লাকি থার্টিনের অপেক্ষা’য় ইউনূস-তারেক বৈঠক
অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস ও বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান এর বহুল আলোচিত রাজনৈতিক বৈঠক আগামী ১৩ জুন শুক্রবার অনুষ্ঠিত হচ্ছে। বৈঠকে লাকি থার্টিনের অপেক্ষায় আছে বিএনপি।
শফিক রহমান : প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস ও বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান এর বহুল আলোচিত রাজনৈতিক বৈঠক আগামী ১৩ জুন শুক্রবার অনুষ্ঠিত হচ্ছে। বৈঠকে লাকি থার্টিনের অপেক্ষায় আছে বিএনপি। যদিও আনলাকির সম্ভবনাও ঘুরপাক খাচ্ছে! তবে বৈঠকে ভাল কিছু হবে এমনটাই আশা করছেন পোড়খাওয়া রাজনৈতিক নের্তৃবৃন্দ।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, এই বৈঠক জাতীয় নির্বাচনের সময়সূচি নিয়ে সরকার ও দলের মধ্যে বিদ্যমান দূরত্ব ও নানা ধরনের চ্যালেঞ্জ কমাতে সাহায্য করবে। বিএনপি নেতারা বৈঠকটি নিয়ে অনেক আশবাদী। তাঁরা বলছেন, আলোচনায় নির্বাচন নিয়ে চলমান অচলাবস্থা কাটিয়ে ওঠা সম্ভব। এক্ষেত্রে দুই নেতা কতটুকু ছাড় দেবেন সেটাই এখন দেখার বিষয়।
সোমবার যুক্তরাজ্যে যাওয়ার আগে, গত শুক্রবার জাতির উদ্দেশ্যে ঈদুল আজহার ভাষণে ড. ইউনূস বলেন, প্রয়োজনীয় সংস্কারের পর আগামী বছরের এপ্রিলের প্রথমার্ধে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। অথচ বিএনপি এই বছরের ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠানের দাবিতে অনড়। এমন অবস্থায় প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস ও বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান এর বৈঠক দেশের জন্যে মহা গুরুত্বপূর্ণ। কারণ অনেকগুলো সংস্কার কাজসহ স্বৈরাচারের বিচার এখনও চলমান রয়েছে । কোনোটাই নির্দিষ্ট লক্ষে পৌছেনি।
এর আগে গতকাল গুলশানে বিএনপি চেয়ারপারসনের কার্যালয়ে সাংবাদিকদের সাথে আলাপকালে দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, ড. ইউনূস যুক্তরাজ্য সফরের সময় দ্য ডরচেস্টারে হোটেলে অবস্থান করছেন। সেখানেই সকাল ৯টা থেকে ১১টা পর্যন্ত (লন্ডন সময়) বৈঠকটি অনুষ্ঠিত হবে বলে আশা করা হচ্ছে।
মির্জা ফখরুল বলেন, প্রধান উপদেষ্টা আমাদের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানকে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন। আমরা আশা করি এই বৈঠক বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে চলমান চ্যালেঞ্জগুলো নিরসনে ইতিবাচক ভূমিকা পালন করবে।’
বৈঠক ১৩ জুন-
সাম্প্রতিক রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে তিনি বলেন, যদি সবকিছু পরিকল্পনা অনুযায়ী চলে তবে এই বৈঠক দেশের রাজনীতিতে একটি ‘টার্নিং পয়েন্ট’ হিসেবে প্রমাণিত হতে পারে।
মির্জা ফখরুল বলেন, ‘এই বৈঠকটি বর্তমানে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা এবং জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে এটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এই বৈঠকের মাধ্যমে অনেক সমস্যার সমাধান হতে পারে এবং নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হতে পারে।’
গতকাল রাতে লন্ডনে সাংবাদিকদের সাথে কথা বলার সময় প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম নিশ্চিত শুক্রবার সকালে এই বৈঠক অনুষ্ঠিত হবে। যেহেতু তারেক রহমান বর্তমানে বাংলাদেশের বৃহত্তম রাজনৈতিক দলের নেতা এবং অধ্যাপক ইউনূস অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান, তাই তারা আলোচনার জন্য বৈঠক করবেন।
শফিকুল আলম জানান, বৈঠকের ধরন এখনো ঠিক হয়নি। বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি, যার মধ্যে ঘোষিত নির্বাচনের সময়সূচি, জুলাই সনদ, সংস্কার এবং অন্যান্য প্রাসঙ্গিক বিষয় আলোচনায় আসতে পারে।শফিকুল আরও বলেন, নির্দিষ্ট আলোচ্যসূচি ‘তারাই’ ঠিক করবেন।প্রধান উপদেষ্টার যুক্তরাজ্য সফরের ঘোষণা আসার পর থেকেই ইউনূস ও তারেকের সম্ভাব্য বৈঠক নিয়ে জল্পনা বাড়তে থাকে, যদিও বৈঠকটি তার (ড. ইউনূসের) অফিসিয়াল কার্যক্রমে অন্তর্ভুক্ত ছিল না।দলীয় সূত্র জানিয়েছে, তারেক হয়তো ইউনূসকে নির্বাচনের তারিখ এগিয়ে আনার জন্য অনুরোধ করতে পারেন। তাদের যুক্তি হলো, এপ্রিল মাস নির্বাচনী প্রচারণার জন্য উপযুক্ত নয়, কারণ রোজা মার্চের মাঝামাঝি সময়ে শেষ হবে।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ দৈনিক সত্যকথা প্রতিদিন কে বলেন, দেশের বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনার পাশাপাশি রাজনৈতিক আলোচনা অবশ্যই হবে। আমরা আশা করি প্রধান উপদেষ্টা তার [নির্বাচনের তারিখ সম্পর্কিত] সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনা করবেন এবং দেশের সামগ্রিক পরিস্থিতি এবং বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়েও আলোচনা করবেন।তিনি বলেন, ‘নির্বাচনের জন্য উপযুক্ত সময় নির্ধারণের সময় প্রধান উপদেষ্টা আবহাওয়া, রমজান এবং পাবলিক পরীক্ষার মতো বিষয়গুলো বিবেচনা করতে পারেন। এছাড়াও, জাতীয় নিরাপত্তা, রাজনীতি এবং বৃহত্তর জাতীয় প্রেক্ষাপট সম্পর্কিত আরও অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় আলোচনা করা হবে।
সরকারের নিরপেক্ষতা নিশ্চিত করার জন্য বিএনপির কিছু পর্যবেক্ষণ ও প্রস্তাবও রয়েছে বলে তিনি জানান। বিএনপির আরেক সিনিয়র নেতা আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেন, এটি গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার, গ্রহণযোগ্য ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠান এবং একটি সুষ্ঠু রাজনৈতিক পরিবেশ ফিরিয়ে আনার একটি সুযোগ।বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্যরা তারেক রহমানের সঙ্গে প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর ইউনূসের সম্ভাব্য বৈঠককে স্বাগত জানিয়েছেন এবং তারেককে দলের পক্ষে আলোচনা চালিয়ে যাওয়ার পূর্ণ ক্ষমতা দিয়েছেন।
ঈদের শুভেচ্ছা বিনিময়ের এক বৈঠকে তারা চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে নির্বাচনের সময়সূচি ঘোষণা সম্পর্কে অবহিত করেছেন।সূত্র মতে, খালেদা জিয়া তাদের বলেছেন, ‘বিতর্ক নয়, নির্বাচন প্রয়োজন। সংঘর্ষ এড়িয়ে চলাই ভালো। বিএনপির একজন স্থায়ী কমিটির সদস্য এই বক্তব্যকে দলের জন্য একটি বার্তা হিসেবে ব্যাখ্যা করেন— তীব্র সংঘাতে না গিয়ে আলোচনার পথ খোলা রাখা উচিত।রোববার রাতে পরবর্তী বৈঠকে সিনিয়র নেতারা তারেক রহমানকে সাম্প্রতিক রাজনৈতিক অগ্রগতি সম্পর্কে ব্রিফ করেন, যার মধ্যে ছিল সংস্কার প্রস্তাব, সরকারের উপদেষ্টাদের ভূমিকা এবং স্থানীয় সরকার নির্বাচনের হালনাগাদ তথ্য।
স্থায়ী কমিটি তাদের অবস্থান পুনর্ব্যক্ত করেছে যে জাতীয় নির্বাচন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের অধীনেই অনুষ্ঠিত হতে হবে, তবে তা রমজানের আগেই।রাজনৈতিক বিশ্লেষকরাও এই বৈঠককে ইতিবাচক অগ্রগতি হিসেবে দেখছেন। তাদের মতে, সরাসরি আলাপচারিতা বিএনপি ও অন্তর্বর্তী সরকারের মধ্যে আস্থার ঘাটতি কমাতে পারে এবং ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন চেয়ে বিএনপির কঠোর অবস্থানকে কিছুটা নমনীয় করতেও সহায়ক হতে পারে।
তারেক রহমান এবং মুহাম্মদ ইউনূসের মধ্যকার বৈঠককে ‘অত্যন্ত ইতিবাচক পদক্ষেপ’ আখ্যা দেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সরকার ও রাজনীতি বিভাগের সাবেক শিক্ষক অধ্যাপক দিলারা চৌধুরী। তিনি বলেন, ‘এই বৈঠক ভুল বোঝাবুঝি নিরসন, রাজনৈতিক ঐকমত্য প্রতিষ্ঠা এবং উত্তেজনা প্রশমনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে,’ তিনি বলেন। তাছাড়া এটি আলোচনার জন্য একটি পথ খুলে দিতে পারে এবং রাজনৈতিক দৃশ্যপট পুনর্গঠন করতে পারে।তার মতে, এই বৈঠকের মাধ্যমে এমন ধারণার অবসান ঘটবে যে প্রধান উপদেষ্টা ইউনূস অন্তর্বর্তীকালীন সময়ের পরও ক্ষমতায় থেকে যেতে চান।
প্রধান উপদেষ্টা নিজের অবস্থান পরিষ্কার করার সুযোগ পাচ্ছেন। এটি রাজনৈতিক পরিপক্বতার একটি মুহূর্ত, বলেন দিলারা।তিনি আরও বলেন, বিএনপির ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠানের দাবি কিছুটা নমনীয় হতে পারে, যেহেতু ইউনূস সরাসরি বিএনপির সঙ্গে আলোচনায় বসছেন।
এটাই ইতিবাচক রাজনৈতিক সংস্কৃতির নিদর্শন, বলেন তিনি।রাজনৈতিক বিশ্লেষক আল মাসুদ হাসানুজ্জামান বলেন, এতদিন বিএনপি ও সরকারের মধ্যে যোগাযোগের বেশিরভাগই হয়েছিল শীর্ষ নেতৃত্বের সরাসরি অংশগ্রহণ ছাড়াই।এই বৈঠকটি হচ্ছে রাজনৈতিক সংকটের পর বিএনপির শীর্ষ নেতা ও সরকারের প্রধানের মধ্যে প্রথম সরাসরি সংযোগ। যদি এর ফলে কোনো সমঝোতা হয়, তার প্রভাব হবে ব্যাপক।
তারেক রহমান, বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার বড় ছেলে, ২০০৮ সালের জরুরি অবস্থার সময় কারাগার থেকে মুক্তি পেয়ে লন্ডনে যান এবং তখন থেকেই সেখানে অবস্থান করছেন।আওয়ামী লীগ শাসনামলে, তার অনুপস্থিতিতে পাঁচটি মামলায় দণ্ডপ্রাপ্ত হন এবং তার বিরুদ্ধে শতাধিক মামলা দায়ের হয়।তবে, ২০২৪ সালের জুলাইয়ে গণঅভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর, তারেক রহমান যে সমস্ত মামলায় সাজা পেয়েছিলেন সেগুলো থেকে খালাস পেয়েছেন।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির বৈঠকে-
সোমবার রাতে বিএনপির স্থায়ী কমিটির বৈঠকে ভার্চুয়ালি যোগ দেন দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। সেখানেই প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে বৈঠকে বসার সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত হয়। দলীয় সূত্র জানায়, বিএনপি প্রাথমিকভাবে এই ধরনের বৈঠকে আগ্রহী ছিল না। প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয় থেকে অনানুষ্ঠানিক যোগাযোগের পরেও ডিসেম্বরে নির্বাচনের দাবির বিষয়ে সরকারের গুরুত্বের অভাব নিয়ে সিনিয়র নেতাদের মধ্যে অস্বস্তি ছিল। পরে নির্বাচনের সময়সূচি আলোচনায় আসবে—এই প্রত্যাশায় বিএনপি বৈঠকে সম্মত হয়। সালাহউদ্দিন আহমেদ দৈনিক সত্যকথা প্রতিদিন কে বলেন, প্রধান উপদেষ্টার ইউকে সফর যখন ফিক্সড হয়েছে, তারপর থেকে তিনি তারেক রহমান সঙ্গে দেখা করার আগ্রহ প্রকাশ করেছেন।এটা ফ্রম দেয়ার সাইড। দিন তারিখ বা সম্মতি কোনোটাই তখনো পর্যন্ত ঠিক হয় নাই।
সালাহউদ্দিন বলেন, এক পর্যায়ে যখন প্রধান উপদেষ্টা ভাষণ দিলেন ৬ জুন ঈদ উপলক্ষে এবং সেখানে নির্বাচনের একটা সময়সীমা দিলেন। তখন থেকে পরিস্থিতিটা এরকম হয়ে গেল যে হয়তো দেখা সাক্ষাতের বিষয়টা অনেকটা অনিশ্চিত হয়ে গেল।কিন্তু প্রধান উপদেষ্টার সাথে অফিস থেকে গিয়ে তারপরেও যোগাযোগ অব্যাহত রাখা হয়। এই প্রেক্ষিতে আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম যে রাজনৈতিক শিষ্টাচার হচ্ছে সৌজন্য সাক্ষাৎকার করা। এটা অবশ্যই করতে হবে,’ যোগ করেন তিনি।