রাজস্ব আহরণের চাপ-জনগণের ওপর প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ করের বোঝা
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে বাজেট -রাজস্ব আহরণের চাপ ও জনগণের ওপর প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ করের বোঝা ।রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতির বেড়াজালে প্রতি বছরই বাড়ছে বাজেটের আকার। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে বাজেট যতটা না বাস্তবভিত্তিক তার চেয়েও অধিক মনস্তাত্ত্বিক একটি বিষয়। সুতরাং যখন যে সরকার-ই থাকুক, বাজেট পুরোপুরি বাস্তবায়ন করা সম্ভব হোক বা না হোক বাজেটের আকার বাড়বেই। আর বাজেটের আকার বাড়লে একদিকে যেমন বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিসহ (এডিপি) বেশকিছু খাতে বরাদ্দ বাড়ে; তেমনি অন্যদিকে বাজেট ঘাটতি ও সরকারের ঋণ বেড়ে যায়, বাড়ে রাজস্ব আহরণের চাপ ও জনগণের ওপর প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ করের বোঝা। আসন্ন নতুন বাজেটও এ ধারাবাহিকতার বাইরে কিছু নয়।
অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতও একাধিক প্রাক-বাজেট আলোচনায় জানিয়েছেন, এবারের বাজেটে তেমন বিশেষ চমক কিছু থাকছে না। বিভিন্ন খাতে বরাদ্দ কিছু বাড়বে। তবে এবারের বাজেটে বিদ্যুৎ ও জ্বালানী, অবকাঠামো, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, মানবসম্পদ উন্নয়ন ও সামাজিক নিরাপত্তা খাতে বিশেষ জোর দেওয়া হবে। এর বাইরে এবারের বাজেটে প্রথমবারের মতো ‘শিশুদের জন্য বাজেট’ অন্তর্ভুক্ত করা হচ্ছে এবং ছিটমহলবাসীদের জন্য বিশেষ বরাদ্দ রাখা হচ্ছে বলে জানা গেছে।
সবকিছু ঠিক থাকলে আগামী ৪ জুন ২০১৫-১৬ অর্থবছরের বাজেট ঘোষণা করা হবে। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকারের দ্বিতীয় মেয়াদের এটা দ্বিতীয় বাজেট এবং আওয়ামী লীগ সরকারের অর্থমন্ত্রী হিসেবে সপ্তমবারের মতো বাজেট ঘোষণা করবেন আবুল মাল আবদুল মুহিত।
বিভিন্ন সূত্রে প্রাপ্ত তথ্যমতে, আগামী বাজেটের মোট আকার হবে ৩ লাখ ১০০ কোটি টাকার বেশি। এর বিপরীতে অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে মোট আয় হতে পারে ২ লাখ ১১ হাজার ৮৭০ কোটি টাকা। এর মধ্যে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবি আর) নিয়ন্ত্রিত রাজস্ব আহরণের পরিমাণ হচ্ছে ১ লাখ ৭৬ হাজার ৩৭০ কোটি টাকা, যা এরই মধ্যে চূড়ান্ত করা হয়েছে। তবে শেষ মুহূর্তে এটা আরও কয়েক হাজার কোটি টাকা বেড়ে যেতে পারে- এমনটিও শোনা যাচ্ছে।
উল্লেখ্য, চলতি অর্থবছরের মূল বাজেটের আকার ছিল ২ লাখ ৫০ হাজার ৫০৬ কোটি টাকা। সংশোধিত বাজেটে এটা কমিয়ে ২ লাখ ৪০ হাজার ৬০৭ কোটি টাকা করা হচ্ছে। অন্যদিকে এনবি আর নিয়ন্ত্রিত রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ১ লাখ ৪৯ হাজার ৭২০ কোটি টাকা। সংশোধিত বাজেটে এটিও কমিয়ে ১ লাখ ৩৫ হাজার ২৮ কোটি টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে।
আকারের দিক থেকে বাংলাদেশের বাজেট বরাবরই উচ্চাভিলাষী। এ বিষয়ে অর্থমন্ত্রী প্রায়ই বলেন, ‘লক্ষ্য অর্জনের জন্য কিছুটা উচ্চাভিলাষী হওয়া ভাল।’
একই সঙ্গে প্রতি বছরই রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রাকে ‘চ্যালেঞ্জ’ হিসেবে আখ্যায়িত করে থাকেন সমালোচকরা। বিষয়টি অর্থমন্ত্রী অন্যান্যবার অতটা আমলে না নিলেও এবার এক প্রাক-বাজেট আলোচনায় স্বীকার করে বলেছেন, ‘এবার রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন একটা বড় চ্যালেঞ্জ।’
প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, এবার বাজেট ঘাটতি বেড়ে জিডিপির ৫ দশমিক ১ শতাংশ দাঁড়াতে পারে। টাকার অংকে এবারের বাজেট ঘাটতি হতে পারে ৮৮ হাজার ২৩০ কোটি টাকা। বিদায়ী মূল বাজেটে মোট ঘাটতির পরিমাণ ছিল ৬৭ হাজার ৫৫২ কোটি টাকা। এটা জিডিপির ৫ শতাংশ।
নতুন বাজেটে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) আকার নির্ধারণ করা হয়েছিল ৯৭ হাজার কোটি টাকা। কিন্তু এ খাতে আরও ৪ হাজার কোটি বাড়ছে। সব মিলিয়ে এডিপির আকার দাঁড়াচ্ছে ১ লাখ ১ হাজার কোটি টাকা। বিদায়ী অর্থবছরের মূল বাজেটে এডিপির আকার ছিল ৮০ হাজার ৩১৫ কোটি টাকা। সংশোধিত বাজেটে এটি কাটছাঁট করে ৭৫ হাজার ৮৪২ কোটি টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে।
নতুন বাজেটে আগামী অর্থবছরে জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার নির্ধারণ করা হতে পারে ৭ দশমিক ২ শতাংশ। চলতি বাজেটে জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার নির্ধারণ করা হয়েছিল ৭ দশমিক ৩ শতাংশ। সংশোধিত বাজেটে এটা ৭ শতাংশ করা হতে পারে।
অন্যান্যের মধ্যে ভর্তুকি ব্যয় কিছুটা বাড়ানো হচ্ছে। পিপিপিতে বরাদ্দ এক হাজার কোটি টাকা কমছে। চলতি অর্থবছরে এ খাতে বরাদ্দ ছিল তিন হাজার কোটি টাকা।
চলতি অর্থবছরে মূল বাজেটে ভর্তুকি খাতে বরাদ্দ ছিল ২৬ হাজার ৫৩ কোটি টাকা। সংশোধিত বাজেটে এটা কমিয়ে ২৪ হাজার ৬০৯ কোটি টাকা করা হচ্ছে। আর নতুন বাজেটে এ খাতে বরাদ্দ রাখা হচ্ছে ২৬ হাজার ৬০৯ কোটি টাকা। এর মধ্যে কৃষি খাতে ৯ হাজার কোটি টাকা, বিদ্যুৎ খাতে ৮ হাজার কোটি টাকা, রফতানি খাতে ভর্তুকি ও প্রণোদনা ৩ হাজার ৫০০ কোটি টাকা, খাদ্য খাতে ১ হাজার ৯০০ কোটি টাকা, বিজেএমসিকে এক হাজার কোটি টাকা ও বিপিসিকে ৮০০ কোটি টাকা ভর্তুকি দেওয়া হতে পারে বলে জানা গেছে। এর বাইরে রাষ্ট্রায়ত্ত চার বাণিজ্যিক ব্যাংকের মূলধন ঘাটতি পূরণে ৫ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হচ্ছে।
নতুন বাজেটে খাদ্য ও সামাজিক নিরাপত্তার কর্মসূচির আওতায় আসছে ৪৯ লাখ গরীব মানুষ। এ খাতে বরাদ্দ দেয়া হচ্ছে প্রায় ২ হাজার ৯৩৪ কোটি টাকা। এর মধ্যে কাজের বিনিময়ে খাদ্য (কাবিখা) কর্মসূচিতে পৌনে ১৯ লাখ দরিদ্র মানুষ, টিআর কর্মসূচিতে প্রায় ১৯ লাখ মানুষ, জিআর কর্মসূচির মাধ্যমে ৩ লাখ ৬২ হাজার মানুষকে সহায়তা দেওয়া হবে।
নতুন পে-স্কেল আংশিক বাস্তবায়নে সরকারি চাকুরেদের বেতন-ভাতা খাতে আগামী অর্থবছরে সরকারের ব্যয় বাড়ছে। বর্তমানে প্রায় ৩০ হাজার কোটি টাকা ব্যয় হয় এ খাতে। নতুন বাজেটে এ খাতে ৪২ হাজার ১৫৮ কোটি টাকা ব্যয় ধরা হচ্ছে বলে জানা গেছে।