মাসুদা অপহরণেএক্স স্বামীর চাল-গাড়িচালক মাসুদ সব ফাঁস করেছে র্যাবকে
স্টাফ রিপোর্টার : সাবেক অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা হারুন অর রশিদের রাগ-ক্ষোভের শিকার হয়ে অপহৃত হয়েছিলেন জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) যুগ্ম কমিশনার মাসুমা খাতুন। অপহরণের ঘটনায় দায়েরকৃত মামলায় মূলহোতা সাবেক গাড়িচালক মাসুদ গ্রেফতারের পর র্যাবকে এই তথ্য জানান তিনি। সাবেক স্ত্রীকে উচিত শিক্ষা দিতে হারুন অর রশিদ এমনটি করেছে বলে দাবি করেছে প্রধান আসামি মাসুদ।শনিবার ২৬ আগস্ট দুপুরে রাজধানীর কারওয়ান বাজারে র্যাব মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে একথা বলেন সংস্থাটির আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন।
তিনি বলেন, নারী কর্মকর্তা মাসুমাকে অপহরণের ঘটনায় রমনা মডেল থানায় ৬ জনকে আসামি করে মামলা দায়ের করা হয়। ওই মামলায় পুলিশ সাইফুল ইসলাম, আবু বক্কর সিদ্দিক ওরফে সাব্বির ও ইয়াছিন আরাফাত রাজুকে গ্রেফতার করা হয়। কিন্তু প্রধান আসামি মাসুদ পলাতাক ছিল। তাকে গতকাল শুক্রবার অভিযান চালিয়ে তার দুই সহযোগীসহ গ্রেফতার করা হয়েছে। গ্রেফতারকৃতরা হলেন- মো. মাসুম ওরফে মাসুদ (৪২), আব্দুল জলিল ওরফে পনু (৪৮) এবং হাফিজ ওরফে শাহনি (৪৮)।
কমান্ডার আল মঈন বলেন, গত ১৭ আগস্ট রাত সোয়া ৮টার দিকে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) একজন যুগ্ন কর কমিশনার রাজধানীর মগবাজার এলাকা থেকে অপহৃত হন।
অপহরণের ১৮ ঘণ্টা পর ১৮ আগস্ট রাজধানীর মাদারটেক এলাকা থেকে স্থানীয় লোকজন তাকে উদ্ধার করে। এ ঘটনায় ভুক্তভোগী নারী নিজেই তার সাবেক গাড়ি চালক মাসুদ ও তার সহযোগীদের বিরুদ্ধে বাদী হয়ে রাজধানীর রমনা থানায় নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে একটি মামলা করেন। আটক সাইফুল ইসলাম, আবু বকর সিদ্দীক ও ইয়াছিন আরাফাত ওরফে রাজুকে গ্রেফতার দেখায় রমনা থানা পুলিশ। তবে এই ঘটনায় জড়িত শান্ত পলাতক।
তিনি বলেন, শুক্রবার (২৬ আগস্ট) গভীর রাতে মামলার প্রধান আসামি মাসুম ওরফে মাসুদ সহযোগী আব্দুল জলিল ও হাফিজকে গ্রেফতার করা হয়। গ্রেফতার মাসুদ পূর্বে ভুক্তভোগীর ব্যক্তিগত গাড়ির ড্রাইভার হিসেবে কর্মরত ছিলেন। গত ১ আগস্ট ব্যক্তিগত শৃঙ্খলাজনিত কারণে ভুক্তভোগী তাকে চাকরি থেকে অব্যাহতি দেন। ফলে গ্রেফতার মাসুদের মধ্যে ভুক্তভোগীর প্রতি ব্যক্তিগত ক্ষোভ ও আক্রোশের জন্ম হয়।
তিনি আরও বলেন, জিজ্ঞাসাবাদে গ্রেফতার মাসুদ জানান, তাকে চাকরিচ্যুতির পর ভুক্তভোগীর প্রথম স্বামী হারুন অর রশিদের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। ভুক্তভোগী নারী কর কর্মকর্তাকে ‘উচিত শিক্ষা’ দিতে রাজধানীর হাতিরঝিল এলাকার একটি বাসায় নিয়ে যাওয়ার জন্য মাসুদকে বিপুল পরিমান অর্থ ও উন্নত জীবনের প্রলোভন দেখানো হয়। হারুন এ জন্য অগ্রিম ৭০ হাজার টাকা দেন। কাজের পরে তাকে আর ড্রাইভিং করতে হবে না ও উন্নত জীবনযাপন করার সব ব্যবস্থা করে দেবেন বলে আশ্বাস দেন।
কমান্ডার আল মঈন বলেন, গত ১৫ আগস্ট রাজধানীর সবুজবাগ এলাকায় মাসুদ তার পরিচিতি হাফিজ, পনু, রাজু, সাব্বির, সাইফুল ও শান্তকে পরিকল্পনার কথা জানান ও সবাইকে টাকা ভাগ করে দেন। তারা রাজধানীর বেইলী রোড এলাকা থেকে ভুক্তভোগীকে অপহরণের সিদ্ধান্ত নেয়। ভুক্তভোগীর বর্তমান গাড়ি চালকের সঙ্গে গ্রেফতারকৃত হাফিজের সুসম্পর্ক থাকায় ভুক্তভোগীর অবস্থান গাড়ি চালক থেকে জেনে মাসুদকে জানান।
তিনি আরও বলেন, পরিকল্পনা অনুযায়ী, গত ১৭ আগস্ট রাত ৮টার দিকে তারা রাজধানীর বেইলী রোড এলাকায় অবস্থান নেয়। ভুক্তভোগী রাত সোয়া ৮টার দিকে রাজধানীর মগবাজার থেকে নিজ গাড়িযোগে বেইলী রোড এলাকায় পৌঁছলে একটি মোটরসাইকেল ও একটি রিকশা দিয়ে ভুক্তভোগীর গাড়ির সঙ্গে লাগিয়ে দিয়ে দুর্ঘটনার নাটক সাজিয়ে গতিরোধ করে। এসময় ভুক্তভোগীর ড্রাইভার মোটরসাইকেল ও রিকশা সরানোর জন্য নামলে তাকে মারধর করে। মাসুদ গাড়ির ড্রাইভিং সিটে বসে গাড়ির নিয়ন্ত্রণ নিয়ে সহযোগীদের নিয়ে ভুক্তভোগী নারীকে অপহরণ করে হাতিরঝিলের উদ্দেশ্যে রওনা দেন।
র্যাবের পরিচালক বলেন, নারী কর কর্মকর্তাকে অপহরণের পরই বিষয়টি প্রথম স্বামী হারুনকে জানানো হয়। পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী, আগেই ৫০ হাজার টাকায় হাতিরঝিলে ভাড়া করা একটি বাসার ঠিকানায় নেওয়ার কথা জানান হারুন। কিন্তু সেখানে বাসার মেইন গেট বন্ধ পাওয়ায় ভুক্তভোগীকে নিয়ে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় গাড়িতে করে ঘুরে সময়ক্ষেপণ করতে থাকে তারা।
তিনি বলেন, সাবেক স্বামীর পরিকল্পনা অনুযায়ী, মাসুমাকে অপহরণ করতে হাতিরঝিলে ৫০ হাজার টাকায় একটি বাসা ভাড়া নেয় চক্রটি।
আর কৌশলে নেওয়া হয় ভুক্তভোগী মাসুমার সাবেক ড্রাইভার মাসুদকে। মাসুদের নেতৃত্বে অপহরণ মিশনে অংশ নেয় মোট সাতজন। গত ১৭ আগস্ট অপহরণের রাতে তাকে ওই বাসায় নেওয়া সম্ভব না হওয়ায় নারায়ণগঞ্জের কাঁচপুর এলাকার একটি গ্যারেজে নেওয়া হয় এবং সেসময় গাড়িতেই করা হয় মারধর।
পরদিন মাদারটেক এলাকায় যাওয়ার পর সেখানে ওই নারী কর্মকর্তার চিৎকারে এলাকাবাসীর হাতে আটক হয় তিনজন। পালিয়ে যায় সাবেক ড্রাইভার মাসুদসহ চারজন। অপহরণ ও নির্যাতনের ঘটনায় এরপর মাসুমা রমনা থানায় মামলা করেন। মামলার প্রধান আসামি মাসুম ওরফে মাসুদসহ জড়িত তিনজনকে গ্রেফতারের পর এসব তথ্য জানিয়েছে র্যাব।
কমান্ডার মঈন বলেন, গ্রেফতার মাসুদের দেওয়া তথ্যমতে, বাসায় ঢুকতে না পারায় সাবেক স্বামী হারুন ভুক্তভোগী নারীকে রাতে অন্যত্র রাখার নির্দেশ দিলে মাসুদ গাড়িসহ রাত ১২টার দিকে কাঁচপুর এলাকায় পরিচিত একটি গ্যারেজে নিয়ে যায়। সেখানে নেওয়ার পথে অপহৃত নারীকে নির্যাতন করা হয়, প্রাণনাশের হুমকি দিয়ে ভুক্তভোগীর কাছে ৫০ লাখ টাকা মুক্তিপণ দাবি করে তারা। তার কাছে থাকা নগদ দেড় লাখ টাকা ও মোবাইল ফোন ছিনিয়ে নেওয়া হয়।
পরদিন ১৮ আগস্ট সকাল সাড়ে ১০টার দিকে রাজধানীর মাদারটেক এলাকায় যায় তারা। সেখানে জুম্মার নামাজ পর্যন্ত অবস্থান করে। এ সময় গ্রেফতার মাসুদ ভুক্তভোগীর প্রথম স্বামীর সঙ্গে পুনরায় যোগাযোগ করেন। তিনি জুম্মা নামাজের পর হাতিরঝিলের সেই আগের বাসায় নেওয়ার নির্দেশ দেন।
দুপুরে খাবার সময় হলে মাসুদ, রাজু ও সাব্বির খাবার আনতে যায় এবং পনু, সাইফুল ও শান্ত গাড়ি বাহিরে পাহারায় থাকে। এসময় সুযোগ বুঝে ভুক্তভোগী বাঁচাও বাঁচাও বলে চিৎকার শুরু করলে স্থানীয় লোকজন ভুক্তভোগীকে উদ্ধার করে সাইফুল, সাব্বির ও রাজুকে আটক করে। মাসুদ, পনু ও শান্ত পালিয়ে যায়। পরবর্তীতে পুলিশ এসে ভুক্তভোগীকে হেফাজতে নেয় এবং সাইফুল, সাব্বির ও রাজুকে গ্রেফতার করে। তাদের কাছ থেকে ভুক্তভোগীর ল্যাপটপ ও মোবাইল ফোন উদ্ধার করে।
কমান্ডার মঈন বলেন, ২৫ বছর ধরে পেশায় গাড়ি চালক মাসুদ পূর্বে বাস, ট্রাকসহ বিভিন্ন ধরনের ভারী যানবাহন চালিয়েছেন। পরবর্তীতে বাস চালানোর সময় একটি সড়ক দুর্ঘটনায় কয়েকজনের নিহতের ঘটনায় তার নামে মামলা হলে তার ভারী যান চালানোর লাইসেন্স বাতিল হয়। এছাড়াও গাড়ি চুরিসহ এলাকায় বিভিন্ন ধরনের অপকর্মের সঙ্গে জড়িত মাসুদ।
তিনি বলেন, রাজধানীর বাবু বাজার এলাকায় তার এক বন্ধুর বাসায় এবং গাজীপুর শ্রীপুর এলাকায় তার এক আত্মীয়ের বাসায় আত্মগোপনে ছিলেন মাসুদ। পরবর্তীতে গাজীপুরের শ্রীপুর এলাকা থেকে তাকে গ্রেফতার করা হয়। আর পনু পেশায় একজন সিএনজিচালক। একই এলাকায় বসবাস করার কারণে গ্রেফতার মাসুদের সঙ্গে সুসম্পর্ক ছিল। অপহরণের ঘটনায় গ্রেফতার মাসুদ তাকে সাড়ে ৬ হাজার টাকা অগ্রিম প্রদান করে। এছাড়া হাফিজ দূরপাল্লার বাসচালক।
২০২২ সালে ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে সিলেট যাওয়ার পথে সড়ক দুর্ঘটনার ফলে তার চাকরি চলে যায়। অপহরণের ঘটনায় তিনি পেয়েছেন মাত্র ৫ হাজার টাকা।নারী কর কর্মকর্তাকে অপহরণের মূল পরিকল্পনাকারী সাবেক স্বামী হারুন কোথায়? জানতে চাইলে কমান্ডার মঈন বলেন, তিনি মগবাজারের বাসাতেই অবস্থান করছেন বলে জেনেছি। অপহরণে তার সংশ্লিষ্টতার তথ্য পেয়েই কেন এখনো তাকে গ্রেফতার করা হয়নি?
জানতে চাইলে কমান্ডার মঈন বলেন, মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা জানাতে পারে। তবে র্যাব গ্রেফতারের পর মামলার মূল আসামি মাসুদ শনিবার ২৬ আগস্ট সকালে নারী কর কর্মকর্তা অপহরণে মূল পরিকল্পনাকারী হিসেবে সাবেক স্বামী হারুনের সম্পর্কে তথ্য দিয়েছে। হারুনের নাম মামলার এজাহারে নেই। যে কারণে প্রাপ্ত তথ্য তদন্ত সংস্থাকে জানানো হবে। তদন্ত সংশ্লিষ্ট পুলিশ এ ব্যাপারে ব্যবস্থা নেবেন।