রমজানের শেষ দশকে আল্লাহ তালার নৈকট্য লাভের জন্যে ইতেকাফ জরুরী
মাওলানা আলমগীর : ইতেকাফের আভিধানিক অর্থ হচ্ছে, কোন জিনিসকে শক্ত করে আঁকড়ে ধরা এবং এর উপর স্বীয় সত্তাকে আটকে রাখা। আর পারিভাষিক অর্থ হচ্ছে, আল্লাহ তালার নৈকট্য লাভের উদ্দেশ্যে একটি নিদিষ্ট সময় মসজিদে পূর্নাঙ্গ সময় অবস্থান করা। যিনি ইতেফাক করেন তাকে মুতাফিক বলে।
ইতেফাকের উদ্দেশ্যঃ-আত্মশুদ্ধি, আত্মার পবিত্রতা অর্জন, আধ্যাতিক উৎকর্ষ সাধন এবং আল্লাহ পাকের সন্তুষ্টি ও নৈকট্য লাভই ইতেকাফের মূল উদ্দেশ্য।
এ প্রসংঙ্গে আল্লামা ইবনে রজব (রঃ) বলেছেন ইতেফাকের উদ্দেশ্য হলো সৃষ্টির সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করা এবং স্রষ্টার সাথে সম্পক কায়েম করা। আল্লাহর সাথে পরিচয় যতো বেশী হবে সম্পর্ক ও ভালবাসা ততো গভীর হবে।
আল্লামা ইবনুল কাইয়ুম বলেছেন ‘ আল্লাহর পথে যাত্রা অব্যাহত রাখা নির্ভর করে যোগ্য ও সঠিক মনের উপর। মন বিচ্ছিন্ন থাকলে কোন পথে অগ্রসর হওয়া যায় না। সে জন্যই মনকে আল্লাহর দিকে ধাবিত করার ব্যবস্থাই ইতেফাক।
আল কোরআনে ইতেকাফঃ আল্লাহ বলেন,“তোমরা আমার ঘরকে তাওয়াফ ও এতেকাফ কারীদের জন্য পবিত্র রাখ। তোমরা হইতেছ মসজিদ সমূহে অবস্থানকারী ” (আল কোরআন)।
রাসূল (সাঃ) এর জীবনে ইতেকাফ ও সওয়াবঃ- হযরত আবু হুরাইরা (রাঃ) থেকে বর্ণিত-রাসুলুল্লাহ (সাঃ) রমজানের শেষ দশ দিন ইতেকাফ করতেন। কিন্তু ইন্তেকালের বছর তিনি ২০ (বিশ) দিন ইতেকাফ করেন (বোখারী মুসলিম)।হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রাঃ) হতে বর্ণিত মহানবী (সাঃ) বলেন-“যে ব্যক্তি আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য একদিন ইতেকাফ করে আল্লাহ তার ও দোযখের মধ্যে ৩টি খন্দক পরিমান দুরত্ব সৃষ্টি করে দিবেন। প্রত্যেক খন্দকের দূরত্ব হবে পৃথিবীর পূর্ব ও পশ্চিমের দূরত্বের চেয়ে বেশী (তাবরানী ও হাকেম)।
হযরত আয়েশা (রাঃ) থেকে বর্ণিত রাসুলুল্লাহ (সাঃ) আমৃত্যু রমজানের শেষ দশক ইতেকাফ করতেন। (বোখারী ও মুসলিম) হযরত আলী ইবনে হোসাইন (রাঃ) নিজ পিতা থেকে বর্নণা করেন রাসুল (সাঃ) বলেছেন রমজানের শেষ দশ দিন ইতেকাফ করা দুই হজ্ব ও দুই ওমরার সমান সওয়াব পাবেন।
(বাইহাকী) হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) থেকে বর্ণিত ইতেকাফ কারী সর্ম্পকে রাসুল (সাঃ) বলেছেন ইতেকাফ কারী গুনাহ থেকে বিরত থাকে বলে। তাকে সকল নেক কাজের কর্মী হিসাবে বিবেচনা করে অনেক সওয়াব দান করা হয়। (ইবনে মাজাহ) হযরত আয়েশা (রাঃ) বলেন মহানবী (সাঃ) যখন ইতেকাফের ইচ্ছা করিতেন ফজরের নামাজ পরতেন এবং ইতেকাফের জন্য প্রবেশ করতেন। (আবু দাউদ,তিরমিযী ও ইবনে মাজাহ)
ইতেকাফ তিন প্রকারঃ- ১.ওয়াজিবঃ-কেউ মানত করলো যে আমার অমুক কাজ হয়ে গেল ইতেকাফ করবো। অথবা কোন শর্ত ছাড়াই ইতেকাফের মানত করলো।
২.সুন্নতে মুয়াক্কাদাঃ-রমজানের শেষ দশ দিন ইতেকাফ করা সুন্নতে মুয়াক্কাদা আলাল কেফায়া মহল্লার কোন একজন ইতেকাফ করলে সকলের পক্ষ থেকে আদয় হয়ে যাবে। আর কেউ ইতেকাফ না করলে সকলেই গুনাহগার হবে।
৩.মুস্তাহাব ইতেকাফঃ-রমজানের শেষ দশ দিন ব্যতীত অন্য যে কোন সময়ে যে কোন মেয়েদের ইতেকাফ করা মুস্তাহাব।
ইতেকাফের শর্তঃ- ১.ইতেকাফকারীকে মুসলমান হতে হবে। ২.পাগল না হওয়া সুস্থ মস্তিক হওয়া। ৩.বালেগ ও আকেল হওয়া। ৪.নিয়ত করা। ৫.পবিত্র থাকা। ৬.পূনাঙ্গ সময় মসজিদে অবস্থান করা। ৭.রোজা রাখা। (দুবরুল মুখতার)
ইতেকাফ কারীর জন্য সুন্নত হলোঃ- হযরত আয়েশা (রাঃ) থেকে বর্ণিত হাদিস। ১.রোগী দেখতে না যাওয়া।২.জানাজায় অংশ গ্রহন না করা। ৩.স্ত্রীকে স্পর্শ না করা এবং সহবাস না করা। ৪.খুব বেশী প্রয়োজন না হলে মসজিদ থেকে বের না হওয়া। (আবু দাউদ)
যে সব কারনে ইতেকাফ ভেঙ্গে যায়ঃ- ১.ইতেকাফের যেয়াদেও ভিতরে সহবাস করলে ওয়াজিব ও সুন্নত ইতেকাফ ভেঙ্গে যায় এবং কাজা করতে হয়। ২. কোন রোগীকে দেখা, ডুবন্ত লোককে বাচানোর চেষ্টা করা,-আগুন নেভানো ইত্যাদীর কারনে মসজিদ থেকে বেরোলেও ইতেকাফ ভেঙ্গে যায়। তবে তাতে গুনাহ হবেনা।
৩. ইতেকাফ কারীকে জোর পূর্বক কেউ বাহিরে নিয়ে গেল, মহাজন দেনার দায়ে টেনে বের করে নিয়ে গেল বা পুলিশ গ্রেফতার করে নিলেও ইতেকাফ ভেঙ্গে যাবে। ৪. প্রাকৃতিক বা শরীয়ত সম্মত কারনে বাইরে গিয়ে সংগত কারনে ফিরে আসতে বিলম্ব হলেও ইতেকাফ থাকবেনা। ৫. ওয়াজিব ইতেকাফ ও রমজানের সুন্নাত ইতেকাফের জন্য রোজা জরুরী নফল ইতেকাফের জন্য রোজা শর্ত নয়।
ইতেকাফের স্থানঃ- ইতেকাফের জন্য সবোর্ত্তম স্থান হলো মসজিদ দুল হারাম (কাবা শরীফ) এর পর মসজিদে নববী, তার পর মসজিদুল আকসা (বাইতুল মোকাদ্দিস), অতপর এলাকার বৃহত্তম জামে মসজিদ এবং এর পর মহান আল্লাহর ওয়াকতিয়া মসজিদ। যে মসজিদে জামায়াতের ব্যবস্থা তথা ইমাম ও মুয়াজ্জিন আছে, চাই নিয়মিত জামায়াত হোক বা না হোক, সেই মসজিদে ইতেকাফের নিয়তে অবস্থান করবে।
ইতেকাফ কারীর জন্য মাকরুহ বিষয়ঃ- ১. বেচাকিনায় অংশ নেওয়া। ২. যে কথায় গুনাহ হয় তা বলা ইতেকাফ অবস্থায় নিরর্থক বাজে ও বেহুদা কথা এবং কাজ মাকরুহ। ৩. আল্লাহর নৈকট্য লাভের উপায় ভেবে চুপ থাকা মাকরুহ। অন্য কথায় চুপ থাকাকে এবাদত মনে করে কোন কথা না বলা।
যে সব কাজ দ্বারা ইতেকাফ বাতিল বা ভঙ্গ হয়ঃ- ১. মসজিদ বা ইতেকাফের স্থান থেকে নিজের প্রয়োজনে বের হলে । ২. ইসলাম পরিত্যাগ করে মুরতাদ হলে। ৩. অজ্ঞান বা পাগল হলে। ৪. মেয়েদের মাসিক দেখা দিলে। ৫. সন্তান ভূমিষ্ঠ হলে বা গর্ভপাত হলে। ৬. সহবাস করলে। ৭. বীর্যপাত ঘটালে। ৮. মুতাফিককে কেউ জোর পূর্বক মসজিদ থেকে বের করে দিলেও ইতেকাফ বাতিল হয়ে যাবে।
মুতাফিকের জন্য জায়েয কাজ সমূহঃ- ১. প্রয়োজনীয় কজের জন্য মসজিদের বাহিরে যাওয়া। ২. মসজিদে পানাহার ও ঘুমানো। ৩. প্রয়োজনে অন্যের সাথে কথা বলা। ৪. নিজ পরিবারের লোকদের ও আগত মেহমানদের বিদায় জানানোর জন্য মসজিদ থেকে বের হওয়া। ৫. যাদের খাবার পৌছে দেওয়ার লোক নেই তারা খাবার খেতে বাহিরে যেতে পারবেন। ৬. যদি ইতেকাফের মসজিদে জুমায়ার নামাজ না হয় ,তাহলে জুমা আদায়ের জন্য অন্য মসজিদে যাওয়া। উল্লোখিত প্রয়োজন পুরনের পর মুতাফিক এক মুহর্তও বাহিরে দেরি করবেন না এবং অন্য কাজে লিপ্ত হবেন না।
মহিলাদের ইতেকাফঃ- হাদিস থেকে জানা যায় যে মহিলারাও ইতেকাফ করতে পারে। মহিলাদের ইতেকাফ গৃহ কোনে (সালাত আদায়ের স্থানে) বাঞ্চনীয়। তবে মহিলাদের ইতেকাফ স্বামীর অনুমতি আব্যশক। মাসিক দেখা দিলে, গর্ভপাত হলে কিংবা সন্তান প্রসব করলে ইতেকাফ ছেড়ে দিতে হবে।
ইতেকাফ কারীর জন্য আমল সমুহঃ- ১. পাচ ওয়াক্ত সালাত ও তারাবীহ জামায়াতের সাথে আদায় করা। ২. সালাতুত তাহাজ্জদ আদায় এবং অব্যাস করা। ৩. অর্থসহ কুরআন তেলাওয়াত করা। ৪. অর্থসহ হাদিস অধ্যায়ন করা। ৫. জরুরী মাসলা মাসায়েল সহ ইসলামের গুরুত্ব পূর্ন বিষয়ে পড়ালেখা গবেষনা ও চিন্তা ভাবনা করা। ৬. নফল ইবাদত, নামাজ, যিকির ও দোয়া করা। ৭. রাসুল (সাঃ) এর উপর দরুদ পাঠ করা। ৮. দরসে কুরআন, দরসে হাদিস ও ওয়াজ এবং দাওয়াতে দ্বীনের কাজ করা। ৯. ইসলামের মৌলিক ও গুরুত্ব পূর্ন বিষয়ে গ্রন্থ রচনা করা সম্ভব হলে। ১০. আল্লাহর দরবারে কান্না কাঠি করা ও নিজ জীবনের গুনাহ সমুহের তাওবাহ ইস্তিগকা করা। ১১. মাতা, পিতা, আত্বীয় স্বজন সহ সকল মুসলমানদের জন্য দোয়া করা।
ইতেকাফ কারী জা অজর্ন করতে পারেঃ- ১. আত্বার পরিশুদ্বি লাভের জন্য ইতেকাফ একটি উত্তম ব্যবস্থা। পার্থিব জীবনে মানুষ হাজারো ব্যস্ততা ও ঝামেলার মধ্যে দিয়ে জীবন যাপন করতে হয়। শয়তান মানুষের পেছনে সব সময় লেগে আছে। প্রতিটি কাজে সে ধোকা দেয়ার চেষ্ঠা করে। তাই দুনিয়ার সব ঝামেলা পরিবার পরিজন থেকে বিচ্ছিন হয়ে নিজের নফসকে নিয়ন্ত্রনের মাধ্যমে আত্বার পরিশুদ্বি করতে ইতেকাফ ভুমিকা পালন করে।
২.আল্লাহর নৈকট্য লাভঃ- সংসার, সামাজিক যাবতীয় কাজ কর্ম ও লেনদেন থেকে কিছু দিনের জন্য মুক্ত হয়ে মানুষ একান্তভাবে আল্লাহর ধ্যানে মশগুল থাকার সুযোগ পায় ইতেকাফের মাধ্যমে। এ সুযোগ ইতেকাফ কারী আল্লাহর নৈকট্য লাভে সক্ষম হয়।
৩. আল্লাহর পথে চলার অনুপ্রেরনা সৃষ্টিঃ- ইতেকাফ কারী ইতেকাফে বসে আল্লাহর আজাব ও শাস্তির কথা ভেবে যেমন ভীত-কমপ্তি হয়ে ওঠে। ঠিক তেমনি তার পুরুস্কারের কথা স্বরন করে আনন্দে উদ্বোলিত হয়ে ওঠে। আল্লাহর পথে চলার জন্য। আল্লাহর রাহে নিজকে কুরবানী করার জন্য সে মানসিক ভাবে সিদ্দান্ত পৌছাতে সক্ষম হয়।
৪. নৈতিক ও আধ্যাত্বিক প্রভাব সৃষ্টিঃ-ইতেকাফ মানুষের মনের উপর এমন নৈতিক ও আধ্যাত্বিক প্রভাব সৃষ্টি করে যা তাকে দ্বীর্ঘ দিন আল্লাহর পথে তথা তাকওয়ার পথে পরিচালিত করে।
৫. আল্লাহর প্রতি ভালবাসাঃ-ইতেকাফ কারী যেহেতু নিজের স্ত্রী, পুত্র পরিজন সহ সব কিছু সাময়ীক ভাবে ত্যাগ করে আল্লাহর সন্তুষ্ঠির জন্য ইতেকাফ করে। আল্লাহ ছাড়া কাছে কাউকে পাওয়া যায় না। একান্ত ভাবে আল্লাহর সাথে গভীর সর্ম্পক সৃষ্টি করার মহান, সুযোগ কাজে লাগিয়ে তার ভালবাসা অর্জন করা যায়। সর্বপরি ইতেকাফ এর মাধ্যমে প্রত্যেক ইমানদার ব্যক্তি আত্বগঠন করে আল্লাহর একানিষ্ট বান্দা ও তার দ্বীনের সৈনিক হওয়ার সুযোগ পায় আল্লাহ আমাদের সকলকে ইতেকাফের মাধ্যমে আল্লাহর নৈকট্য অর্জনের তাওফিক দান করুন আমিন।