যুদ্ধপরাধী বিএনপি ওসমানের টর্চারসেলের সন্ধান মিলেছে
বিশেষ প্রতিনিধি : একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের সময় মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে করা মামলায় বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান সাবেক শিক্ষামন্ত্রী ড. ওসমান ফারুকের বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিকভাবে তদন্ত শুরু হয়েছে। গত ৪ জানুয়ারি থেকে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থা এ তদন্ত শুরু করে। প্রাথমিক তদন্তে যুদ্ধপরাধে বিএনপি ওসমানের
টর্চারসেলের সন্ধান মিলেছে।
এর আগে ওসমান ফারুকের বিরুদ্ধে তদন্ত সংস্থায় অভিযোগ নিবন্ধনভুক্ত করা হয়। পাশাপাশি তদন্ত কাজে সহায়তার জন্য একজন প্রসিকিউটর নিযুক্ত করা হয়। ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থার প্রধান মোহাম্মদ আবদুল হান্নান খান বলেন, ‘ওসমান ফারুকের বিরুদ্ধে স্বাধীনতাবিরোধী কর্মকাণ্ডের অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে তদন্ত শুরু হয়েছে। এরই মধ্যে তদন্ত কর্মকর্তা নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। তদন্ত শেষ হলে সব কিছু বলা যাবে।’
ওসমান ফারুকের বিরুদ্ধে গত বছর মে মাসে প্রাথমিক অনুসন্ধান শুরু হয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে চলতি মাস থেকে তদন্ত শুরু হয়। মামলার তদন্ত কর্মকর্তা হিসেবে সহকারী পুলিশ সুপার হেলালউদ্দিনকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। তদন্ত কর্মকর্তা হেলালউদ্দিন বলেন, ‘মামলার পরিপ্রেক্ষিতে প্রাথমিক কাজ শুরু করেছি। রেকর্ড ও নথিপত্র সংগ্রহ চলছে। ফেব্রুয়ারি মাসের প্রথম সপ্তাহে ঘটনাস্থল ময়মনসিংহ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে যাব।’
মুক্তিযুদ্ধের সময় পূর্ব পাকিস্তান (বর্তমানে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় ময়মনসিংহ) কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি স্বাধীনতাবিরোধী গ্রুপ ছিল। ওসমান ফারুক ওই গ্রুপের সক্রিয় সদস্য ছিলেন। সে সময় ওই গ্রুপটি সংঘবদ্ধ হয়ে ওই এলাকায় মুক্তিযোদ্ধা ও নিরীহ সাধারণ মানুষের ওপর হত্যা ও বিভিন্ন ধরনের নির্র্যাতন চালায়।
তদন্ত সংস্থা সূত্রে জানা গেছে, ২০১৫ সালের অক্টোবরে ময়মনসিংহ-৭ আসনে জাতীয় পার্টির এমপি এমএ হান্নানের বিরুদ্ধে একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগ তদন্ত করতে গিয়ে ওসমান ফারুকসহ ১১ জনের সংশ্লিষ্টতার তথ্য পাওয়া যায়। এসব অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে প্রাথমিক অনুসন্ধান শুরু করে তদন্ত সংস্থা। অনুসন্ধান শেষে ওসমান ফারুকের বিরুদ্ধে অভিযোগ তদন্ত সংস্থার কমপ্লেইন রেজিস্ট্রারে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। ৪ জানুয়ারি তদন্ত কর্মকর্তা নিয়োগের মধ্য দিয়ে মামলার তদন্ত আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু হয়। এরপর তদন্ত কাজে সহায়তা করতে প্রসিকিউশন শাখার একজন কর্মকর্তা প্রসিকিউটর ব্যারিস্টার সৈয়দ সায়েদুল হক সুমনকে ১৬ জানুয়ারি নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। তিনি সমকালকে বলেন, ‘ওসমান ফারুকের বিরুদ্ধে মামলা তদন্তের জন্য আমাকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। তদন্ত কর্মকর্তা তদন্ত শুরু করেছেন। তাকে যতটুকু সহায়তার প্রয়োজন, তা করা হবে। তদন্তটা সঠিকভাবে হচ্ছে কি-না তা তদারকি করার দায়িত্ব তাকে দেওয়া হয়েছে বলে জানান তিনি।’
গত বছর ৪ মে ধানমণ্ডি কার্যালয়ে আয়োজিত এক প্রেস ব্রিফিংয়ে তদন্ত সংস্থার প্রধান সমন্বয়ক আবদুল হান্নান খান বলেছিলেন, ওসমান ফারুক স্বাধীনতাবিরোধী কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত ছিল- এর পক্ষে তথ্য-উপাত্ত পাওয়া গেছে। এরপর ওসমান ফারুক পালিয়ে সিলেট সীমান্ত পথে দেশের বাইরে চলে যান। সেই থেকে তিনি লাপাত্তা। তবে মোবাইল ফোনে একাধিকবার কথা বলার চেষ্টা করেও তাকে পাওয়া যায়নি।
ওই সময় জ্যেষ্ঠ সমন্বয়ক সানাউল হক জানিয়েছিলেন, পুরনো কাগজপত্রে দেখা যায়, একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের সময় পূর্ব পাকিস্তান (বর্তমানে ময়মনসিংহে) কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় ওসমান ফারুকসহ ১১ জন শিক্ষক পাকিস্তানি সেনাবাহিনীকে সহায়তা করেছিলেন এবং স্বাধীনতাবিরোধী কর্মকাণ্ডে অংশ নেন তারা। সেখানে একটি টর্চার সেলও ছিল। ওই তালিকা অনুযায়ী খোঁজখবর নেওয়া হয়েছে। তাদের অধিকাংশই সে সময় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক বা কর্মকর্তা ছিলেন। ওসমান ফারুক সে সময় ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের এগ্রিকালচার ইকোনমি অনুষদের রিডার ছিলেন।
কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাকালীন উপাচার্য ওসমান গণির ছেলে ড. ওসমান ফারুক বিএনপি-জামায়াতের নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট সরকারের সময়ে শিক্ষামন্ত্রী ছিলেন। তার বাড়ি কিশোরগঞ্জ জেলার করিমগঞ্জে।
নির্যাতনের পর হত্যা: একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি সৈন্যদের হাতে ২২ নভেম্বর আটক হন শিক্ষাবিদ আমীর আহাম্মেদ চৌধুরী রতন। তাকে আটকের পর কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের রেস্ট হাউসে রাখা হয়। এটি ছিল হানাদার বাহিনীর ৯৩ ব্রিগেড কমান্ডের হেড কোয়ার্টার। এই রেস্ট হাউস পাকিস্তানি সেনারা টর্চার সেল হিসেবেও ব্যবহার করত। সেখানে নির্যাতনের শিকার হয়েছিলেন রতন। বন্দিদশায় সেখানে তিনি অন্তত ১০টি হত্যাকাণ্ড প্রত্যক্ষ করেন। তিনি স্বচক্ষে দেখেন মুক্তিযোদ্ধা ও নিরীহ মানুষ হত্যার নির্মম দৃশ্য। তাকেও আটকে রেখে হত্যার ভয় দেখানো হয়েছিল।
মুক্তিযুদ্ধে ময়মনসিংহবিষয়ক প্রকাশিত বইয়ে রতন তার জবানবন্দিতে বলেন, ওই সময় বিভিন্ন জায়গা থেকে বাঙালিদের ধরে সেখানে নিয়ে হাত-পা ও চোখ বেঁধে নির্যাতনের পর কখনও বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে, কখনও ব্লেড-চাকু দিয়ে কাটাছেঁড়া করে আধমরা করার পর গুলি করে হত্যা করা হতো। পরে এসব লাশ ব্রহ্মপুত্র নদে ফেলে দেওয়া হতো। তার চোখের সামনেই হাবিলদার আলাউদ্দিন চাকু দিয়ে জবাই করে হত্যা করে ভালুকা থেকে ধরে আনা আবদুল হেকিমকে। এ ছাড়া বন্দি অবস্থায় তিনি অনেক নির্যাতনের শব্দ ও নারীর আর্তচিৎকার শুনেছিলেন বলে জানান।
রতনকে বিভিন্ন সময় গাছে ঝুলিয়ে এবং মাটির গর্তে ঢুকিয়ে রাখত পাকিস্তানি সেনারা। তার সামনেই ময়মনসিংহ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের গেস্ট হাউসের পাশে ব্রহ্মপুত্র নদের তীরে ছয়জনকে নির্মমভাবে বেয়নেট চার্জ ও গলা কেটে হত্যা করা হয়। তাদের মধ্যে শহরের বাঘমারার ষাটোর্ধ্ব জুবেদ আলীকে বেয়নেট দিয়ে ও ভালুকা উপজেলার মলি্লকবাড়ির আবদুল হাইকে গলা কেটে হত্যা করা হয়েছিল। আমীর আহাম্মেদ চৌধুরী রতন আফগানিস্তানের কাবুলিওয়ালাদের রক্ষা করেছিলেন। সেই সূত্র ধরেই ছাড়া পেয়েছিলেন তিনি।