রুপগঞ্জে গাজীর মাদক সাম্রাজ্য-নিয়ন্ত্রণে পাপ্পা গাজী-এমদাদ-মিজান
বিশেষ প্রতিনিধি : রপগঞ্জে গাজী বাহিনীর গডফাদার জেলে গেলেও সেখানকার মাদকের হাট চলছে রমরমা গতিতে। রাজধানী ঢাকার পাশের উপজেলা রূপগঞ্জ। ব্যস্ত এই উপজেলায়ও প্রসার ঘটছে ব্যবসা-বাণিজ্য ও শিল্প-কারখানার। কাজের প্রয়োজনে তাই এখানে স্থানীয়দের পাশাপাশি বসবাস বাড়ছে বহিরাগতদেরও। এ সুযোগ কাজে লাগিয়ে এই উপজেলায় বিস্তার ঘটেছে মাদকের। দ্রুত ধনী হওয়ার নেশায় অনেকেই এ কাজে জড়াচ্ছে। পুলিশ কিংবা মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ দপ্তরের নজরদারি কম থাকায় ক্রমেই বেপরোয়া হয়ে উঠছে এ ব্যবসা। স্থানীয় তথ্য বলছে, গোলাম মূর্তজা পাপ্পা গাজী, এমদাদুল হক দাদুল ও মিজানুর রহমান মিজানের হাতেই মূলত রূপগঞ্জের মাদক ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ। তাঁদের আশ্রয়-প্রশয়ে রূপগঞ্জে মাদক ব্যবসায়ীরা অবাধে এ ব্যবসা চালিয়ে গেছে।
এ ছাড়া আওয়ামী লীগের অনেক নেতাকর্মী মাদক ব্যবসার সঙ্গে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত ছিলেন। মাদক ব্যবসার বদৌলতে রূপগঞ্জেই কোটিপতি হয়েছেন অন্তত ৩৮ জন। গত এক দশকে রূপগঞ্জে মাদক ব্যবসার ভাগাভাগির দ্বন্দ্বে ১৪ জনের খুনের ঘটনা ঘটেছে। আর গত এক বছরেই মাদক আইনে মামলা হয়েছে ৩৮টি এবং গ্রেপ্তার করা হয়েছে ৬৪ জনকে।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, রূপগঞ্জে মাদকের এই যে কারবার, এর মূল হোতাই গোলাম দস্তগীর গাজীর ছেলে গোলাম মূর্তজা পাপ্পা, এমদাদুল হক দাদুল ও মিজানুর রহমান মিজান। রূপগঞ্জের ফেনসিডিলের একক নিয়ন্ত্রণ ছিল থানা ছাত্রলীগের সভাপতি রিয়াজের হাতে। জানা গেছে, রূপগঞ্জেও ৪০০ স্পটের মাদকের টাকা যেত এঁদের তিনজনের কাছে। প্রতি মাসে কোটি কোটি টাকার ভাগ পেতেন তাঁরা। চনপাড়া পুনর্বাসনের মাদক ব্যবসার নিয়ন্ত্রক ছিলেন শমশের আলী।আর শমশেরের মাধ্যমে এমদাদের কাছে প্রতি মাসে যেত ২০ লাখ টাকা।
অনুসন্ধানে আরো জানা গেছে, রূপগঞ্জ শিল্প এলাকা হওয়ায় ভাসমান শ্রমিকের সংখ্যা বেশি। এসব শ্রমিককে টার্গেট করে এক শ্রেণির মাদক ব্যবসায়ী শিল্প-কারখানার আশপাশে মাদকের ব্যবসা চালিয়ে আসছে। অপরদিকে, নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জ আবাসন কম্পানি গড়ে ওঠায় এসব এলাকায় জমির ব্যবসাও জমজমাট। জমির ব্যবসার কাঁচা টাকা হাতিয়ে নিতে এক শ্রেণির মাদক ব্যবসায়ী মাদক ব্যবসা চালিয়ে আসছে। স্থানীয় রাজনীতি থেকে শুরু করে বলতে গেলে রূপগঞ্জের অনেক কিছুই এখন এই মাদককে ঘিরে আবর্তিত হচ্ছে। অভিযোগ রয়েছে, সমাজের এক শ্রেণির লোক অসৎ রাজনীতিবিদ এবং অসাধু পুলিশ সদস্যদের পাশাপাশি কিছু মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ কর্মকর্তার সঙ্গে যোগসাজশে এলাকায় মাদক বাণিজ্য করে বেড়াচ্ছে। গড়ে তুলছে টাকার পাহাড়। বিশেষ বিশেষ মুহূর্তে লোক দেখানো অভিযান চালানো হলেও ভেতরে ভেতরে তারা মিলেমিশে ওই কাজ করছে।
অনুসন্ধানে জানা যায়, রূপগঞ্জের কাঞ্চন পৌরসভা, তারাব পৌরসভা, কায়েতপাড়া, দেইলপাড়া, নগরপাড়া, ইছাপুরা, বাগবাড়ী, দাউদপুর, গোলাকান্দাইল, মুড়াপাড়া, ভুলতা ইউনিয়ন মাদকের আখড়ায় পরিণত হয়েছে। চনপাড়া বস্তি হচ্ছে মাদকের হাট। এখানে সন্ধ্যা হলেই ফেনসিডিল ও ইয়াবা মেলে। দাউদপুর ইউনিয়নের গুচ্ছগ্রাম, গোবিন্দপুরসহ আশপাশের এলাকায় গড়ে উঠেছে চোলাই মদের কারখানা।
বিভিন্ন গবেষণা তথ্য থেকে জানা যায়, উপজেলায় প্রায় ৭০ হাজার মাদকসেবী রয়েছে। বছরে এসব মাদকসেবীর অপচয় হয় প্রায় ১২২ কোটি টাকা। মাদক ব্যবসায়ী রয়েছে প্রায় ৫০০। আর খুচরা ব্যবসায়ীও প্রায় এক হাজার ২০০। এসব মাদকের ছোবলে হাজার হাজার তরুণের জীবন প্রায় বিপন্ন। মাদক ব্যবসার সঙ্গে জড়িত চুনোপুঁটিরা ধরা পড়লেও রাঘব বোয়ালরা থেকে যায় ধরা ছোঁয়ার বাইরে।
খোঁজ নিয়ে আরো জানা যায়, রূপগঞ্জে সড়ক ও নৌপথে অবাধে মাদকদ্রব্য আসে বলে জানান পুলিশ ও গোয়েন্দা সংস্থার কয়েকজন কর্মকর্তা। মাদক প্রবেশের সবচেয়ে নিরাপদ রুট হচ্ছে বালু নদ। এ নদে পুলিশ টহলের ব্যবস্থা না থাকায় মাদক ব্যবসায়ীরা নির্বিঘ্নে ইঞ্জিনচালিত ট্রলারযোগে মাদক আনা-নেওয়া করে। এ ছাড়া শীতলক্ষ্যা নদ দিয়েও মাদকদ্রব্য রূপগঞ্জে ঢোকে। এই নদ দিয়ে পণ্যবাহী জাহাজে করে মাদক ঢোকে রূপগঞ্জে। এদিকে কুমিল্লা থেকে এশিয়ান হাইওয়ে সড়ক দিয়ে বিভিন্ন যানবাহনে মাদক ঢোকে রূপগঞ্জে। আশুগঞ্জ-ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকেও ঢাকা-সিলেট মহাসড়ক দিয়ে মাদক ঢোকে। ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের ভুলতা হচ্ছে মাদকের ট্রানজিট পয়েন্ট। আখাউড়া, সিলেট ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে ফেনসিডিল, ইয়াবা ও হেরোইন বাস, নাইট কোচ, সংবাদপত্রবহনকারী মোটরসাইকেল কিংবা ট্রাকযোগে ওই এলাকায় আসে।
পুলিশ ও মাদক ব্যবসায়ীদের ঘনিষ্ঠ কয়েকটি সূত্র জানায়, মাদক ব্যবসায়ীরা নানা কৌশলে মাদক বহন করে থাকে। ইয়াবা ও ফেনসিডিল বহন করা হয় লাউ, নারিকেল আর ম্যাচের বাক্সের ভেতরে করে। হেরোইন বহন করা হয় মিষ্টির প্যাকেটের ভেতরে করে। আর গাজা বহন করা হয় চটের ব্যাগের ভেতরে করে। মাদক বহনের কাজে ব্যবহার করা হয় কোমলমতি ছেলে-মেয়েদের। সূত্রটি জানায়, বেশির ভাগ ক্ষেত্রে মহিলাদের দিয়ে মাদক বহন করা হয়। মহিলাদের স্পর্শকাতর জায়গায় ইয়াবা, ফেনসিডিল, হেরোইন ও গাজা রেখে বহন করা হয়। মাদক ব্যবসার সুবিধার্থে রূপগঞ্জে সাত শর বেশি শিশু-কিশোর সেলসম্যান রয়েছে বলে বিভিন্ন সূত্র থেকে জানা গেছে।
থানা পুলিশ ও স্থানীয়দের তথ্য মতে, গত ১০ বছরে নেশার কাজে বাধা ও প্রতিবাদে ১৪ জন খুনের শিকার হয়েছে। ২০১৭ সালের ২৭ আগস্ট মাদকের টাকা দিতে অস্বীকার করায় গোলাকান্দাইল ইউনিয়নের মাহনা এলাকায় ব্যবসায়ী নুরুল ইসলাম মোল্লাকে তাঁর নেশাসক্ত ছেলে মিলন মোল্লা ও তাঁর সহযোগীরা হত্যা করে। ২০১৪ সালে চনপাড়া বস্তিতে মাদক ব্যবসায় বাধা দেওয়ায় তারা মিয়া নামে একজনকে খুন করে পিচ্চি মালেক। ২০১৫ সালের ২৫ অক্টোবর চনপাড়া বস্তিতে মাদক ব্যবসায় বাধা দেওয়ায় আব্দুর রহমান নামের এক যুবককে প্রকাশ্যে দিবালোকে রড দিয়ে পিটিয়ে হত্যা করে মাদক ব্যবসায়ীরা। ২০২১ সালে মাদক ব্যবসায় বাধা দেওয়ায় মাছিমপুর এলাকায় নজরুল ইসলাম বাবু নামের এক যুবককে কুপিয়ে ও গুলি করে হত্যা করে মাদক ব্যবসায়ীরা।
২০১৮ সালে হাটাবো এলাকায় মাদক ব্যবসায় বাধা দেওয়ায় সোহেল মিয়া নামের এক যুবককে হত্যা করে মাদক ব্যবসায়ীরা। ২০১৬ সালের ২৯ মার্চ মাদক সেবনে বাধা দেওয়ায় জনতা উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষক মেহেদী হাসান বাবুকে প্রকাশ্যে দিবালোকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। ২০২০ সালের ৬ মে চনপাড়ায় মাদক ব্যবসায়ী আনোয়ারকে হত্যা করা হয়। ২০২০ সালের ৩১ মে রূপসী কাজীপাড়া এলাকায় রাজনকে হত্যা করা হয়। ২০২২ সালের চনপাড়া পুনর্বাসনের খোরশেদ আলমকে হত্যা করা হয়। সর্বশেষ ২০২৩ সালের ৫ নভেম্বর মুড়াপাড়া এলাকায় দ্বীন ইসলামকে হত্যা করা হয়। এ ছাড়া হামলা ও সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে পাঁচ শতাধিক। মাদক সেবন করে গত কয়েক বছরে মারা গেছে পাঁচজন।
রূপগঞ্জের বিভিন্ন এলাকায় ২০ মাদক সম্রাজ্ঞী মাদক জগৎ দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। এদের কেউ ড্রাগ কুইন, ফেন্সি কুইন, মাদক সম্রাজ্ঞী, কালনাগিনী নামে পরিচিতি লাভ করেছে। আবার কারো বা নাম ডেঞ্জার লেডি। এরাও এলাকায় মাদক ছড়িয়ে দিয়ে তরুণ সমাজকে ক্ষতির মুখে নিয়ে যাচ্ছে। এরা মাদকের পাশাপাশি অসামাজিক কার্যকলাপেরও বিস্তার ঘটাচ্ছে বলে অভিযোগ রয়েছে।
রূপগঞ্জ থানার ওসি তদন্ত যোবায়ের হোসেন বলেন, ‘মাদক নিয়ে রীতিমতো অভিযান চলবে। রূপগঞ্জে অনেক এলাকা দুর্গম। এসব এলাকায় যেতে অনেক সময় লাগে। এই সুযোগে মাদক ব্যবসায়ীরা পালিয়ে যায়।’ বেচাকেনা নিয়ে প্রশ্ন করা হলে তিনি অভিযোগ মিথ্যা দাবি করে বলেন, ‘অনেক সময় ভুলে মাদক সেবনকারীদের ধরে নিয়ে আসে। এ সময় তদবির হলে ছেড়ে দেওয়া হয়।’