র্যাব ১১’র নয়া সামারি- ব্যবসায়ী ইসমাইল গুম অভিযুক্ত সেই তারেক
শফিক আজিজি : ঢাকা ১৬ মে ২০১৪: এ বার র্যাব ১১ এর অভিযুক্ত কর্মকর্তাদের নয়া সামারি উদঘাটিত হয়েছে।অভিযুক্ত র্যাব কর্মকর্তারা এবার ২ কোটি টাকা না দেযায় এক ব্যবসায়ীকে গুম করেছে বলে অভিযোগ করেছেন সংশ্লিষ্ঠ স্বজনরা।ঘটনার স্বীকার সিদ্ধিরগঞ্জের ব্যবসায়ী ইসমাইল হোসেন
ইসমাইলের পরিবারের সদস্যরা দাবি করেন, তাঁরা একাধিকবার সরাসরি ও একাধিক লোকের মাধ্যমে বিভিন্ন সময় টাকার অঙ্ক কমানোর জন্য তারেক সাঈদ এবং তাঁর পরামর্শে র্যাবের আরেক কর্মকর্তা মেজর আরিফের সঙ্গে দেনদরবার করেছেন৷ টাকা দাবি করার পরপরই ইসমাইলের পরিবার জমিজমা বিক্রিও করে এক কোটি টাকা জোগাড় করে মেজর আরিফের সঙ্গে দেখা করেন বলে দাবি করেন ইসমাইলের স্ত্রী জোসনা বেগম ও তাঁর দেবর আবদুল মান্নান৷ এ দুজনই নারায়ণগঞ্জের সাত খুনের ঘটনায় চলমান গণশুনানিতে উপস্থিত হয়ে বৃহস্পতিবার তদন্ত কমিটিকে এ বিষয়ে সবিস্তারে অবহিত করেন এবং ইসমাইলকে উদ্ধারের আবেদন জানান৷
আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক উইং কমান্ডার এ টি এম হাবিবুর রহমান বলেন, ‘এ ঘটনা সম্পর্কে আমরা কিছুই জানি না৷’
নারায়ণগঞ্জের কাঁচপুর ইউনিয়ন যুবলীগের কর্মী ইসমাইল হোসেন একজন ঠিকাদার। তিনি চার সন্তানের জনক৷ গত ৭ ফেব্রুয়ারি তাঁকে অপহরণ করা হয়। দুই দিন পর ইসমাইলের ছোট ভাই আবদুল মান্নান থানায় মামলা করেন৷ এতে ছয়জনের নাম উল্লেখ করে বলা হয়, এদের সঙ্গে নানা বিষয় নিয়ে দীর্ঘদিন ইসমাইলের বিরোধ চলছিল৷ এর মধ্যে ৭ ফেব্রুয়ারি তাঁকে অপহরণ করা হয়৷
আবদুল মান্নান বলেন, ‘৭ ফেব্রুয়াির আমার ভাই তাঁর বন্ধু হিরনের গাড়িতে করে বাসায় ফিরছিলেন। ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের সিদ্ধিরগঞ্জের পাইনাদী এলাকায় এলে একটি মাইক্রোবাস তাঁদের গাড়িটির গতিরোধ করে থামায়। মাইক্রোবাসের সবার হাতে অস্ত্র ছিল। তারা র্যাব পরিচয় দিয়ে আমার ভাইকে তুলে নিয়ে যায়। আমরা তখনই থানায় যাই। কিন্তু পুলিশ বলে, আমাদের কিছুই করার নেই। আপনারা র্যাবের অফিসে যান। এরপর আমি ও আমার ভাবি সিদ্ধিরগঞ্জে র্যাব-১১-এর কার্যালয়ে যাই। কিন্তু আমাদের সেখানে ঢুকতে দেওয়া হয়নি।’ মান্নান জানান, এরপর তিনি থানায় মামলা করেন।
জোসনা বেগম এ সময় বলেন, ‘অপহরণের ১২ দিন পর দুজন লোক র্যাবের সোর্স (তথ্যদাতা) পরিচয় দিয়ে আমাদের কাছে ইসমাইলের লেখা একটি চিরকুট নিয়ে আসেন। ওই দুজন আমাদের বলেন, আপনারা র্যাবের সিও (তখনকার) তারেক সাঈদের সঙ্গে দেখা করেন। দুই দিন পর আমি ও মান্নান (দেবর) র্যাব-১১-এর কার্যালয়ে গিয়ে তারেক সাঈদের সঙ্গে দেখা করি। তিনি আমাদের বলেন, ইসমাইল হান্ড্রেড পারসেন্ট ডেঞ্জার লোক। খারাপ লোক। তাঁর খোঁজে কেন আসছেন? আমরা তাঁর হাতে-পায়ে ধরে কান্নাকাটি করি। একপর্যায়ে তিনি বলেন, ইসমাইলকে জীবিত পেতে হলে দুই কোটি টাকা লাগবে। আমাদের এক দিন সময় দিয়ে তিনি বলেন, ঘটনা পুলিশ বা অন্য কাউকে জানালে স্বামীকে জীবিত ফেরত পাওয়া যাবে না।’
‘র্যাবের সিওর কাছ থেকে ফিরে আমরা দ্রুত জমিজমা, গয়নাগাটি সব বিক্রি করে দেই। আত্মীয়স্বজনদের কাছে যাই। একজন আত্মীয় তাঁর দোকান বিক্রি করে টাকা দেন। আমরা এক কোটি টাকার মতো জোগাড় করি। এই অবস্থায় মেজর আরিফ আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। আমরা ওই টাকা নিয়ে আরিফের কাছে যাই। কিন্তু তিনি বলেন, দুই কোটি টাকাই লাগবে, নইলে ইসমাইলকে পাওয়া যাবে না।’
‘এর পাঁচ-সাত দিন পর আমরা কাঁচপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ফজলুল হককে সঙ্গে নিয়ে আবারও র্যাবের সিওর সঙ্গে কথা বলতে যাই। সিও ফজলুল হককে অনেক ধমকান৷ বলেন, খারাপ লোকের জন্য কেন আসছেন?’
মান্নান জানান, এরপর তাঁরা ইসমাইলের বন্ধুদের পরামর্শে রফিক নামে এক ব্যবসায়ীকে দিয়ে র্যাবের সিওকে ফোন করান। তাতে সিও টাকা কিছুটা কমাতে রাজি হন। এর কয়েক দিন পর রফিকের ঢাকার বসুন্ধরায় বাসায় একটি বৈঠক হয়। তাতে তারেক সাঈদ উপস্থিত ছিলেন৷ সেখানে মান্নান আবার র্যাবের সিওকে অনুরোধ করেন৷ সিও বিষয়টি দেখবেন বলে আশ্বাস দেন।
এরপর আমরা আবার তারেক সাঈদের কাছে যাই। তিনি আমাদের মেজর আরিফের সঙ্গে দেখা করতে বলেন। আমরা আবারও মেজর আরিফকে টাকা কিছুটা কমাতে অনুরোধ করি। কিন্তু তিনি রাজি হননি৷’ মান্নান বলেন, ‘এর মধ্যে উপজেলা পরিষদের নির্বাচন নিয়ে র্যাব ব্যস্ত হয়ে পড়লে আমরা আর তাঁদের সঙ্গে দেখা করতে পারিনি। এরপর ২২ এপ্রিল আমরা মেজর আরিফের সঙ্গে দেখা করতে গেলে তিনি বলেন, আপনারা অনেকের সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে কথা বলেছেন। কাজটি ভালো হয়নি। তিনি আর কথা বলতে রাজি হননি৷’
আদমজী ইপিজেডের ভেতরে তিনতলা একটি পুরাতন ভবনে (ব্যাচেলর বিল্ডিং হিসেবে পরিচিত) অবস্থিত র্যাব-১১-এর ক্যাম্পের নিচতলার একটি কক্ষে ইসমাইলকে আটকে রাখা হয়েছিল বলে তাঁরা জানতে পেরেছিলেন। তাঁর ধারণা, তাঁর ভাই এখনো বেঁচে আছেন।
ইসমাইল কাঁচপুর এলাকায় ঠিকাদারি ব্যবসা করতেন। এ ছাড়া একটি পোশাক কারখানার ঝুট ব্যবসা ও বালু ভরাটের কাজ করতেন। এই ব্যবসা নিয়ে স্থানীয় কয়েকজনের সঙ্গে তাঁর দ্বন্দ্ব হয়। ওদের নিয়ন্ত্রণ করতেন নূর হোসেনের আপন শ্যালক ছাত্রলীগের নেতা নূর আলম। তারাই র্যাবকে দিয়ে এই অপহরণের কাজটি করিয়েছে। মামলায় তিনি ওই ছয়জনের নাম উল্লেখ করেছেন বলে জানান৷