রুহুল হককে দুদকের দায়মুক্তি-টিআইবির প্রশ্ন
শফিক আজিজি.ঢাকা: দুর্নীতির অভিযোগ থেকে সাবেক স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণমন্ত্রী আ ফ ম রুহুল হককে দায়মুক্তি দিয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। রুহুল হকের দায়মুক্তিতে প্রশ্ন তুলেছে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ টিআইবি। সংস্থাটির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান জানান, ‘হলফনামায় দেওয়া তথ্য প্রমাণ করা জটিল কোনো বিষয় নয়। এটা ব্যক্তির নিজের দেওয়া তথ্য। তার পরও কোন বিবেচনায় এসব তথ্য প্রমাণ করতে পারছে না সেটাই প্রশ্ন।’
ইফতেখারুজ্জামান বলেন, মন্ত্রী-সাংসদদের দুদকে এনে জিজ্ঞাসাবাদের মাধ্যমে সংস্থাটি আশাবাদ তৈরি করতে পেরেছিল। কিন্তু এসব অভিযোগ যেভাবে নিষ্পত্তি করা হচ্ছে, তাতে প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক। অথচ দুদকের ভাবমূর্তির স্বার্থে অভিযুক্ত ব্যক্তিদের ব্যক্তিগত ও দলীয় পরিচয়ের ঊর্ধ্বে কাজ করাটাই সংস্থাটির কাছে প্রত্যাশিত ছিল।
আজ বুধবার কমিশনের বৈঠকে সাবেক স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রী আ ফ ম রুহুল হককে অভিযোগ থেকে অব্যাহতির অনুমোদন দেওয়া হয়।
নির্বাচন কমিশনে দেওয়া হলফনামা অনুযায়ী তাঁর বিরুদ্ধে জ্ঞাত আয়-বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের অভিযোগ ছিল। দুদকের কমিশনার মো. শাহাবুদ্দিন বলেন, তদন্তে তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণিত না হওয়ায় কমিশন এ সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তবে রুহুল হকের স্ত্রী ইলা হক ও তাঁর ছেলে জিয়াউল হকের বিষয়ে এখনো অনুসন্ধান চলছে বলেও জানান তিনি।
‘হলফনামায় দেওয়া তথ্য ভুল ও অসাবধানতাবশত হয়েছে’—রুহুল হকের এ দাবিও দুদক গ্রহণ করেছে।
নবম জাতীয় সংসদের ছয় মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীর হলফনামা নিয়ে চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে অনুসন্ধান শুরু করে দুদক।
গণমাধ্যমে প্রকাশিত ৭০ জন মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী-সাংসদের হলফনামা ও বিভিন্ন সূত্র থেকে পাওয়া অস্বাভাবিক সম্পদের তথ্য থেকে সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী আ ফ ম রুহুল হক, গৃহায়ণ ও গণপূর্ত প্রতিমন্ত্রী আব্দুল মান্নান খান, পানিসম্পদ প্রতিমন্ত্রী মাহবুবুর রহমান তালুকদার, সাংসদ আসলামুল হক, এনামুল হক ও আবদুর রহমান বদির বিরুদ্ধে প্রাথমিক অনুসন্ধানের নীতিগত সিদ্ধান্ত নেয় দুদক । তাঁদের সঙ্গে বিএনপির দুই সাবেক সাংসদ শহীদ উদ্দিন চৌধুরী এ্যানি ও মশিউর রহমান এবং জমিয়তে উলামায়ে ইসলামের মহাসচিব মুফতি মোহাম্মদ ওয়াক্কাসের বিরুদ্ধেও প্রাথমিক অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত নেয় দুদক।
এর মধ্যে আব্দুল মান্নান খান, মাহবুবুর রহমান ও আবদুর রহমান বদির বিরুদ্ধে সম্প্রতি রাজধানীর রমনা মডেল থানায় মামলা করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন। শহীদ উদ্দিন চৌধুরী এ্যানি ও সাতক্ষীরা সদরের সাবেক সাংসদ আব্দুল জব্বারের বিরুদ্ধে মামলার অনুমোদন দিয়েছে। আর আসলামুল হককে অভিযোগ থেকে অব্যাহতি দেয় সংস্থাটি।
নবম ও দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে জমা দেওয়া হলফনামার তুলনা করে দেখা যায়, রুহুল হকের স্ত্রী ইলা হকের সম্পদ গত পাঁচ বছরে ৭৮২ শতাংশ বেড়েছে, রুহুল হকের অস্থাবর সম্পদের পরিমাণ বেড়েছে ১১০ শতাংশ। ব্যাংক হিসাবের বেশির ভাগই স্ত্রী ইলা হকের নামে।
২০০৮ সালে রুহুল হক ও তাঁর স্ত্রীর নামে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে জমা ছিল ৯২ লাখ ৩৬ হাজার ১০৮ টাকা। এখন তাঁদের ব্যাংকে রয়েছে ১০ কোটি ১৫ লাখ ৯৪ হাজার ৭৬৩ টাকা। সে সময় ইলা হকের নামে ব্যাংকে ছিল মাত্র চার লাখ ৬৪ হাজার ৩০ টাকা। এখন সাত কোটি ৫৩ লাখ ১১ হাজার ২৪০ টাকা। পাশাপাশি ২০০৮ সালে এই সাংসদের ব্যাংকে জমা ছিল প্রায় ৮৮ লাখ টাকা। এখন তা দুই কোটি ৬৩ লাখ টাকা।
রুহুল হকের বিরুদ্ধে অভিযোগটি অনুসন্ধান করেন দুদকের উপপরিচালক মীর্জা জাহিদুল আলম। দুদকে ডেকে নিয়ে তাঁকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। সেখানে রুহুল হক দাবি করেন, হলফনামায় উল্লেখ করা সম্পদের হিসাবে সংখ্যাগত ভুল হয়েছে এবং সেটা অসাবধানতাবশত হয়েছে। বিষয়টি জেলা রিটার্নিং কর্মকর্তার কাছে এফিডেভিটের মাধ্যমে সংশোধনের আবেদন করলে নির্বাচন কমিশন সেটা গ্রহণ করেছে বলেও জানান রুহুল হক। এসব তথ্য দুদকের অনুসন্ধান কর্মকর্তার কাছেও তিনি তুলে ধরেছেন বলে জানান।
একই সঙ্গে তাঁর নিজের নামে ‘কোনো ধরনের অবৈধ সম্পদ’ নেই বলেও দাবি করেন সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী।
দীর্ঘ অনুসন্ধান শেষে প্রায় দুই মাস আগে রুহুল হকের অনুসন্ধান প্রতিবেদনটি কমিশনে জমা দেন অনুসন্ধান কর্মকর্তা। দুদকের একটি সূত্র জানায়, ওই প্রতিবেদনে রুহুল হক, তাঁর স্ত্রী ইলা হক ও ছেলে জিয়াউল হকের নামে বিপুল পরিমাণ সম্পদের অস্তিত্ব মেলার কথা তুলে ধরা হয়।
বেশ কিছু জ্ঞাত আয়-বহির্ভূত সম্পদ ও আড়াই কোটি টাকার অবৈধ সম্পদ পাওয়ার কথাও উল্লেখ ছিল সেখানে। কিন্তু আরও বিস্তারিত অনুসন্ধানের মাধ্যমে বিষয়টি যাচাইয়ের নির্দেশ দিয়ে অনুসন্ধান কর্মকর্তার কাছে ফেরত পাঠায় কমিশন। ‘বিস্তারিত যাচাই শেষে’ আবারও অনুসন্ধান প্রতিবেদন জমা দেন উপপরিচালক মীর্জা জাহিদুল আলম।
ওই প্রতিবেদনের ভিত্তিতে কমিশনের সভায় রুহুল হক অব্যাহতি পান। এ বিষয়ে জানতে মীর্জা জাহিদুল আলমের সঙ্গে যোগাযোগ করলে তিনি কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।
সাম্প্রতিক সময়ে দুদকের মামলায় প্রভাবশালীদের অব্যাহতি দেওয়ার প্রবণতায় সংশ্লিষ্টদের মধ্যে উদ্বেগ রয়েছে। পদ্মা সেতু প্রকল্পে পরামর্শক নিয়োগ দুর্নীতির ষড়যন্ত্র মামলায় সাবেক যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেন, সাবেক পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আবুল হাসান চৌধুরীসহ সংশ্লিষ্টদের দায়মুক্তি দেওয়া হয়েছে। অবৈধ সম্পদ রাখার অভিযোগ থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয় ঢাকার সাংসদ আসলামুল হককে । রেলের নিয়োগ-বাণিজ্যে যুক্ত থাকার অভিযোগে আটক পূর্বাঞ্চলীয় মহাব্যবস্থাপক ইউসুফ আলী মৃধাকে অব্যাহতি দেওয়া হয় পাঁচটি অভিযোগ থেকে।
এ ছাড়াও রেলের নিয়োগ-বাণিজ্যে তৎকালীন রেলমন্ত্রী সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত, শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারিসহ অবৈধ সম্পদের অভিযোগে আওয়ামী লীগের নেতা এইচ বি এম ইকবাল, ২০০১ সালে আদমশুমারি ও গৃহগণনা প্রকল্পের প্রশ্নপত্র মুদ্রণ অনিয়মে সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মহীউদ্দীন খান আলমগীর, হল-মার্ক কেলেঙ্কারিতে প্রধানমন্ত্রীর তৎকালীন স্বাস্থ্যবিষয়ক উপদেষ্টা সৈয়দ মোদাচ্ছের আলীসহ সোনালী ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের সদস্য ও দলীয় নেতা জান্নাত আরা তালুকদার হেনরী, সাইমুম সরোয়ার কমল ও বিসমিল্লাহ গ্রুপের কেলেঙ্কারিতে দুই সাংসদপুত্রের সংশ্লিষ্টতা নিয়ে আলোচনা থাকলেও কোনোটাই প্রমাণ করার ব্যাপারে দুদকের আগ্রহ দেখা যায়নি। অথচ বিরোধীদলীয় নেতাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ অনুসন্ধান ও তদন্তে দুদককে বেশি সক্রিয় দেখা যায় বলে অভিযোগ রয়েছে।