলেননি। এখন নতুন নতুন করে বিকৃত তথ্য প্রকাশ করা হচ্ছে।’
জাতীয় পার্টির কাজী ফিরোজ রশীদ বলেন, ‘উনার সঙ্গে পাক বাহিনী ভালো ব্যবহার করেছে। কিন্তু বাঙালি জাতির সঙ্গে ভালো ব্যবহার করেনি। এ সমস্ত কুলাঙ্গার এসব ইতিহাস কোথায় পায়?’
অধিবেশনে সভাপতির আসনে ডেপুটি স্পিকার ফজলে রাব্বি মিয়া বলেন, ‘আমিও আজ পত্রিকায় পড়ে বিষয়টি জেনেছি। উনি বহুলাংশে সত্য বলেছেন। তবে আংশিক বিকৃত করেছেন। উনি তথ্য বিকৃতি করেছেন। তবে কী কারণে করেছেন, তা উনিই ভালো জানেন। যারা ১৫ আগস্টের পর মোশতাক সরকারকে সমর্থন করেন, জাতি তাদের তোয়াক্কা করে না। তারা কি লিখল, না লিখল, তাতে জাতির কিছু যায় আসে না। বঙ্গবন্ধু মানে বাংলাদেশ, বাংলাদেশ মানে বঙ্গবন্ধু।’