রাজনীতি বদলে দেয়ার বাজেট
শফিক আজিজি: ঢাকা ৫ জুন ২০১৪: রাজনীতি বদলে দেয়ার বাজেট দিয়েছে এবার আওয়ামী লীগ ঘোষিত বাজেটের মধ্যদিয়ে জনগনের দৃষ্টি বদলে যাবে।জনগন আর ফিরে তাকাবে না পেছনের দিকে।জনগনের এগিয়ে যাওয়ার এই বাজেট নিয়ে তুষ্ঠ অর্থমন্ত্রী। নির্বাচনী প্রতিশ্রতি পূরণ হলে সারা দেশেই উন্নয়নের জোয়াড় বয়ে যেতে পারে বলে মন্তব্য করেছেন রাজনীতিকরা।
অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত বৃহস্পতিবার জাতীয় সংসদে ২০১৪-১৫ অর্থবছরের জন্য ২ লাখ ২০ হাজার ৫০৬ কোটি টাকার বাজেট উপস্থাপন করেছেন। সামগ্রিকভাবে ভৌত অবকাঠামো খাতে ৩০ দশমিক ১৫ শতাংশ বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসহ মানবসম্পদ খাতে ২১ দশমিক ৫৮ শতাংশ বরাদ্দ প্রস্তাব করা হয়েছে। জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার ধরা হয়েছে ৭ দশমিক ৩ শতাংশ। ঘোষিত বাজেটের মধ্য দিয়ে অর্থনীতিকে চাঙ্গা করে অস্থির রাজনীতি তথা সরকার সামলানোর চেষ্টা করা হয়েছে বলে মনে করছেন অর্থনীতিক বিশ্লেষকরা।
বিএনপি নেতৃত্বাধীন ১৯ দলীয় জোটকে বাইরে রেখে গত ৫ জানুয়ারি যে নির্বাচন হয়েছে সেটি নিয়ে দেশ-বিদেশে রয়েছে অনেক প্রশ্ন। সুশীল সমাজ থেকে শুরু করে প্রভাবশালী অনেক দেশের কূটনীতিকরা মধ্যবর্তী নির্বাচনের ব্যাপারে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে দ্রুত সংলাপ করার জন্য তাগিদ দিয়ে যাচ্ছেন। এ চাপের পরিস্থিতির মধ্যে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকার নতুন বাজেট জনগণের সামনে তুলে ধরল।
এই বাজেটের মাধ্যমে পদ্মা সেতুর নির্মাণকাজ শুরু করে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের বৃহৎ জনগোষ্ঠীর চোখ ফেরাতে চাইছে সরকার। এ জন্য আট হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। ঢাকা-চট্টগ্রাম এবং ঢাকা-ময়মনসিংহ চারলেন প্রকল্পের কাজ দ্রুত গতিতে শেষ করার মধ্য দিয়ে ওই এলাকার জনগণকে তুষ্ট রাখার চেষ্টা করা হবে। আর রাজধানীবাসীকে তুষ্ট রাখা হবে ফ্লাইওভার, মেট্রোরেল, এলিভেটেড এঙ্প্রেসওয়েসহ দৃষ্টিনন্দন নানা প্রকল্পের মাধ্যমে। নগরের পাশাপাশি গ্রামাঞ্চলের মানুষকেও তুষ্ট রাখা হবে গ্রামীণ জনপদ সৃষ্টির মাধ্যমে। প্রতিটি ইউনিয়ন সদরকে পরিকল্পিত পল্লী জনপদ এবং উপজেলা সদর ও বর্ধিষ্ণু শিল্প কেন্দ্রগুলোকে আধুনিক শহর হিসেবে গড়ে তোলার উদ্যোগ রয়েছে। গ্রামীণ অর্থনীতি চাঙ্গা রাখতে গ্রামীণ অবকাঠামো উন্নয়ন ও পল্লী আবাসনে বরাদ্দ অব্যাহত রাখা হচ্ছে। হাওর অঞ্চলের সমস্যা মেটাতেও দেওয়া হয়েছে থোক বরাদ্দ। চরাঞ্চলের কৃষিপণ্য বাজারজাতকরণেও বিশেষ বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। অর্থনৈতিকভাবে বৈষম্যের শিকার যৌন প্রতিবন্ধী, দলিত, হরিজন, বেদে জনগোষ্ঠীকে সমাজের মূল ধারায় আনতে বিশেষ ভাতার ব্যবস্থা থাকছে। গরিব-বঞ্চিত, অবহেলিত ও পরিত্যক্ত গোষ্ঠীর জন্য সুযোগ সৃষ্টির লক্ষ্যে বিভাগীয় ও জেলা শহরে আবাসনসহ কর্মসংস্থান প্রকল্প থাকছে।
দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জয়ী হয়ে আরো পাঁচ বছরের জন্য ক্ষমতায় এসেছে আওয়ামী লীগ সরকার। নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি পূরণের অংশ হিসেবে সংসদে প্রথম এ বাজেট উপস্থাপন করা হল। অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত এ নিয়ে অষ্টমবারের মতো জাতীয় সংসদে বাজেট উত্থাপন করলেন।
প্রয়াত অর্থমন্ত্রী সাইফুর রহমান ছাড়া আর কারো এতো বার বাজেট পেশের রেকর্ড নেই।
অনুদান ছাড়া বাজেটে সামগ্রিক ঘাটতি থাকছে ৬৭ হাজার ৪৯৮ কোটি টাকা। প্রস্তাবিত বাজেটে কৃষি, বিদ্যুৎসহ অন্যান্য খাতে সবমিলিয়ে ভর্তুকি রাখা হচ্ছে ২৬ হাজার ৫৩ কোটি। চলতি অর্থবছরে ভর্তুকির পরিমাণ ছিল প্রায় ৩২ হাজার কোটি টাকা।
অনুন্নয়ন ব্যয়ের আরেক বড় খাত সরকারি চাকুরেদের বেতন-ভাতার ব্যয় ধরা হয়েছে ৩০ হাজার ৮০৯ কোটি, ঋণের সুদ পরিশোধে ৩০ হাজার ৮০০ কোটি টাকা।
চলতি ২০১৩-১৪ অর্থবছরের জন্য দুই লাখ ২২ হাজার ৪৯১ কোটি টাকার বাজেট প্রস্তাব করা হয়। রাজস্ব বোর্ড উৎস থেকে কর আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয় এক লাখ ৩৬ হাজার ৯০ কোটি টাকা।
এক হাজার ২০০ প্রকল্পের বিপরীতে উন্নয়ন বাজেট ঘোষণা করা হয় ৬৫ হাজার ৮৭০ কোটি টাকার।
কিন্তু রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে রাজস্ব আদায়ে ঘাটতি পড়ায় কর আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা কমিয়ে এক লাখ ২৫ হাজার কোটি টাকায় নামিয়ে আনে এনবিআর। এডিপি কাটছাঁট করে নামিয়ে আনা হয় ৬০ হাজার কোটি টাকায়।
এ বাজেটে সামগ্রিক ঘাটতি (অনুদান ব্যতীত) ধরা হয়েছে ৬৭ হাজার ৪৯৮ কোটি টাকার মতো, যা জিডিপির ৫ দশমিক ১ শতাংশ। এই ঘাটতির মধ্যে ২৪ হাজার ৪৯৮ কোটি টাকা মেটানো হবে বৈদেশিক ঋণ ও অনুদানের মাধ্যমে এবং বাকি ৪৩ হাজার কোটি টাকা অভ্যন্তরীণ ঋণের মাধ্যমে পূরণ করা হবে। এই অভ্যন্তরীণ ঋণের মধ্যে রয়েছে ব্যাংক ঋণ ও সঞ্চয়পত্র থেকে ঋণ।
চলতি বাজেটে অনুদান ব্যতীত সামগ্রিক ঘাটতি ধরা হয়েছিল ৫৫ হাজার ৩২ কোটি টাকা, যা জিডিপির ৪.৬ শতাংশ।
নতুন বাজেটে জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হচ্ছে ৭ দশমিক ৩ শতাংশ। চলতি বাজটে ৭ দশমিক ২ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জনের ঘোষণা দেয়া হয়েছিল। কিন্তু পরে তা সাড়ে ৬ শতাংশে নামিয়ে আনা হয়।
বিশ্ব ব্যাংক, এডিবি, আইএমএফএসহ স্থানীয় অর্থনীতিবিদ পূর্বাভাস দিয়েছিলেন এবার প্রবৃদ্ধি ৬ শতাংশের নীচে নেমে আসবে। কিন্তু বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর সাময়িক হিসাবে চলতি অর্থবছরে ৬ দশমিক ১২ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জিত হবে।
২০১৪-২০১৫ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে মোট রাজস্ব প্রাপ্তির লক্ষ্যমাত্রা ধরা হচ্ছে ১ লাখ ৮৪ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) মাধ্যমে সরাসরি কর থেকে আদায় হবে ১ লাখ ৫১ হাজার ৭০০ কোটি টাকা।
এনবিআরের বাইরে কর থেকে পাওয়া যাবে ৫ হাজার ২১০ কোটি টাকা এবং কর বহির্ভুত উৎস থেকে আসবে আরো ২৮ হাজার কোটি টাকা।
চলতি ২০১৩-১৪ অর্থবছরে মোট লক্ষ্যমাত্রা ছিল ১ লাখ ৬৭ হাজার ৪৫৯ কোটি টাকা। এর মধ্যে এনবিআর সংগ্রহ করার কথা ছিল ১ লাখ ৩৬ হাজার ৯০ কোটি টাকা। কিন্তু রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে রাজস্ব আদায় পরিস্থিতি ভালো না থাকায় লক্ষ্যমাত্রা ১১ হাজার কোটি টাকা বা ৮.০৮ কমিয়ে ১ লাখ ২৫ হাজার কোটি টাকা করা হয়েছে।
এছাড়া সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর পরিধি ও পরিমাণ বাড়ানো ছাড়াও এবারের বাজেটে গুরুত্ব পাবে রেল যোগাযোগ ও গ্রামীণ অবকাঠামোসহ সব ধরনের অবকাঠামো নির্মাণ প্রকল্প। এর জন্য বিশেষ বরাদ্দ রাখার পরিকল্পনাও আছে বলে জানিয়েছেন অর্থমন্ত্রী।
সরকারের অগ্রাধিকারভিত্তিক ৭টি মেগা প্রকল্প বিশেষ গুরুত্ব পাচ্ছে নতুন বাজেটে। এগুলো হচ্ছে পদ্মা সেতু, সোনাদিয়া গভীর সমুদ্রবন্দর, এলএনজি টার্মিনাল, কয়লাভিত্তিক বড় বিদ্যুৎকেন্দ্র, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র, এশিয়ান হাইওয়ে ও মেট্রোরেল প্রকল্প।
এছাড়া মানবসম্পদ, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কৃষি, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি এবং যোগাযোগে সর্বাধিক বরাদ্দ থাকবে।
এবার সাতটি জেলার বাজেট দেবেন অর্থমন্ত্রী। জেলা সাতটি হচ্ছে- সিলেট, খুলনা, চট্টগ্রাম, টাঙ্গাইল, বরিশাল, রাজশাহী এবং রংপুর।
বাজেটে উপস্থাপনের সময় অর্থমন্ত্রীর বাজেট বক্তৃতা, বাজেটের সংক্ষিপ্তসারসহ অন্যান্য নথির সঙ্গে ‘জেলাভিত্তিক বাজেট বরাদ্দ, ২০১৪-১৫ (সিলেট, খুলনা, চট্টগ্রাম, টাঙ্গাইল, বরিশাল, রাজশাহী ও রংপুর জেলা)’ শীর্ষক একটি বই সরবরাহ করা হবে।
এছাড়া প্রস্তাবিত বাজেটে গড় মূল্যস্ফীতি ৬ শতাংশের মধ্যে রাখার পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে। চলতি বাজেটে ৭ শতাংশের মধ্যে রাখার পরিকল্পনা ছিল। এপ্রিল শেষে গড় মূল্যস্ফীতির হার ছিল ৭ দশমিক ৪৭ শতাংশ।
এক নজরে বাজেট
বাজেটের আকার : ২ লাখ ২০ হাজার ৫০৬ কোটি টাকা।
রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রা : ১ লাখ ৮৪ হাজার কোটি টাকা।
বাজেট ঘাটতি : ৬৭ হাজার ৪৯৮ কোটি টাকা বা জিডিপির ৫.১%।
ভর্তুকি : ২৪ হাজার ৫৩ কোটি টাকা।
জিডিপি লক্ষ্যমাত্রা : ৭.৩ শতাংশ।
গড় মূল্যস্ফীতি : ৬ শতাংশের নিচে।