মুখোমুখি বাবুনগরী-সাদ-বিশ্ব ইজতেমার আগেই মাঠ গরম !
লাবণ্য চৌধুরী : এবার বিশ্ব ইজতেমার আগেই মুখোমুখি মাওলানা বাবুনগরী ও মাওলানা সাদ। ইতিমধ্যে বলা হয়েছে, কেউ যদি রক্ত চক্ষু দেখায়, তবে আমরা তাদের চক্ষু উপড়ে ফেলব বলেও জানিয়েছে হেফাজতের শীর্ষ নেতৃত্ব। তবে মাওলানা সাদের বক্তব্যে এখনো মেলেনি। তিনি কি বলেন সেটাই এখন দেখার বিষয় বলে অভিমত প্রকাশ করেছেন আলেম ওলামারা।
মাওলানা সাদ কান্ধলভী তার গোমরাহী বক্তব্য থেকে তওবা না করলে তাকে বাংলাদেশে ঢুকতে দেওয়া হবে না বলে হুঁশিয়ারি দিয়েছেন হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের আমির মাওলানা শাহ মুহিবুল্লাহ বাবুনগরী। মঙ্গলবার (৫ নভেম্বর) রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ওলামা মাশায়েখ বাংলাদেশের উদ্যোগে অনুষ্ঠিত ‘দাওয়াত ও তাবলিগ, মাদারেসে কওমিয়া এবং দ্বীনের হেফাজতের লক্ষ্য’ শীর্ষক সম্মেলনে সভাপতির বক্তব্যে হেফাজত আমির এ কথা বলেন। আমিরের বক্তব্য পাঠ করেন মাওলানা আজিজুল হক ইসলামাবাদী।
শাহ মুহিবুল্লাহ বাবুনগরী বলেন, সরকারের প্রতি আমার দাবি, তওবা না করা পর্যন্ত যেনো মাওলানা সাদকে বাংলাদেশে আসতে দেওয়া না হয়। টঙ্গীর বিশ্ব ইজতেমা আলেমদের তত্ত্বাবধানে শুরায়ে নেজাম দ্বারা পরিচালিত হবে। কাকরাইল মারকাজের কার্যক্রম ওলামায়ে কেরামের তত্ত্বাবধানে চালু রাখতে হবে।
হেফাজত আমির বলেন, ওলামায়ে কেরামের দাওয়াতের মাধ্যমেই আজ সারা বিশ্বের প্রতিটি প্রান্তে কোরআন ও সুন্নাহর বাণী পৌঁছেছে। আলোকিত হয়েছে সারা বিশ্ব। দাওয়াতের উদ্দেশ্য হচ্ছে খালেকের সঙ্গে মাখলুকের তায়াল্লুক সৃষ্টি করে দেওয়া। আত্মভোলা মানবজাতিকে সঠিক পথের দিশা দেওয়া। এই দায়িত্ব আমার আপনার এবং উম্মতে মোহাম্মদী সবার। এই দায়িত্ব পালনের জন্যই মাওলানা ইলিয়াস (রহ.) তাবলিগের কাজ শুরু করেছেন।
দিল্লির নিজামুদ্দিন মারকাজের বর্তমান মুরুব্বি মাওলানা সাদ বিভিন্ন সময় কোরআন, হাদিস, ইসলাম, নবী-রাসুল, নবুয়ত, সাহাবায়ে কেরাম এবং শরয়ী মাসআলা-মাসায়েল নিয়ে আপত্তিকর মন্তব্য করেছেন। তার বক্তব্যগুলো কোরআন-সুন্নাহবিরোধী, যা মেনে নেওয়া যায় না’- উল্লেখ করেন হেফাজতের আমির।হেফাজত আমির আরও বলেন, ব্যক্তি মাওলানা সাদের কারণে ছাত্র-জনতা ও আলেম-ওলামাদের আত্মত্যাগে অর্জিত স্বাধীন নতুন বাংলাদেশে বিশৃঙ্খলা তৈরি হোক এবং অন্তর্বর্তী সরকার বেকায়দায় পড়ুক আমরা সেটা চাই না। আশা করি সার্বিক বিবেচনায় সরকার সঠিক সিদ্ধান্ত নেবে।
হেফাজতে ইসলামী বাংলাদেশের যুগ্ম মহাসচিব জুনায়েদ আল হাবিব বলেন, আমরা ১৫ বছর ধরে ফ্যাসিস্টদের বিরুদ্ধে লড়াই করে এ সরকারকে বসিয়েছি। কেউ যদি রক্ত চক্ষু দেখায়, তবে আমরা তাদের চক্ষু উপড়ে ফেলব। জাতির পথপ্রদর্শক হবে আলেমরা। তাবলিগের রাহবারও আলেমদের থেকেই হবে, অন্য কেউ নয়। যতটুকু সম্ভব, তাবলিগের সিদ্ধান্ত আলেমদের ঘোষণার ভিত্তিতে কার্যকর হবে।
এ সময় কাকরাইল মসজিদ, টঙ্গীর ইজতেমা নিয়ে কথা বলেন আলেমরা। তারা দাবি তুলে বলেন, ওলামা-কেরামের নেতৃত্বে কাকরাইল মসজিদ চলবে, ইজতেমাও আলেমদের দ্বারা পরিচালিত হবে।উল্লেখ্য, তাবলিগের দুপক্ষের জন্য ২০১৯ সাল থেকে বিশ্ব ইজতেমা দুই পর্বে অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে। প্রতিবার দ্বিতীয় পর্বে ইজতেমা করেন মাওলানা সাদ কান্ধলভীর অনুসারীরা। এবার তারা প্রথম পর্বে ইজতেমা করার দাবি জানান। তারই বিরোধিতা করে এই মহাসম্মেলনের ডাক দেন কওমি মাদ্রাসাভিত্তিক আলেমরা।
নেপথ্যে ঘটনা-
কে এই মাওলানা সাদ কান্ধলভি? তার পুরো নাম মুহাম্মদ সাদ কান্ধলভি। ভারতের পশ্চিম-উত্তর প্রদেশের শামলী জেলার কান্ধলা শহরে তিনি ১৯৬৫ সালের ১৩ মে (১৩৮৫ হি.) জন্মগ্রহণ করেন। মাওলানা সাদ কান্ধলভি তাবলিগ জামাতের প্রতিষ্ঠাতা মুরব্বি হজরতজি মাওলানা ইলিয়াস রহ.-এর বংশধর। তার পিতা হজরত মাওলানা হারুন কান্ধলভি রহ. ছিলেন তাবলিগ জামাতের প্রাক্তন আমীর হজরত ইউসুফ কান্ধলভি রহ.-এর একমাত্র ছেলে। আর ইউসুফ রহ. ছিলেন মাওলানা ইলিয়াস কান্ধলভির ছেলে।
এত বিতর্ক কেন?
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, দিল্লির মাওলানা মুহাম্মাদ সাদ কান্ধলভি নানা সময়ে বিভিন্ন বিষয়ে বিভ্রান্তিমূলক বক্তব্য দিয়ে আসছিলেন। সময়ে সময়ে কুরআন-হাদিস বিরোধী তার নানা বক্তব্য নেট দুনিয়ায় ছড়িয়ে পড়ায় বিশ্বজুড়ে তাকে নিয়ে বিতর্কের সূত্রপাত ঘটে।
যখন থেকে বিতর্কের শুরু-
তাবলিগের তৃতীয় মুরব্বি হজরত মাওলানা এনামুল হাসান রহমাতুল্লাহি আলাইহির ইন্তেকালের পর থেকেই কিছুটা জটিলতা শুরু হয়। মাওলানা এনামুল হাসান রহমাতুল্লাহি আলাইহি ইন্তেকালের ২ বছর আগে অর্থাৎ ১৯৯৩ সনে তাবলিগের কাজ সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার জন্য ১০ সদস্য বিশিষ্ট একটি শুরা কমিঠি গঠন করেছিলেন। তন্মধ্যে ভারতের নিজামুদ্দিনের ছিলেন ৫ জন। পাকিস্তানের ৪ জন এবং বাংলাদেশের ১ জন।
এ ১০ জন শুরা সদস্যের মধ্যে বয়স ও অভিজ্ঞতায় সবার ছোট ছিলেন মাওলানা সাদ কান্ধলভি। শুরা কমিটির ১০ জনের একজন হিসেবে তিনি বেশ কিছু দায়-দায়িত্ব পালনের সুযোগ লাভ করেন। এ সুযোগে তিনি তাবলিগের বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে পরিবর্তন আনতে শুরু করেন এবং তার বক্তব্যে দেখা দেয় কুরআন-হাদিসের সঙ্গে নানা অসঙ্গতি। এতে করে অনেক আগে থেকেই বিভিন্ন সমস্যা সৃষ্টি হতে থাকে।
হজরত এনামুল হাসান রহমাতুল্লাহি আলাইহি কর্তৃক নির্ধারিত ১০ শুরা সদস্যরাও পর্যায়ক্রমে ইন্তেকাল করতে থাকেন। কিন্তু তাদের ইন্তেকালের পর নতুন কোনো শুরা সদস্য যুক্ত না হওয়ায় এক সময় তিনি তাবলিগ জামাতের একক মুরব্বি হয়ে উঠেন। তবে এই ইতিহাস নিয়ে পক্ষে-বিপক্ষে নানা বিতর্ক আছে।
বিশ্ববিখ্যাত ঐতিহ্যবাহী ইসলামী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান দারুল উলুম দেওবন্দ মাওলানা সাদের বেশ কিছু বক্তব্যকে ইসলামী দৃষ্টিকোণ থেকে অগ্রহণযোগ্য বলে রায় দিয়ে তাকে নানা সময়ে সতর্ক করে আসছে। এক পর্যায়ে ২০১৭ সালের ডিসেম্বরে জারি করা এক সতর্কবার্তায় মাওলানা সাদের কড়া সমালোচনা করেছে দেওবন্দের ফতোয়া বিভাগ।