শুন্য থেকে শীর্ষে এক মহানায়কেরঅজানা অধ্যায়-
সাইফুল বারী মাসুম : উত্তর ভারতের নায়ক হয়েও তিনি কাঁপাচ্ছেন সারা বিশ্ব। রজনীকান্তের নাম শোনেননি এমন লোক খুঁজে পাওয়া যাবে না। রজনীকান্ত এতই বিখ্যাত যে, তার সঙ্গে অভিনয় করার লোভ বলিউড সুপার স্টার শাহরুখ খান পর্যন্ত সামলাতে পারেননি। শুধু তাই নয়, ভারতের সবচেয়ে বেশি পারিশ্রমিকপ্রাপ্ত অভিনেতাও রজনীকান্ত। অনেকেই জানেন না প্রথম জীবনে সাধারণ একজন কুলি ছিলেন এই রজনীকান্ত। জীবনযুদ্ধে এতটাই পরিশ্রম দেখিয়েছেন যে শেষ পর্যন্ত রুপালি পর্দার সুপারহিরো হয়ে উঠেছেন। শূন্য থেকেও কীভাবে চেষ্টা, উদ্যম আর অধ্যবসায় দিয়ে উপরে ওঠা যায় সেটাই প্রমাণ করেছেন।
তিনি একজনই। কোথাও কোথাও যিনি প্রাদেশিক হয়েও ছাড়িয়ে গেছেন অমিতাভ, শাহরুখ কিংবা সালমানকে। এমনকি শাহরুখ-সালমানের মতো সুপার স্টাররা তাকে অনুসরণ করতে চান। তার জনপ্রিয়তাকে পুঁজি করে ব্যবসা করতে চান। শাহরুখের রা ওয়ানে কয়েক মিনিটের সিকোয়েন্সে দেখা গেছে ‘রোবট’রূপী রজনীকান্তকে। শাহরুখের আরেক ছবি ‘চেন্নাই এক্সপ্রেস’-এর লুঙ্গি ড্যান্স গানটি রজনীকান্তকেই উৎসর্গ করে গাওয়া। রজনীকান্ত তার সিনেমা জীবনে অনেক পুরস্কার জিতেছেন। তার অভিনীত অধিকাংশ সিনেমাই তামিল। এই যে এত এত অর্জন রজনীকান্তের, তার জীবন কিন্তু এতটা মসৃণ ছিল না। অনেক চড়াই-উতরাই পেরিয়ে তিনি বিখ্যাত হয়েছেন।
বিখ্যাত এই মানুষটির জন্ম ১৯৫০ সালের ১২ ডিসেম্বর ভারতের মিসোর রাজ্যের বেঙ্গালুরুতে একটি মারাঠি পরিবারে। এটি বর্তমানে কর্ণাটকের একটি অংশ। তার নাম ছত্রপতি শিবাজীর নাম অনুসারে শিবাজী রাও গায়কোয়াড় রাখা হয়। রজনীকান্তের পূর্বপুরুষরা মাভদি কাদি পাথার নামে একটি গ্রাম থেকে আসেন, যা বর্তমানে মহারাষ্ট্রের পুনে জেলার পুরান্দার তালুক নামের একটি স্থান। রজনীকান্তের বাবা, রামজী রাও গায়কোয়াড় একজন পুলিশ কনস্টেবল ছিলেন। তার বাবা ১৯৫৬ সালে কাজ থেকে অবসরগ্রহণ করলে তাদের পরিবার হনুমান্থনগরে চলে যায়। ছয় বছর বয়সে রজনীকান্ত ‘গাভিপুরাম সরকারি কন্নড় মডেল প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি হন এবং সেখান থেকে তার প্রাথমিক শিক্ষা শেষ করেন।
শিশু রজনী ক্রিকেট, ফুটবল এবং বাস্কেটবল খেলায় অনেক আগ্রহী ছিলেন। ছোটবেলায় অবশ্য তিনি দুষ্ট প্রকৃতিরও ছিলেন। তখন তার ভাই তাকে রামকৃষ্ণ মিশন কর্তৃক স্থাপিত রামকৃষ্ণ মঠে নিয়ে যান। মঠে তিনি বেদ শিখতেন। আধ্যাত্মিক শিক্ষার সঙ্গে, তিনি মঠে নাটকে অভিনয়ও শুরু করেন। তার বয়স যখন এগারো তখন তার মা মারা যান।
ষষ্ঠ শ্রেণি পাসের পর তিনি আচার্য্য পাঠশালা পাবলিক বিদ্যালয়ে ভর্তি হন। সেখানে তিনি প্রচুর নাটকে অভিনয় করেন। বিদ্যালয়ে পড়া শেষ করে তিনি বেঙ্গালুরু এবং মাদ্রাজ শহরে বিভিন্ন রকম কাজ করেন, এমনকি কুলি এবং মিস্ত্রীর কাজও করেন। পরিশেষে তিনি বেঙ্গালুরু ট্রান্সপোর্ট সার্ভিসের বাসের সহকারী হিসেবে নিয়োগ পান। জীবনের অনেক গুরুত্বপূর্ণ সময় কেটেছে বেঙ্গালুরে বাসের কন্ডাক্টর হিসেবে।
তবে তার মনের ভিতর অভিনয়ের একটা পোকা ছিল গোপনে। সেজন্যই একসময় সেখান থেকে চলে যান মাদ্রাজ ফিল্ম ইনস্টিটিউটে। তার এমন সিদ্ধান্তে মোটেও খুশি ছিলেন না তার বাবা। সেই সময় এগিয়ে আসেন তার বন্ধু রাজ বাহাদুর। রজনীর অভিনয় জীবনের শুরু হয় মঞ্চনাটক দিয়ে। টোপি মনিয়াপ্পা নামের একজন পরিচালক তাকে মঞ্চনাটকে সুযোগ করে দেন। তারপর ডাক পান তামিল পরিচালক কে বালাচরনদারের ছবিতে। শুরু হলো পথ চলা। এরপর থেকে আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি তাকে।
২০০৭ সালে শিভাজী দ্য বস নামের একটি ছবিতে অভিনয় করে পারিশ্রমিক হিসেবে তিনি আয় করেন ২৬ কোটি রুপির চেয়েও বেশি। এটি ভারত তো বটেই গোটা এশিয়াতেও একটি রেকর্ড। এশিয়ার মধ্যে তার আগে আছেন কেবল জ্যাকি চ্যান। এ তো গেল অনেক দিন আগের গপ্পো। এখন পর্যন্ত বলিউডের সর্বোচ্চ পারিশ্রমিক নেওয়া অভিনেতার নাম হৃত্বিক রোশন, যিনি কিনা তার আগামী মুভি হলিউডের ‘নাইট এন্ড ডে’-এর হিন্দি রিমেকের জন্য পারিশ্রমিক নিতে যাচ্ছেন ৩০ কোটি রুপি।
কিন্তু বলা হয়ে থাকে, এনিথিরান (রোবট) মুভিটিতে অভিনয়ের জন্য রজনীকান্ত পারিশ্রমিক নিয়েছিলেন ৫০ কোটি রুপি! এই সায়েন্স ফিকশনধর্মী তামিল ছবি এনথিরান ২০১০ সালে বিশ্বে টপ ৫০-এর মধ্যে স্থান করে নিয়েছিল। শুধু তাই নয়, তার এই ছবিটি একটি স্নাতকোত্তর কোর্সের কেস স্টাডিতে জায়গা পেয়েছিল।
রজনীকান্তকে ভারতীয়রা কী পরিমাণ সম্মান করে এবং তাকে ঘিরে উন্মাদনার মাত্রা কতটুকু এটি আসলে ফিচার লেখে বোঝানো সম্ভব নয়। ভারতীয় ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিতে এতটাই জনপ্রিয় যে, উনাকে মিডিয়ায় বলা হয় ‘গড অব ইন্ডিয়ান সিনেমা’! স্বয়ং অমিতাভ বচ্চন একবার বলেছিলেন যে, উনি রজনীকান্তকে একজন অনুপ্রেরণা হিসেবে দেখেন।
রজনীকান্ত ভারতের ‘পদ্মভূষণ’ উপাধিতে ভূষিত হয়েছেন। ছয়বার তামিলনাড়ু স্টেট ফিল্ম অ্যাওয়ার্ড এবং একবার ফিল্মফেয়ার (তামিল) অ্যাওয়ার্ডজয়ী এই অভিনেতার মুভি এন্ধিরান তথা রোবট রিলিজ পাওয়ার সময় চেন্নাইয়ের রজনীকান্ত ভক্তরা উনার প্রায় ৪০ ফুট উঁচু একটি মূর্তি বানিয়ে দুধ দিয়ে গোসল করিয়েছিলেন! ভারতে প্রচলিত জোকসগুলোর মধ্যে ‘রজনীকান্ত জোকস’ সবচেয়ে বিখ্যাত।
এই কিংবদন্তি অভিনেতা তামিল, তেলেগু, কান্নাদা, মালায়াম, হিন্দি এমনকি বাংলা ছবিতেও অভিনয় করেছেন। কিন্তু কোনোটিতেই তিনি মাতৃভাষা ব্যবহার করেননি। মূলত তিনি ভারতের মহারাষ্ট্রের অধিবাসী।
মজার ব্যাপার হলো এত বিখ্যাত হওয়া সত্ত্বেও কখনো নিজের ছবির প্রচারণায় রজনীকান্তকে খুব একটা দেখা যায় না। পর্দায় তিনি যতটা এন্টারটেইনিং ব্যক্তিগত জীবনে ঠিক ততটাই অন্তর্মুখী তিনি। রজনীকান্তের ভক্তরা মনে করেন তিনি যে কোনো বয়সী যে কোনো ধরনের চরিত্রের জন্য একজন নির্ভরযোগ্য অভিনেতা। রজনীকান্তই প্রথম ভারতীয় অভিনেতা যিনি বিভিন্ন প্রযুক্তির ক্যামেরায় কাজ করেছেন।
রজনীকান্ত তার প্রতিটি ছবির শুটিং শেষে চেন্নাই থেকে হিমালয়ে হাওয়া খেতে যান। একবার চেন্নাইতে তার জন্ম দিনের অনুষ্ঠান থেকে ফেরার পথে তার এক ভক্ত সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যান। এরপর থেকে চেন্নাইতে নিজের জন্মদিন আর কোনোদিনই পালন করেননি।
প্রায় ১৫০টি ছবিতে অভিনয় করে অর্জন করেছেন নানান সম্মানজনক অ্যাওয়ার্ড। তার ক্যারিয়ারের উল্লেখযোগ্য কয়েকটি মুভির নাম হলো ‘মুল্লুম মালারুম’, ‘মুন্ড্রু মুগাম’, ‘মুথু’, ‘পাডায়াপ্পা’, ‘চন্দ্রমুখী’, ‘শিবাজী’, ‘এনিথিরান’ প্রভৃতি। অভিনয়ের পাশাপাশি তিনি একজন স্বেচ্ছাসেবী, উৎসাহদাতা এবং রাজনীতিতে সেবা দানকারী। তার স্ত্রী লতা রাঙ্গাচড়ি এবং তাদের দুই সন্তান।
রজনীর জনপ্রিয়তা এতই তুঙ্গে যে, তিনি প্রথম যখন টুইটারে আসেন, প্রথম দিনেই তার ফলোয়ার সংখ্যা আড়াই লাখ ছাড়িয়ে যায়।রজনীকান্তকে তার কোটি কোটি ভক্ত যেমন দেবতার মতো গণ্য করে; ঠিক তেমনি তার অনেক সমালোচকও রয়েছেন। এরপরও বলা চলে ৬৬ বছর বয়সেও তিনি যতটা জনপ্রিয় এবং বিনোদনের কেন্দ্র, তা ভারতীয় উপমহাদেশ তো বটেই, সারা পৃথিবীর ইতিহাসেও বিরল।