শহীদের রক্তে বেঈমানী- উপদেষ্টা নিয়োগে স্বজনপ্রীতি
শফিক রহমান : এই সেই সোহান শাহ হত্যা মামলায় অভিযুক্ত ‘শেখ বশির উদ্দিন ভূঁইয়া’। মাগুরার শ্রীপুর উপজেলার সন্তান এই শাহান শাহ (২৯)।এই নামের সঙ্গে মিল রয়েছে নিয়োগপ্রাপ্ত এক শিল্পপতি উপদেষ্টার। শুধু ‘ভূঁইয়া’ ছাড়া বাকি নাম ঠিকানা বাবা-মায়ের নাম সব মিলে যাচ্ছে উপদেষ্টা শেখ বশির উদ্দিনের সঙ্গে। উপদেষ্টা নিয়োগের ধরন দেখে অবস্থা দৃষ্টে মনে হচ্ছে দেশে ভালো মানুষ এর অভাব রয়ে গেছে। উপদেষ্টা নিয়োগে স্বজনপ্রীতির প্রকাশ্য অভিযোগ করেছেন বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক সারজিস আলম। তিনি সামাজিক মাধ্যমে অভিযোগ করে লিখেছেন, ‘খুনি হাসিনার তেলবাজরাও উপদেষ্টা হচ্ছে।’ উপদেষ্টা নিয়োগে স্বজনপ্রীতির নানা অভিযোগে এর প্রতিবাদে বিক্ষোভ মিছিল ও শিক্ষার্থীদের মানববন্ধনের ঘোষণা দিয়েছেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের আহ্বায়ক হাসনাত আবদুল্লাহ।
জানা গেছে, অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা হিসেবে রবিবার শপথ নিয়েছেন আরও তিনজন। এতে প্রধান উপদেষ্টাসহ অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের উপদেষ্টাদের বর্তমান সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ২৪ জনে। এই ২৪ জনের মধ্যে ১৪ জনের বাড়িই চট্টগ্রাম বিভাগে। ঢাকা বিভাগের রয়েছেন ৫ জন। এছাড়া একজন রাজশাহী, একজন বরিশাল, একজন যশোর, একজন সুনামগঞ্জ জেলার উপদেষ্টা রয়েছেন। একজনের জন্ম কলকাতায়। উপদেষ্টা পরিষদে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের জন্মস্থান চট্টগ্রামের হাটহাজারী উপজেলায়। তিনি মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ, প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়, সশস্ত্র বাহিনী বিভাগ, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে আছেন।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সময় আন্দোলনে এই সেই সোহান শাহ রামপুরা এলাকায় প্রবল প্রতিরোধ গড়ে করেছিলেন পলাতক হাসিনা সরকারের বিরুদ্ধে। এখানেই সবচেয়ে বেশী গুলির ঘটনা ঘটে। দীর্ঘ ৩৯ দিন বুকে বুলেট নিয়ে অবশেষে না ফেরার দেশে পাড়ি জমিয়েছেন তিনি।
২৯ আগস্ট বিকেলে শ্রীপুর সদরে আলতাফ হোসেন মহিলা কলেজ রোডে শোহানদের গ্রামের বাড়িতে গিয়েছিলেন দৈনিক সত্যকথা প্রতিদিন প্রতিনিধি। তিনি সেখানে গিয়ে দেখেন তার বাড়িতে মাতম চলছে। বারবার মূর্ছা যাচ্ছেন শোহানের মা। অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন বাবা। শোহানের স্ত্রীর বিলাপ কিছুতেই থামছে না।
শোহানের স্ত্রী শম্পা বেগম বলেন, তাদের বিয়ে হয়েছিল ২০১৭ সালের ১৯ নভেম্বর। এরপর মধ্যে তিন বছর দুজন একসঙ্গে ঢাকায় সংসার পেতেছিলেন। বাকি সময় স্ত্রীকে গ্রামে পরিবারের সঙ্গে রেখে ঢাকায় চাকরি করেছেন শোহান। আমাদের মধ্যবিত্ত পরিবার। অর্থসংকটের কারণে ও একা ঢাকায় থাকত। অর্থের কারণে দুজন একসঙ্গেও থাকতে পারিনি। গত এক বছর বাড়িতে একটা নতুন ঘর দিচ্ছিল। সে আমাকে বলেছিল, শম্পা, আমি আর তুমি এই ঘরে থাকব।
ঢাকায় সিএমএইচে শোহান শম্পাকে বলেছিলেন, তুমি কেঁদো না। আমার কিছুই হবে না। তবে শোহান আর ফেরেননি। অস্ত্রোপচার করে শরীর থেকে বুলেট বের করা গেলেও রক্ত বন্ধ করা যায়নি। ১৮ ব্যাগ রক্ত দিয়েও বাঁচানো যায়নি শোহানকে। সংসারে অভাব থাকলেও ভালোবাসার কমতি ছিল না। স্বামী ছাড়া কেউ ছিল না আমার। সে সবসময় সব ধরনের পরিস্থিতিতে আমার পাশে থেকেছে। সে বলত, চিন্তা করো না, আমি তোমার পাশে আছি। আল্লাহ আমাকে একটা সন্তানও দেননি। আমি এখন কীভাবে বাঁচব?
শোহানের বাবা শাহ সেকেন্দার বলেন, আমার ছেলে ছোটবেলা থেকেই স্মার্ট, কর্মঠ আর দায়িত্বশী ছিল। ছোটবেলা থেকেই ইনকাম করে। বিশেষ করে বিয়ের পর একদিনও বসে থাকেনি। চাকরি না থাকলে বাড়িতে এসে রাজমিস্ত্রির কাজও করেছে। আমার পকেটখরচও সে দিত। যেদিন মারা গেল সেদিন সকালেও বিকাশে আমাকে এক হাজার টাকা পাঠিয়ে বলল, এই টাকাটা তুলে চলে আসেন।
ছেলে হারানোর শোকে বিলাপ করতে করতে শোহানের মা সুফিয়া বেগম বলেন, আমার ছেলে আমার মনের কথা বুঝত। কোনো কথা লুকালে ও বুঝে ফেলত। টাকা পাঠিয়ে বলত, মা তুমি আঁচলে গুঁজে রেখো না, যা লাগে কিনে খাও আমি আছি তো। আমার ইনকাম না খেয়ে তোমাদের মরতে দেব না। সুফিয়া বেগম বলেন, এখন এই কথা আমাকে কে বলবে? সবাই আছে শুধু আমার ছেলে নেই।
জানা গেছে, মাগুরার শ্রীপুর ডিগ্রি কলেজ থেকে উচ্চমাধ্যমিক শেষ করে প্রায় ১০ বছর আগে সংসারের হাল ধরতে চাকরিতে যান শোহান। সবশেষ ঢাকার রামপুরা এলাকায় একটি পোশাক কারখানায় মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে কাজ করছিলেন তিনি। তার বাবা শাহ সেকেন্দার এক দশকের বেশি সময় আগে নিজের ব্যবসা গুটিয়ে বেকার হয়ে পড়েন। তার একমাত্র ছোট ভাই অষ্টম শ্রেণিতে পড়ে। মা-বাবা, স্ত্রী ও স্কুলছাত্র ছোট ভাইয়ের সব খরচের জোগান আসত একজনের বেতন থেকেই। অর্থ সাশ্রয়ের জন্য স্ত্রীকে বাড়িতে মা-বাবার কাছে রেখে ঢাকায় মেসে থেকে চাকরি করছিলেন তিনি। গ্রামের বাড়িতে নতুন ঘর নির্মাণ করা হচ্ছিল। যেখানে স্ত্রীর সঙ্গে সুখের সংসার পাততে চেয়েছিলেন শোহান। তবে তাদের সেই স্বপ্ন আর পূর্ণ হলো না। গত ১৯ জুলাই ঢাকার রামপুরা এলাকায় গুলিবিদ্ধ হন শোহান।
এ ঘটনায় সোহান শাহর মা সুফিয়া বেগম ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট (সিএমএম) আদালতে একটি নালিশি মামলা করেন। আদালতের নির্দেশে সেই মামলা রামপুরা থানায় রেকর্ড করা হয়। রামপুরা থানায় দায়ের হওয়া এ মামলা সূত্রে জানা যায়, মামলায় হত্যার মূল পরিকল্পনাকারী ও বাস্তবায়নকারী হিসেবে মাগুরা-১ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য সাইফুজ্জামান শিখরের নাম উল্লেখ করা হয়েছে। মামলায় আসামি করা হয়েছে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ আওয়ামী লীগের আরও অনেক হেভিওয়েট নেতাকে।এই মামলায় আসামি করা হয় ‘শেখ বশির উদ্দিন ভূঁইয়া’ নামে এক ব্যক্তিকে। এ নাম অনেকাংশে মিলে যায় অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা হওয়া ব্যবসায়ী সেখ বশির উদ্দিনের সঙ্গে। নতুন এই উপদেষ্টা শপথ নেওয়ার পর থেকে তিনি সোহান হত্যা মামলার আসামি কি না তা নিয়ে নানা মহলে আলোচনা চলছে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, নামের আংশিক মিল থাকলেও উপদেষ্টা সেখ বশির উদ্দিন ও মামলার তালিকায় থাকা শেখ বশির উদ্দিন ভূঁইয়া একই ব্যক্তি কি না তা এখনো নিশ্চিত নয় পুলিশ। বিষয়টি নিশ্চিত হওয়ার জন্য পুলিশ তদন্ত শুরু করেছে।এ বিষয়ে সোমবার (১১ নভেম্বর) বিকেলে রামপুরা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আতাউর রহমান আকন্দ দৈনিক সত্যকথা প্রতিদিন কে বলেন, ‘সোহান হত্যা মামলায় শেখ বশির উদ্দিন ভূঁইয়া নামে এক আসামি রয়েছে। এই নামের সঙ্গে উপদেষ্টা সেখ বশির উদ্দিনের নাম, তার বাবার নাম ও বাসার ঠিকানার আংশিক মিল রয়েছে। তবে আসামি যে ব্যক্তিকে করা হয়েছে তার পূর্ণ নাম শেখ বশির উদ্দিন ভূঁইয়া। ভূঁইয়া অংশটি নিয়ে আমাদের সংশয় রয়েছে আসলে দুজন একই ব্যক্তি কি না। এ বিষয়ে আমাদের তদন্ত চলমান রয়েছে। তদন্ত শেষে বিষয়টি নিশ্চিত হওয়া যাবে।’
সোহান শাহ ভারগো গার্মেন্টস কারখানায় মেকানিক্যাল বিভাগের প্রকৌশলী হিসেবে চাকরি করতেন। গত ১৯ জুলাই রাজধানীর রামপুরা সিএনজি স্টেশনের সামনে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে অংশ নিয়েছিলেন সোহান শাহ। সেখানে গুলিবিদ্ধ হন তিনি। স্থানীয় সূত্র জানায়, সেদিন সন্ধ্যা ৬টার দিকে স্থানীয় আওয়ামী লীগ-ছাত্রলীগসহ অন্যরা ছাত্র-জনতার আন্দোলনে নির্বিচারে গুলি চালায়। তখন সোহান শাহসহ বেশ কয়েকজন গুলিবিদ্ধ হন। সোহান শাহকে প্রথমে স্থানীয় ফরাজী হাসপাতালে নেওয়া হয়। তখন ওই হাসপাতালের মালিক ইমন ফরাজীর নির্দেশে (মামলার ১৯ নম্বর আসামি) তাকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়নি। পরে তাকে জাতীয় বক্ষব্যাধি ইনস্টিটিউটে ভর্তি করা হয়। এরপর তার শারীরিক অবস্থার অবনতি হলে গত ২৩ আগস্ট ঢাকার সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে (সিএমএইচ) ভর্তি করা হয়। সেখানেই পরদিন ২৪ আগস্ট তিনি মারা যান।