• বুধবার , ২৫ ডিসেম্বর ২০২৪

শরীর দিয়ে পড়ার খরচা যোগাচ্ছে কিশোরীরা


প্রকাশিত: ৪:৫২ এএম, ২৩ এপ্রিল ১৬ , শনিবার

নিউজটি পড়া হয়েছে ৭৯ বার

ফ্রিটাউন (সিয়েরা লিয়ন) থেকে তমা মালনী    :   একচিলতে স্বপ্ন ওদের—পড়াশোনা শেখার। ওদের rape-www.jatirkhantha.com.bdবিশ্বাস, শিক্ষার জোরেই দাঁড়াবে নিজের পায়ে, পাল্টাবে নিজেদের অবস্থা। তবে সেই স্বপ্নপূরণের খরচা যোগানোর সাধ্য নেই ওদের পরিবারের। বাধ্য হয়ে নিজেদের কিশোরী শরীর বিকিয়ে ওরা কিনছে স্বপ্ন। যোগাচ্ছে পড়ার খরচা। তবে পথটা বড়ই পিচ্ছিল। স্কুলে ভর্তি হয়েও পড়া আর শেষ করা হচ্ছে না! অপরিণত বয়সে গর্ভবতী হয়ে ছাড়তে হচ্ছে স্কুল, বন্ধ হয়ে যাচ্ছে সাধের লেখাপড়া।

ওরা কারা? ওরা দুর্ভিক্ষ পীড়িত সিয়েরা লিয়নের কিশোরী মেয়েরা। যেমন, আমিনাতা (১৫), মারি (১৪) আর আদামা (১৩)। ওদের মতোই বাস্তবের কঠিন পাকেচক্রে আটকা পড়েছে আরও অনেক কিশোরী।

পশ্চিম আফ্রিকার সিয়েরা লিয়ন পৃথিবীর দরিদ্রতম দেশগুলির একটি। রাজধানী ফ্রিটাউনের বাইরে ঘুপচি বস্তিতে বেড়ে ওঠা এই কিশোরীদের কাছে পড়াশোনা শেখা বিলাসিতারই নামান্তর। পড়ার খরচা ৪০ ইউরো (প্রায় তিন হাজার টাকা)। কিন্তু দিন- আনি–দিন-খাই এই সব পরিবারে সে খরচার ভার বইতে পারা সাধ্যের বাইরে।

তাই পরিবার যখন হাত তুলে নিল, কিশোরী আমিনাতার কাছে খোলা ছিল একটাই পথ—বেশ্যাবৃত্তি। এক রাতে তিন খদ্দের। তাতে‌ আমিনাতার হাতে আসে ৯ ইউরো (৬৭৬ টাকা)। এই টাকাতে নিজের খাওয়া-পরা ছাড়াও স্কুলের ইউনিফর্ম, মাইনে ও বইও কিনত আমিনাতা। কেউ জানত না কী ভাবে আসে এই টাকা! আমিনাতাও স্কুলে কাউকে বলেনি। তবে শেষমেশ জানাজানি হল। গর্ভবতী হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই স্কুলের পাঠ চুকল আমিনাতার।

একই রকম ভাগ্য মারিরও। বাবা-মায়ের বিবাহবিচ্ছেদের পরে, রাস্তায় জিনিস বিক্রি করে মা-বোনের মুখে খাবার তুলে দিত সে। মারির স্বপ্ন ছিল আইনজীবী হওয়ার। যে কোনও মূল্যে! একটি সংবাদ সংস্থাকে দেওয়া সাক্ষাত্কারে মারি জানিয়েছে, ‘‘আমি কিন্তু বোকা নই। বুনিয়াদী শিক্ষার পরীক্ষায় আমি ক্লাসে প্রথম হয়েছিলাম। তবে পড়াশোনা চালিয়ে যেতে বাবার সাহায্য পাইনি। স্কুল ছেড়ে দিতে হয়েছিল। কী করতাম আমি তখন?’’

মেধাবী ছাত্রীর সাহায্যে তখন এগিয়ে এসেছিল বছর পঁচিশের এক যুবক। শর্ত, মারি শয্যাসঙ্গী হলে তবেই তার পড়াশোনার খরচ দেবে সে। কিছু না ভেবেই তাই রাজী হয়ে যায় মারি। চলতে থাকে পড়াশোনা। তবে স্বপ্ন ভাঙতে বেশি সময় লাগেনি। মারি গর্ভবতী হতেই নিমেষে অদৃশ্য হয়ে গেল সেই যুবক। স্কুলের দরজা ছেড়ে নিজের ঘরের নানা কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ল মারি।

সঙ্গে শিশুপুত্রের দেখভাল। আর এ সব কাজ মিটলে অশীতিপর বৃদ্ধা ঠাকুমাকে কেক বানাতে সাহায্য করা। ছেলেকে কোলে নিয়ে একচিলতে খুপরি ঘরের চৌকাঠে বসে তুখোড় ইংরেজিতে মারি বলছিল সে সব কথা। ঘরে আসবাবপত্র নেই বললেই চলে, জানলাগুলো ম্যাগাজিন দিয়ে ঢাকা। মেয়েটার চোখে এখনও জেদ। স্বপ্ন সত্যি করার জেদ!

মারি যদি ভুলেছিল আইনজীবী হওয়ার ‘মোহে’, আদামা ভুলেছিল খাবারের লোভে। চুক্তি একই। দশ বছর বয়সে মা হারিয়ে ছোট্ট আদামা আশ্রয় নিয়েছিল এক আত্মীয়ার বাড়িতে। আশা ছিল, তারা মেয়েকে পড়াশোনা শেখাবে। তবে স্কুলে যাওয়ার জন্য আদামাকে হতে হলো সেই বাড়ির পরিচারিকা। এর পরে আদামার ওই আত্মীয়া চাপিয়ে দিল আরও কঠিন শর্ত।

রাত দু’টোয় উঠে হেঁটে তাকে যেতে হত ফ্রিটাউন। মাথায় থাকত জিনিসের ঝুড়ি। মদ্যপ, দালাল, ড্রাগ-পাচারকারীদের নজর এড়িয়ে নিশুতি রাতে ছোট্ট মেয়ে একলা বেরিয়ে পড়ত। দু’ঘণ্টা পরে সে পৌঁছত গন্তব্যে। হাড়-ভাঙা এই খাটনির পরে স্বাভাবিক ভাবেই স্কুলে যাওয়াও কঠিন হয়ে পড়ল। প্রথমে সপ্তাহে এক দিন। শেষে দাঁড়ালো দু’সপ্তাহে এক দিন। যদি রোজের এই ক্লান্তির পথ সে না পেরোত, তবে দানা-পানিও জুটবে না জানিয়ে দিয়েছিলেন আদামার ওই আত্মীয়া।

এমন সময়ে ক্ষুধার্ত, ক্লান্ত ভীত আদামার জীবনে এল এক ব্যক্তি। শর্ত তারও ছিল। তবে রোজকার ক্লান্তিকর পথচলার থেকে সহজ মনে হল সেই জীবন: শরীরের বিনিময়ে খাবার। তবে আদামা গর্ভবতী হতেই হাওয়া হয়ে গেল সেই ‘মসিহাও’। বন্ধ হলো টাকার পথ।

এমন সব মেয়েদের দিকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিতেই সম্প্রতি একটি প্রকল্পের উদ্বোধন করল সিয়েরা লিয়নের স্ট্রিট চাইল্ড সংস্থা। প্রকল্পের নাম ‘গার্লস স্পিক আউট’। উদ্দেশ্য, এই সব মেয়েকে বোঝানো যে বাচ্চা হওয়া মানেই স্কুলের দরজা বন্ধ নয়। এদের মতোই ৫০০ গর্ভবতী কিশোরীদের স্কুলে ফেরানোই হল ওই প্রকল্পের লক্ষ্য। স্কুলে না হলেও কোনও বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে। স্ট্রিট চাইল্ডের সিইও টম ডানান্টের কথায়, ‘‘পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়া মানে একটা মেয়ের আয়ের পথ প্রশস্ত করা। আর শিক্ষিত হলেই পরিবার-পরিকল্পনা ও শিশু প্রতিপালনের ক্ষেত্রে তারা বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দেখাবে। এই মেয়েদের সাহায্য করা মানে আখেরে সামগ্রিক ভাবে পুরো দেশের উন্নতি করা।’’

আদামা এখন পাঁচ মাসের গর্ভবতী। আমিনাতা সাত মাসের। আর মারি শিশুপুত্রকে বড় করতে ব্যস্ত। তবে ওরা তিন জনেই ফিরতে চায় স্কুলে। স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার সাহায্যে আবার পাড়ি দিতে চায় স্বপ্নের উড়ানে।