বিরোধী দলের আন্দোলনের মধ্যে গত বছরের ৪ ডিসেম্বর তুলে নেওয়া হয় ঢাকার ৩৮ নম্বর ওয়ার্ড (তেজগাঁও এলাকা) বিএনপির সাধারণ সম্পাদক সাজেদুল ইসলাম সুমনসহ আটজনকে। কারওয়ান বাজার ও শাহীনবাগ এলাকা থেকে তাদের র্যাব-১ লেখা গাড়িতে তোলা হয়েছিল বলে দাবি স্বজনদের; তবে র্যাব বলেছে, এই আটজনকে তারা আটক করেনি।
তারপর বছরজুড়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে শুরু করে র্যাব-পুলিশে ধরনা দিয়েও কারোরই কোনো সন্ধান না পাওয়া পরিবারগুলো সম্মিলিতভাবে সংবাদ সম্মেলনে আসে।
সংবাদ সম্মেলনে সুমনের চার বছর বয়সী মেয়ে অরষার হাতে মাইক্রোফোন দিতেই সে বলে ওঠে- বাবাকে ফেরত চাই, বাবাকে ফেরত চাই, বাবাকে ফেরত চাই, আব্বুকে অনেক দিন দেখি না। আমি আমার আব্বুকে একবারের জন্য দেখতে চাই। আপনারা আমার আব্বুকে খুঁজে দিন, বলতে বলতে কেঁদে ফেলেন সুমনের নয় বছর বয়সী মেয়ে রাইসা।
সেদিন সুমনের সঙ্গে বসুন্ধরা সিটি সংলগ্ন এলাকা থেকে তুলে নেওয়া হয়েছিল জাহিদুল করিম তানভীর, আবদুল কাদের ভূঁইয়া মাসুম, মাজহারুল ইসলাম রাসেল, আসাদুজ্জামান রানা ও আল আমিনকে।সুমনের এলাকা শাহীনবাগ থেকে একই রাতে তুলে নেওয়া হয়েছিল স্বেচ্ছাসেবক দলের নেতা আদনান চৌধুরী ও কাওসার আহমেদকে।ছেলের বড় একটি ছবি হাতে সংবাদ সম্মেলনে আসা কমলা আক্তার জানান, ভোররাতে শাহিনবাগের বাসা থেকে র্যাব পরিচয় দিয়ে কাওসারকে তুলে নেওয়া হয়।
কাওসার আমার একমাত্র ছেলে, অনেক কষ্ট করে ওরে পড়াশোনা শিখাইছিলাম। ও কইতো চাকরি পাইলে আমারে আর কষ্ট করতে দিব না। এখন তো আমার সব শেষ হইল, কষ্টের জানি এখন আর শেষ নাই,” বলেই ডুকরে কেঁদে ওঠেন তিনি।কমলা আক্তারের আর্তি- পোলাটা আমার কোথায় আছে, কেমন আছে, জানতে পারি নাই। এই কষ্ট আর সইতে পারতাছি না বাবা। মরনের আগে একবার হইলেও ওরে দেখতে চাই।
কান্নারত কমলার সামনে মাইক্রোফোনটি ধরে ছিলেন সানজিদা ইসলাম তুলি। তবে নিজের কথা বলতে গিয়ে কান্না ধরে রাখতে পারেননি সুমনের এই বোনও।সানজিদা বলেন, ভাই হারানোর কষ্ট আর বয়ে বেড়াতে পারছি না। পরিবারের কেউ নিখোঁজ হলে সেই পরিবারের স্বজনদের কী অবস্থা হয়, তা কেবল ভুক্তভোগীরাই বলতে পারবেন। আমরা আর এমন জীবন চাই না।তাদের বেদনা স্বজন হারানো প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বুঝতে পারবেন বলে মনে করেন নিখোঁজ সুমনের বোন।তিনিও স্বজন হারিয়েছেন। স্বজন হারানোর কষ্ট তিনি বোঝেন। তিনি আমাদের হারানো স্বজনদের ফিরিয়ে দিতে উদ্যোগ নেবেন বলে আশা করছি।
শাহীনবাগের বাসা থেকে তুলে নেওয়া আদনানের মা জেসমিন বেগমকে সংবাদ সম্মেলনে কথা বলতে অনুরোধ করা হলে মাইক্রোফোন হাতে নিয়ে প্রায় তিন মিনিট ধরে শুধু কাঁদেন তিনি, কোনো কথাই বলতে পারেননি।রাসেলের বোন লাবনী বলেন, এক বছর আগেও আমাদের জীবনটা ছিল অন্যরকম। র্যাব ভাইকে তুলে নেওয়ার আগে কত সাজানো সংসার ছিল আমাদের। ভাইয়ার খোঁজ না পাওয়ায় আমার মা এখন ভারসাম্যহীন।আমিও বেশিদিন সুস্থ থাকতে পারব না,বলতে বলতে কেঁদে ওঠেন এই তরুণী।
ওরা আসবে, ওরা আসবে, ওরা ফিরে আসবেই’- লেখা ব্যানার পেছনে রেখে এই সংবাদ সম্মেলনে ছিলেন সুমনের মা হাজেরা খাতুন, বড় বোন ফেরদৌসী আক্তার, তানভীরের মা নিলুফা বেগম, মাসুমের মা আয়েশা আক্তার, রাসেলের মা মজিদা বেগম, রানার মা আয়েশা খাতুনও।এই পরিবারগুলোর পক্ষ থেকে অভিযোগ করা হয়, তারা প্রথমে র্যাবের সঙ্গে যোগাযোগ করে আটজনের কোনো খোঁজ না পেয়ে থানায় যান মামলা করতে, তবে তাতেও গড়িমসি করেছিল পুলিশ। এরপর কয়েকটি জিডি হলেও আল আমিনের পরিবারের একটি মামলা নেওয়া হয়।এরপর থেকে বিভিন্ন স্থানে ঘুরেও কোনো ফল পাননি বলে জানান সুমনের বোন সানজিদা।নিখোঁজদের পরিবারের এই সংবাদ সম্মেলনে রাজনীতিক মাহমুদুর রহমান মান্নাসহ কয়েজন আইনজীবী ও মানবাধিকারকর্মীও উপস্থিত ছিলেন।
নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক মান্না বলেন, এদেশে কেবল প্রধানমন্ত্রী ও কিছু পরিবারের লোকেরা নিরাপত্তা পাবেন, বাকিদের জীবনের নিরাপত্তা থাকবে না, তা তো হতে পারে না।যারা এক বছরেও তাদের স্বজনদের সন্ধান পাননি, তারা এখনও জানেন না তাদের স্বজনরা বেঁচে আছেন কী নেই। তারা স্বজদের জন্য দোয়াও করতে পারছেন না। এটা কোনোভাবেই মেনে নেওয়া যায় না।মৌলিক অধিকার সুরক্ষা কমিটির আহ্বায়ক জাকির হোসেন বলেন, যে দেশে আইন-আদালত কাজ করে না, বন্দুক দিয়ে সন্ত্রাসী বানিয়ে মানুষকে গুলি করে মারা হয়, সেই দেশ আমরা চাই না।