• শুক্রবার , ২৭ ডিসেম্বর ২০২৪

র‍্যাবের কব্জায় জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়ার ৪ নেতার দুধর্ষ জঙ্গিপনা


প্রকাশিত: ৩:০৫ এএম, ১০ মে ২৩ , বুধবার

নিউজটি পড়া হয়েছে ৭২ বার

সিলেট প্রতিনিধি : সিলেট থেকে দুর্ধর্ষ চার জঙ্গিকে গ্রেপ্তারের পর র‍্যাবের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, এরা সবাই পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ের বিচ্ছিন্নতাবাদীদের কাছ থেকে প্রশিক্ষণ নিয়েছিলেন। দীর্ঘদিন ধরেই এই চারজন দেশের বিভিন্নস্থানে জঙ্গি তৎপরতার সঙ্গে জড়িত। এর আগেও তারা একাধিকবার ধরা পড়ে জেল খেটেছেন। তাদের রয়েছে বিভিন্ন ধরণের অস্ত্র চালনা, বোমা তৈরিসহ সশস্ত্র নানা প্রশিক্ষণ।

‘জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়া’ নামের অপেক্ষাকৃত নতুন এক জঙ্গি সংগঠনে যুক্ত হয়ে সিলেটে আস্তানা গেড়ে বিভিন্নভাবে সংগঠিত হওয়ার চেষ্টা করছিলেন তারা। এয়ারপোর্টের বড়শালা এলাকায় সোমবার রাতভর অভিযান চালিয়ে র‍্যাব-৯ এর একটি দল ভয়ঙ্কর এই চার জঙ্গিকে ধরে ফেলে। তাদের কাছ থেকে নগদ দুই লাখ টাকা, ইলেকট্রনিক ডিভাইসসহ গুরুত্বপূর্ণ নথি উদ্ধার করা হয়।

এই চার জঙ্গির মধ্যে রয়েছেন- সংগঠনের দাওয়াতি শাখার প্রধান সিলেটের আব্দুল্লাহ মায়মুন (৩৪), ফরিদপুরের মোঃ আবু জাফর ওরফে জাফর তাহান (৪০), চাঁদপুরের মোঃ আক্তার কাজী ওরফে সাইন ওরফে আইজল (৩৮) এবং গোপালগঞ্জের সালাউদ্দিন রাজ্জাক মোল্লা (৩২) ।

র‍্যাবের মিডিয়া শাখার পরিচালক খন্দকার আল মঈন বলেছেন, গত বছরের ২৩ অগাস্ট কুমিল্লা সদর থেকে নিখোঁজ আট তরুণের সন্ধানে নেমেই নতুন এই জঙ্গি দলের সক্রিয় থাকার কথা জানতে পারে র‍্যাব। জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়ার সঙ্গে পার্বত্য চট্টগ্রামের বিচ্ছিন্নতাবাদী কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট বা কেএনএফের গভীর যোগাযোগ রয়েছে। কেএনএফ থেকেই প্রশিক্ষণ নিয়ে দেশের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ছে জামাতুল আনসারের সদস্যরা।

কেএনএফ- জামাতুল আনসার দোস্তি

র‍্যাবের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, গত বছর দেশের বিভিন্ন স্থানে ও পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ি এলাকায় অভিযান চালিয়ে নতুন এই জঙ্গি সংগঠনের ৬৮ জন এবং কেএনএফের ১৭ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। উদ্ধার করা হয় বিপুল পরিমাণ দেশি-বিদেশী অস্ত্র, গোলাবারুদ ও উগ্রবাদী বই। এছাড়াও উদ্ধার করা হয় সংগঠন সম্পর্কিত গুরুত্বপূর্ণ ভিডিও কন্টেন্ট। নতুন জঙ্গি সংগঠন জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়ার আমীর আনিসুর রহমান ওরফে মাহমুদ, দাওয়াতি কার্যক্রমের প্রধান গ্রেফতারকৃত আব্দুল্লাহ মায়মুন, সংগঠনের উপদেষ্টা শামীম মাহফুজ, অর্থ ও গণমাধ্যম শাখার প্রধান রাকিব।

র‌্যাব বিভিন্ন সময়ে সংগঠনের সামরিক শাখার প্রধান রনবীর ও সামরিক শাখার উপপ্রধান মানিক, অর্থ বিষয়ক প্রধান সমন্বয়ক মুনতাছির, দাওয়াতি ও অন্যতম অর্থ সরবরাহকারী হাবিবুল্লাহ, বোমা বিশেষজ্ঞ বাশার ও পার্বত্য অঞ্চলের প্রশিক্ষণ কমান্ডার দিদার হোসেন ওরফে চম্পাইকে গ্রেপ্তার করেছে।

সংগঠনের আমীর আনিসুর রহমান ওরফে মাহমুদের সঙ্গে কেএনএফ এর প্রধান নাথাম বমের সুসম্পর্ক থাকায় কেএনএফের সঙ্গে তাদের অর্থের বিনিময়ে চুক্তি হয়। এজন্য কেএনএফ জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়ার জঙ্গিদের পাহাড়ে আশ্রয়, অস্ত্র ও রশদ সরবরাহ এবং সশস্ত্র প্রশিক্ষণ প্রদান করত। র‍্যাবের অব্যাহত অভিযানের ফলে জঙ্গিরা পাহাড় থেকে পালিয়ে সমতলের বিভিন্ন জায়গায় আত্মগোপনে যায় এবং পুনরায় সংগঠিত হওয়ার চেষ্টা করছে।

৪ জঙ্গি’র গোপন মিশন

আব্দুল্লাহ মায়মুন ওরফে মামুন সিলেটের স্থানীয় একটি মাদ্রাসা থেকে দাখিল পাশ করেন। অনলাইনে ভিডিও দেখে সে উগ্রবাদে আকৃষ্ট হয়। ২০১৩ সালে সে স্থানীয় এক ব্যক্তির মাধ্যমে আনসার আল ইসলাম জঙ্গি সংগঠনে যোগ দেন।
আনসার আল ইসলামের সিলেট বিভাগীয় মাসুল বা প্রধানের দায়িত্বেও ছিল মায়মুন। আনসার আল ইসলামের শীর্ষ জঙ্গি নেতা চাকুরিচ্যুত মেজর জিয়ার সাথে তার নিয়মিত যোগাযোগ ছিল। এমনকি জঙ্গি জিয়া তার বাসায় নিয়মিত যাতায়াত করতেন।

২০১৯ সালে বগুড়ার একটি সন্ত্রাস বিরোধী মামলায় আব্দুল্লাহ মায়মুন ওরফে মামুন গ্রেপ্তার হয় এবং এক বছরের বেশি সময় কারাগারে থাকে। ২০২০ সালের শেষের দিকে জামিনে মুক্তি পায়। কিন্তু এরপর তার জামিন বাতিল হলে সে আত্মগোপনে চলে যায়। ২০২১ সালে শুরা সদস্য রনবীর ও মানিকের মাধ্যমে ‘জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়া’য় যোগ দিয়ে পাহাড়ে চলে যায়।

আনসার আল ইসলামের সিলেট বিভাগীয় মাসুল হওয়ায় সে ‘জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়া’র শুরা সদস্য ও দাওয়াতি শাখার প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পায়। এছাড়াও সে সিলেট অঞ্চলে সংগঠনটির দাওয়াতি, প্রশিক্ষণসহ সংগঠনটির সার্বিক কার্যক্রম তত্ত্বাবধান করত। সাংগঠনিক কাজে সমতল ও পাহাড়ে যাতায়াত ছিল তার।

সিলেট বিভাগের যারাই নতুন এই জঙ্গি সংগঠনে যুক্ত হয়েছে তারা প্রত্যেকেই এসেছে মায়মুনের মাধ্যমে। শুরুর দিকে তার মাধ্যমে আনসার আল ইসলাম এই জঙ্গি সংগঠনকে ১৫ লাখ টাকা অনুদান দেয়। মূলত সে আনসার আল ইসলামের সাথে জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়ার সেতু বন্ধন তৈরি করে।

এছাড়াও প্রবাসে থাকা মায়মুনের পরিচিত বিভিন্ন ব্যক্তি, সংগঠনের অর্থায়নে সে উক্ত জঙ্গি সংগঠনের জন্য প্রাথমিকভাবে প্রায় ৫০ লক্ষ টাকা সংগ্রহ করেছে।

পাহাড়ে অভিযান শুরু হলে আব্দুল্লাহ মায়মুন ওরফে মামুন ঢাকা, নারায়ণগঞ্জসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে আত্মগোপনে থেকে সাংগঠনিক কার্যক্রম পরিচালনা করছিল। সাম্প্রতিক সময় সে পরিচয় গোপন করে ভুল তথ্য দিয়ে সিলেটের বাড়িটিতে ভাড়াটিয়া হিসেবে বাস করছিল।

আত্মগোপনে থেকে সংগঠনের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ রেখে সাংগঠনিক বিভিন্ন কাজ করতে থাকে এবং আনসার আল ইসলামের সাথে সমন্বয় করে পুনরায় সংগঠিত হওয়ার চেষ্টা করে যাচ্ছিল। আবু জাফর ওরফে জাফর তাহান’কে এর আগে প্রকাশিত একটি ভিডিওতে মাথায় গামছা বাঁধা অবস্থায় দেখা যায়। আগে সে হরকাতুল জিহাদ আল-ইসলামী বাংলাদেশ বা হুজি-বি’র সদস্য ছিল।

জাফর তাহান ২০০১ সালে সুন্দরবনে হুজির সশস্ত্র প্রশিক্ষণরত অবস্থায় আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে গ্রেপ্তার হয়ে কারাভোগ করে। পরে সে জেএমবি’তে যোগ দেয়। জেএমবিতে থাকাকালীন ২০০৫ সালে আবারও আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে ধরা পড়ে জেলে যায়। ২০১৮ সালে মধ্যপ্রাচ্যের একটি দেশে চলে যায় আবু জাফর ওরফে জাফর তাহান। প্রবাসে থাকা অবস্থায় এক ব্যক্তির মাধ্যমে জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়ায় যোগ দেয়। কিছুদিন বিদেশে থেকে দেশে ফিরে এসে শুরা সদস্য রাকিবের সাথে সাক্ষাৎ করে এবং মুন্সীগঞ্জে রাকিবের খামারে থাকা শুরু করে।

পরে প্রথম ব্যাচে ১২ জনের গ্রুপের দলনেতা হিসেবে সে পার্বত্য অঞ্চলে প্রশিক্ষণের জন্য তথাকথিত হিজরত করে। পাহাড়ে বিভিন্ন ধরণের সশস্ত্র প্রশিক্ষণ নেয়। জাফর তাহান দেশে এত কিছু করে বেড়ালেও তার পরিবার জানত যে, সে মধ্যপ্রাচ্যের একটি দেশে অবস্থান করছে। পার্বত্য চট্টগ্রামে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযান শুরু হলে সে পার্বত্য চট্টগ্রামের বিভিন্ন অঞ্চলে আত্মগোপন করে থাকে এবং পরে সমতলে এসে আত্মগোপন করে। এরপর জাফর সিলেটে মায়মুনের কাছে যায়।

আবু জাফর ওরফে জাফর তাহানের বিরুদ্ধে এর আগে সন্ত্রাস বিরোধী আইনে কমপক্ষে তিনটি মামলা হয়েছে।
মোঃ আক্তার কাজী ওরফে সাইদ ওরফে আইজল নারায়ণগঞ্জে কাপড়ের ব্যবসা করত। ২০০৪ থেকে ২০০৬ সালের মধ্যে ছিনতাই ও ডাকাতির প্রায় আট থেকে ১০ টি মামলায় সে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে চাঁদপুর, সিলেট, নারায়ণগঞ্জ ও ঢাকাতে গ্রেপ্তার হয়। বেশ কয়েকবার জেলও খাটে।

২০১৭ সালে জঙ্গিবাদে জড়ায় আক্তার কাজী ওরফে সাইদ ওরফে আইজল। প্রথমে আনসার আল ইসলামের সদস্য ছিল। পরবর্তীতে জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়ায় যোগ দেয়। ২০১৮ সালে সংগঠনের আমীর মাহমুদের মাধ্যমে উদ্বুদ্ধ হয়েই এই সংগঠনে যোগ দেয় বলে ধারণা করা হয়।

মোঃ আক্তার কাজী ওরফে সাইদ ওরফে আইজল ২০২১ সালে তথাকথিত হিজরতের উদ্দেশ্যে প্রথমে কুমিল্লার একটি মাদ্রাসায় কিছুদিন থাকে। পরে সে দ্বিতীয় ব্যাচের সাথে সশস্ত্র প্রশিক্ষণের জন্য বান্দরবান ও কেটিসি হয়ে পাহাড়ের প্রশিক্ষণ ক্যাম্পে যায়।

পাহাড়ে যাওয়ার পর বিভিন্ন অস্ত্র চালনা, বোমা তৈরিসহ সশস্ত্র প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে। পরবর্তীতে পাহাড়ে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযান শুরু হলে সে প্রশিক্ষণ ক্যাম্প ছেড়ে পালিয়ে যায়। পার্বত্য ও সমতলের বিভিন্ন স্থানে আত্মগোপন করে থাকার পর সিলেটে মায়মুনের কাছে যায় সে। তার নামে বিভিন্ন থানায় একাধিক মামলা রয়েছে।

সালাউদ্দিন রাজ্জাক মোল্লা জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়ার অন্যতম সংগঠক হিসেবে দায়িত্ব পালন করত। ২০১৮ সালে তার পরিচিত এক ব্যক্তির মাধ্যমে এই জঙ্গি সংগঠনে যোগ দেয় সে।

মিরপুরে বসবাস করায় বিভিন্ন সময়ে তার বাসায় সাংগঠনিক বিভিন্ন কাজে সংগঠনের আমীর মাহমুদ, শুরা সদস্য রাকিব ও শামীম মাহফুজ আসত এবং বৈঠক করত। কারাগারে থাকা সংগঠনের বিভিন্ন সদস্যদের বার্তা তার মাধ্যমে সমতলে ও পাহাড়ে অবস্থান করা নেতাদের সঙ্গে আদান-প্রদান করা হত। সালাউদ্দিন রাজ্জাক মোল্লা ২০২২ সালে সশস্ত্র প্রশিক্ষণের উদ্দেশ্যে পাহাড়ে চলে যায়। পাহাড়ে অভিযান শুরু হলে পালিয়ে পাহাড়ি অঞ্চল ও সমতলের বিভিন্ন স্থানে আত্মগোপন করে থাকে। পরে সিলেটে মায়মুনের আস্তানায় গিয়ে জোটে।