মুজিবনগরে ১৭ এপ্রিল কি ঘটেছিল?
দিলরুবা খাতুন : মেহেরপুরের মহকুমা প্রশাসকের কার্যালয়ে প্রথম কন্ট্রোলরুম স্থাপন করা হয়। হোটেল বাজারে তৎকালীন ইসমাইল হোসেন মন্ডল মানিক মিয়ার বাড়িতে মেহেরপুর মহকুমার সকল বন্দুক মালিকদের সহযোগিতায় বন্দুক বাহিনীর কার্যালয় খোলা হয়। অপরদিকে গাংনী বাজারের অভ্যন্তরে একটি কন্ট্রোলরুম স্থাপন করে মেহেরপুরের সাথে সার্বক্ষনিক সংযোগের ব্যবস্থা করা হয়। আনছার মোজাহিদ এবং স্বতঃস্ফুর্ত জনতাকে ঐক্যবদ্ধ করার কাজে আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দ এবং মহকুমা প্রশাসক তৌফিক-ই-এলাহী চৌধুরী ব্যাপক ভূমিকা পালন করেন।
সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় ২৯ শে মার্চ ভোর চারটা থেকে কুষ্টিয়ায় অবস্থানকারী পাকবাহিনীর উপর অতর্কিতে আক্রমন করা হবে। এই সিদ্ধান্ত গৃহীত হবার পরপরই মেহেরপুর থেকে যুদ্ধে যাবার জন্য ৫০ জনের একটি দলকে সামরিক প্রশিক্ষণ ও অস্ত্র সরবরাহ করা হয়। সারা রাত দিন আনসার ব্যারাকে প্রশিক্ষণ ও মহড়া চলতে থাকে। প্রশিক্ষণ গ্রহণকারীদের খাদ্য সরবরাহের জন্য মেহেরপুর নিউ মার্কেটে অস্থায়ীী ক্যাস্প খোলা হয়। কুষ্টিয়া এলাকাকে নামকরণ করা হয় ‘সাউথ ওয়েস্টার্ন কমান্ড’ অর্থাৎ ‘ দক্ষিণ পশ্চিম রণাঙ্গন’ । মেজর মোহাম্মদ আবু ওসমান চৌধুরী এই কমান্ডের নেতৃত্ব দানের জন্য কমান্ডার নিযুক্ত হন।
২৫ মার্চ গভীর রাতেই মাইকে প্রচার করে মেহেরপুরবাসীকে জানিয়ে দেয়া হয় পাকিস্তান সেনাবাহিনী ঢাকাসহ জেলা শহর কুষ্টিয়া আক্রান্ত হয়েছে, এখন জনগণকে প্রতিরোধের প্রস্তুতি গ্রহণ করতে হবে। শহরে এ প্রচারের দায়িত্ব নেন ছাত্রলীগের সভাপতি শাহজাহান খান বিশু। এ দিকে আওয়ামী লীগের সেক্রেটারী ইসমাইল হোসেন সাব রেজিস্ট্রার আবু বকরকে সঙ্গে নিয়ে একটি গাড়িতে করে গাংনীতে এসে ঐ রাতেই থানা আওয়ীমী লীগ নেতৃবৃন্দ এবং আনসার কমান্ডার আলতাফ হোসেন ও আবুল কাশেম কোরাইশীকে ডেকে পরিস্থিতি সম্পর্কে অবহিত করেন।
অতঃপর জোড়পুকুরে নিয়ে আওয়ামী লীগ নেতা আব্দুর রহমানকে ডেকে মেহেরপুরের পূর্ব সীমান্ত খলিশাকুন্ডি ব্রিজ ধ্বংস করার দায়িত্ব দিয়ে আসেন। ছাত্র লীগের সম্পাদক মেহেদী বিল্লাহ গভীর রাতে গাংনীতে এসে ছাত্রলীগ নেতৃবৃন্দকে পরিস্থিতি অবহিত করে আশু করণীয় সম্পর্কে দিকনির্দেশনা দেন এবং থানা আওয়ামী লীগের সম্পাদক হিসাব উদ্দীনকে সব খবর জানিয়ে যান। স্বাধীনতাকামী জনতাকে জাগিয়ে তুলে প্রতিরোধের প্রস্তুুতি গ্রহণের কথা বলতে মহকুমা প্রশাসক নিজেই গাড়ি হাকিয়ে ছুটে যান আমঝুপি, বারাদী, রাজনগর প্রভৃতি এলাকায় ।
প্রকৃতপক্ষে মেহেরপুর শহরের ভৌগোলিক অবস্থানটাই এমন যে, কুষ্টিয়া এবং চুয়াডাঙ্গার সঙ্গে সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করতে পারলেই যেন অনেকাংশেই নিরাপত্তা নিশ্চিত হয়। তাছাড়া মাত্র দু তিন মাইলের মধ্যে ভারতীয় সীমান্ত অতিক্রম করলেই বেতাই কৃষ্ণনগর হয়ে কলকাতার সঙ্গে সহজ যোগাযোগও সম্ভব। ভারতীয় সীমান্ত ঘেঁষে মেহেরপুর জেলার প্রায় ৪০ মাইল সীমানা অবস্থিত, প্রয়োজন হলে অতি সহজেই সীমান্ত পেরিয়ে ভারতে আশ্রয় নেয়া যেতে পারে। তাই সব কিছুর আগে কুষ্টিয়া এবং চুয়াডাঙ্গার সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করার দিকেই মনোযোগ দেয়া হয়।
২৫ মার্চ গভীর রাতে ‘পাকিস্থান সরকারের কর্মচারি নই’ বলে ঘোষণা করার পর মেহেরপুরের মহকুমা প্রশাসক তৌফিক -ই- এলাহী চৌধুরী ২৬ মার্চ সকালে মহকুমা প্রশাসকের কার্যালয়ে বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করেন এবং এরপর থেকে নিজ গাড়িতে সর্বদা এই নতুন পতাকা ব্যবহার করতে থাকেন।
১০ই এপ্রিল গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার গঠনের পর কলকাতায় প্রবাসী সরকার ভারতীয় সরকারের সহযোগিতায় সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন যে, মেহেরপুরের সীমান্ত এলাকায় স্থান নির্বাচন করার পর সেখানে নবগঠিত সরকারের সকলে শপথ গ্রহণ করবেন। অনেকেই আজো প্রশ্ন করে থাকেন সারা বাংলাদেশের বিভিন্ন সীমান্ত অঞ্চল থাকা সত্ত্বেও মেহেরপুরের এই সীমান্তে শপথ অনুষ্ঠানের জন্য কেন স্থান নির্ধারণ করা হলো? সড়ক পথে বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলের বিভিন্ন সীমান্তে যোগাযোগের সুবিধের মধ্যে যশোরের বেনাপোল অন্যতম অবস্থা থাকলেও যশোর ক্যান্টনমেন্ট তখনও পাক বাহিনীর বিশাল শক্তিশালী পদাতিক ও বিমানঘাটি বিদ্যমান ছিল।
সেই হিসেবে সে অঞ্চল কোন অবস্থাতেই তৎকালীন সময়ে নিরাপদ মনে করা সম্ভব হয়নি। অপরদিকে মেহেরপুর- চুয়াডাঙ্গার বেসামরিক প্রশাসনিক ব্যবস্থায় বৃহত্তর কুষ্টিয়া, ঝিনাইদহ এবং মাগুরা অঞ্চলে পাকবাহিনীর পতনের ফলে স্বাধীনতাযুদ্ধের প্রাথমিক পর্যায়ে এদিকে মুক্ত থাকায় রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের এ অঞ্চলে পদচারণা ও সুযোগ- সুবিধে বেশী ছিল।
১৭ ই এপ্রিল মুজিবনগরে বাংলাদেশ সরকারের আনুষ্ঠানিক আত্মপ্রকাশ ও শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানের প্রারম্ভিক পর্যায় বর্ণনা প্রসংঙ্গে তৌফিক-ই-এলাহী চৌধুরী বলেছেনঃ
‘‘সকাল ন’টার দিকে জনাব তাজউদ্দিন আহমদ, সৈয়দ নজরুল ইসলাম অন্যান্যদের সাথে নিয়ে সেখানে পৌঁছলেন। আমি তাঁদের নিয়ে এলাম বৈদ্যনাথতলার অঅ¤্রকাননে। ওখানে আশপাশের গ্রাম থেকে কিছু চেয়ার সংগ্রহ করে আনা হলো। সংগৃহিত চেয়ারের মধ্যে সবগুলি পূর্ণাঙ্গ নয়।
কোনোটার একটা হাতল নেই কোনোটার এক পায়া খোয়া গিয়েছে। মঞ্চ প্রহরার জন্য নিয়োজিত আনসারদের জন্য কিছু রান্না হয়েছিল। বেলা প্রায় এগারটা নাগাদ বহু প্রতীক্ষিত অনুষ্ঠান শুরু হলো। আমি জিপে জনাব তাজউদ্দিন আহমদ, সৈয়দ নজরুল ইসলাম, জেনারেল এম.এ.জি. ওসমানী ও অন্যান্য কয়েকজনকে মঞ্চের ৫০ গজের মধ্যে তোরণের কাছে নিয়ে এলাম’’।
ক্যাপ্টেন মাহবুবউদ্দিন আহমেদ ইপিআর-আনসারের একটি ছোট্ট দল নিয়ে নেতৃবৃন্দকে অভিবাদন জানানোর জন্য প্রস্তুত ছিলেন। মেজর আবু ওসমান চৌধুরীর পৌঁছতে বিলম্ব হবার কারণে ক্যাপ্টেন মাহবুব তাঁর ঐ ছোট্ট দলটি নিয়েই অভিবাদন জানান। এ দলের আনসারদের মধ্যে ছিলেন মীর ইয়াদ আলী, আরজউল্লাহ আজিমউদ্দিন, সাহেব আলী, অস্থির মল্লিক, লিয়াকত আলী, ফকির মোহম্মদ, হামিদুল হক, নজরুল ইসলাম, মফিজ উদ্দিন, সিরাজুল ইসলাম ও আরশাদ আলী। অভিবাদন গ্রহণের পর সৈয়দ নজরুল ইসলাম বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা উত্তোলন করেন ।
এই সঙ্গে শুরু হয় স্থানীয় শিল্পীদের পরিবেশনায় জাতীয় সংগীত। শাহাবউদ্দিন আহমদ সেন্টু তার সঙ্গী আসাদুল হক, মনসুর আলী, পিন্টু বিশ্বাস প্রমুখ শিল্পীদের নিয়ে রাস্তার পাশে গাছের ছায়ায় বসে আগে থেকেই রিহার্সেল করছিলেন। আওয়ামী লীগের স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী প্রধান আব্দুর রাজ্জাকের নির্দেশে শিল্পীরা গাইতে শুরু করে। এরপর ভাবগম্ভীর পরিবেশে মাইক্রোফোনে উচ্চারিত হয় জাতীয় নেতৃবৃন্দের নাম । মঞ্চে উঠে এসে আসন গ্রহণ করেন সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দিন আহমদ, এ.এইচ. এম. কামরুজ্জামান, ক্যাপ্টেন মনসুর আলী, খোন্দকার মোশতাক আহমদ এবং কর্নেল এম.এ.জি ওসমানী।
এরপর আওয়ামী লীগের চিফ হুইপ অধ্যাপক মোঃ ইউসুফ আলী বাংলার মুক্ত মাটিতে স্বাধীনতাকামী কয়েক হাজার জনতা এবং শতাধিক দেশী বিদেশী সাংবাদিকের সম্মুখে দাড়িয়ে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র পাঠ করেন।
উক্ত ঘোষণাপত্রে প্রদত্ত ক্ষমতাবলে অধ্যাপক ইউসুফ আলী রাষ্ট্র প্রধানের অনুপস্থিতিতে উপ-রাষ্ট্রপ্রধানা হিসাবে সৈয়দ নজরুল ইসলামকে শপথ বাক্য পাঠ করান। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের উপ-রাষ্ট্রপ্রধানান এবং অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম এরপর সরকারের প্রধানমন্ত্রী হিসাবে তাজউদ্দিন আহমেদের নাম ঘোষণা করেন এবং প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে পরামর্শক্রমে মন্ত্রিপরিষদের অন্যান্য সদস্যগনের নাম ঘোষণা করে উপস্থিত সুধি, দেশী বিদেশী সাংবাদিক ও জনতার সামনে সবার পরিচয় করিয়ে দেন।
উপস্থিত সকলে বিপুল করতালিতে নতুন মন্ত্রিপরিষদকে অভিনন্দিত করেন । বক্তৃতা পর্বে প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমেদ বিশ্ববিবেকের কাছে বাংলাদেশের সংঘটিত পৃথিবীর নিষ্ঠুরতম গণহত্যার বিবরণ তুলে ধরেন। প্রধানমন্ত্রী দ্ব্যর্থহীন কন্ঠে ঘোষণা করেন স্বাধীন বাংলাদেশ আজ একটা বাস্তব সত্য। ৭.৫ কোটি বাঙালি অজেয় মনোবল ও সাহসের মাধ্যমে স্বাধীন বাংলাদেশের জন্ম দিয়েছে। বক্তৃতা শেষে ঘোষণা দেন আজ থেকে স্বাধীন বাংলাদেশের রাজধানী হবে এই বৈদ্যনাথতলা এবং এর নতুন নাম হবে মুজিবনগর। ‘মুজিবনগর’ পত্রিকা অবলম্বনে।