মিতিল-পুরুষ বেশে বিরল মুক্তিযোদ্ধা-দেখিয়েছিল যুদ্ধে যাওয়ার সাহস-
নিউইয়র্ক প্রতিনিধি : রণাঙ্গনে পুরুষ সেজে যুদ্ধ করতে যাওয়ার মতো সাহস শিরিন বানুরই ছিল। শিরিন বানুদের কাছে জীবনের চেয়ে দেশের মূল্যই ছিল সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। অসীম সাহসিকতা নিয়ে দেশমাতৃকার জন্য জীবন বাজি রেখেছিলেন তিনি।
সময়ের এ সন্তানদের ঋণ শোধ হওয়ার নয়। মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে সদা সমুন্নত রেখে শিরিন বানুদের ত্যাগ তিতিক্ষার প্রতি সম্মান দেখাতে হবে। আমাদের দায়বদ্ধতা থেকেই দেশ মাতৃকার জন্য বীর সন্তানদের আমরা সর্বোচ্চ সম্মান দেখিয়ে যাব।
‘মুক্তিযোদ্ধা শিরিন বানু মিতিল স্মরণ ও বই পরিচিতি’ অনুষ্ঠানে বক্তারা এসব কথা বলেন। নিউইয়র্কের জ্যাকসন হাইটসের বাংলাদেশ প্লাজায় সোমবার সন্ধ্যায় এ স্মরণসভার আয়োজন করা হয়। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন ‘সাপ্তাহিক ঠিকানা’র প্রধান সম্পাদক মুহাম্মদ ফজলুর রহমান।
প্রধান আলোচক ছিলেন নিউইয়র্ক সফররত ‘পাবনা জেলার মুক্তিযুদ্ধের কথা’ বইয়ের লেখক মুক্তিযোদ্ধা মো. জহুরুল ইসলাম বিশু। মঞ্চে উপস্থিত ছিলেন শহীদ বুদ্ধিজীবী সাংবাদিক সিরাজুদ্দীন হোসেনের ছেলে ফাহিম রেজা নূর। সভা সঞ্চালনা করেন গোপাল স্যানাল। শিরিন বানু মিতিলকে স্মরণ করে স্মরণপত্র পাঠ করেন স্বীকৃতি বড়ুয়া। নিউইয়র্কের পাবনা এডওয়ার্ড কলেজ প্রাক্তন শিক্ষার্থীবৃন্দ এ সভার আয়োজন করেন। সভার শুরুতেই প্রয়াত এই মুক্তিযোদ্ধার স্মরণে এক মিনিট নীরবতা পালন করা হয়।
বক্তারা বলেন, ১৯৭১ সালে ২৫ মার্চ কালরাতে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর আক্রমণ শুরু হলে ২৭ মার্চ পাবনা পুলিশ লাইনে প্রতিরোধ যুদ্ধে সর্বস্তরের মানুষ অংশ নেন। সেই যুদ্ধে শিরিন বানু মিতিল বীরকন্যা প্রীতিলতাকে অনুসরণ করে পুরুষ বেশে অংশ নেন।
পরদিন পাবনা টেলিফোন এক্সচেঞ্জে ৩৬ জন পাকিস্তানি সেনার সঙ্গে জনতার তুমুল যুদ্ধ হয়, যাতে তিনিই ছিলেন একমাত্র নারী যোদ্ধা। এই যুদ্ধে ৩৬ জন পাকিস্তানি সেনা নিহত এবং ২ জন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন।
স্মরণসভার প্রধান আলোচক মুক্তিযোদ্ধা মো. জহুরুল ইসলাম বিশু বলেন, ৭১ সালের ৯ এপ্রিল নগরবাড়িতে যুদ্ধের সময় পাবনার পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটে স্থাপিত মুক্তিযুদ্ধের কন্ট্রোল রুমের পুরো দায়িত্বে ছিলেন তিনি। এরপর ভারতের ‘স্টেটসম্যান’ পত্রিকায় তাঁর ছবিসহ পুরুষ সেজে যুদ্ধ করার খবর প্রকাশিত হলে সেই বেশে আর যুদ্ধ করা তাঁর পক্ষে সম্ভব হয়নি।
কিন্তু তাতে তিনি দমেননি, পাবনা শহর পাকিস্তানি সেনারা দখলে নিলে ২০ এপ্রিল তিনি সীমান্ত পেরিয়ে ভারতে যান। সেখানে বাংলাদেশ সরকার পরিচালিত নারীদের একমাত্র প্রশিক্ষণ শিবির ‘গোবরা ক্যাম্পে’ যোগ দেন। প্রশিক্ষণ নিয়ে মেজর জলিলের নেতৃত্বে পরিচালিত ৯ নম্বর সেক্টরে যোগ দেন।
মুক্তিযোদ্ধা ও নারীনেত্রী শিরিন বানু মিতিল গত ২০ জুলাই মারা যান। মুক্তিযুদ্ধ যখন শুরু হয়, সেই ১৯৭১ সালে পাবনা জেলা ছাত্র ইউনিয়নের সভানেত্রী ছিলেন তিনি। তাঁর মা সেলিনা বানু বামপন্থী আন্দোলনের প্রথম সারির নেত্রী ছিলেন। নানার বাড়ি ছিল এককালে বামপন্থীদের শক্ত ঘাঁটি। এমনই রাজনৈতিক পরিবারে বেড়ে উঠেছিলেন মিতিল।
শিরিন বানু মিতিলের জন্ম ১৯৫১ সালের ২ সেপ্টেম্বর। তাঁর বাবা খোন্দকার শাহজাহান মোহাম্মদ ও মা সেলিনা বানু দুজনেই সক্রিয় রাজনীতিতে যুক্ত ছিলেন। স্কুলজীবনেই ছাত্র ইউনিয়নে যোগ দেওয়া শিরিন বানু মিতিল মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে পাবনা এডওয়ার্ড কলেজের বাংলা বিভাগের প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী ছিলেন।
তিনি ১৯৭০-৭৩ সাল পর্যন্ত পাবনা জেলা ছাত্র ইউনিয়নের সভানেত্রী ও কিছু সময়ের জন্য পাবনা জেলা মহিলা পরিষদের যুগ্ম সম্পাদক ছিলেন। এ ছাড়া তিনি সেক্টর কমান্ডারস ফোরামের কেন্দ্রীয় নারী কমিটির সভানেত্রী হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন।