• রোববার , ১৭ নভেম্বর ২০২৪

মালেক মাঝি ও রোকেয়ার পেটে ১০০ কোটি টাকার সরকারি গম


প্রকাশিত: ৩:৩৮ এএম, ১৫ জুলাই ১৬ , শুক্রবার

নিউজটি পড়া হয়েছে ৩৪৫ বার

এস রহমান/সাইফুল বারী মাসুম  :  এটা যেন হাইভোল্টেজ প্রতারণা-। মালেক মাঝি ও রোকেয়ার wheet carier ship-www.jatirkhantha.com.bdপেটে চলে গেছে ১০০ কোটি টাকার সরকারি গম। অবিশ্বাস্য হলেও ঘটনা সত্য। চক্রটির বিরুদ্ধে রহস্যজনক নিরব সরকারি কর্তৃপক্ষ’ও। গ্রেফতারি পরোয়ানা থাকলেও কেউ আটক হয়নি। খাদ্য মন্ত্রণালয়ের শত কোটি টাকার গম আত্মসাৎকারীরা দিব্যি ঘুরছে বুক ফুলিয়ে….?

জাতিরকন্ঠকে সূত্র জানায়, উচ্চ আদালতের নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে জালিয়াতির মাধ্যমে শত কোটি টাকার গম বিক্রি করে দিয়েছে একটি প্রতারক চক্র। খাদ্য মন্ত্রণালয়ের জন্য এই গম আমদানি করা হয়েছিল। গমের পরিমাণ ছিল ৩৩ হাজার মেট্রিক টন। এ ঘটনায় দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) মামলায় আদালত অভিযুক্তদের নামে গ্রেফতারি পরোয়ানা ও তাদের বিদেশ গমনে নিষেধাজ্ঞা জারি করেন। এরপরও এই জালিয়াত চক্রের কেউই গ্রেফতার হয়নি।

দুদকের সহকারী পরিচালক মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা (আইও) এইচ এম আখতারুজ্জামান বলেন, আসামিদের গ্রেফতারে সংশ্লিষ্ট সকল থানা ও বিমানবন্দরে বার্তা পাঠানো হয়েছে। তবে আসামিরা এখনও পলাতক রয়েছেন। তিনি আরও বলেন, শত কোটি টাকা হারানোর পর এ বিষয়ে সরকারের কাছে অভিযোগ দেওয়ায় জীবননাশের হুমকি পেয়েছেন গম সরবরাহকারী মেসার্স সামজিন সিএস অ্যান্ড টি কোম্পানি লিমিটেড (M/S Samjin cs & t co. ltd) নামে একটি কোম্পানির প্রেসিডেন্ট দক্ষিণ কোরিয়ার নাগরিক  হো ম্যান উগ (Hco man Woog)। তিনি এখন মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে দিশেহারা হয়ে পড়েছেন। বিষয়টি দক্ষিণ কোরিয়ায় অবস্থিত বাংলাদেশ দূতাবাসকেও অবহিত করা হয়েছে।

খুলনার হাজী শেখ আশরাফ আলী অ্যান্ড সন্স লিমিটেড এর ম্যানেজিং পার্টনার শেখ আজিজুল ইসলাম জানান, আদালতের নির্দেশে পাওনা আদায়ের জন্য ৩৩ হাজার টন গম থেকে ৭ হাজার টন গম বিক্রির নির্দেশনা পান তিনি। এরপর তিনি গম যেখানে রাখা হয়েছিল সেই মালেক মাঝির গুদামে যান। কিন্তু, সেখানে কোনও গম পাননি। এরপর তিনি গম আত্মসাত করার অভিযোগ এনে জে কে শিপিংয়ের ম্যানেজিং ডিরেক্টর মো. কামরুল ইসলাম, তার পার্টনার আখতারুজ্জামান খান মামুন, সাইফুল ইসলাম এবং মালেক মাঝিসহ ৫ জনের নামে বন্দর থানায় ২০১৫ সালের ৩১ মে মামলা দায়ের করেন। মামলাটি বর্তমানে দুর্নীতি দমন কমিশন তদন্ত করছে।

তিনিও জানান, দক্ষিণ কোরিয়ার ওই কোম্পানির মালিক শতকোটি টাকা হারিয়ে ঋণগ্রস্ত হয়ে এখন মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেছেন। ২০১৫ সালের ২৯ আগস্ট দক্ষিণ কোরিয়া থেকে উগ হো এক ইমেইল বার্তায় তিনি জানিয়েছেন, জে কে শিপিং গম সরবরাহ করতে জঘন্য প্রতারণা করেছে।

চট্টগ্রাম দুদকের সহকারী পরিচালক ও মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা এইচএম আখতারুজ্জামান বলেন, অভিযুক্ত আক্তারুজ্জামান খান মামুন ও কামরুল ইসলামকে আটকের জন্য সংশ্লিষ্ট সকল থানায় গ্রেফতারি পরোয়ানা পাঠানো হয়েছে। কিন্তু তারা পলাতক। একইভাবে এই দুইজনের পাসপোর্ট নম্বর ও ফটোকপি দিয়ে হয়রত শাহজালাল বিমানবন্দরসহ দেশের সকল ইমিগ্রেশন বিভাগকে পত্র দেওয়া হয়েছে। তবে পুলিশ তাদের অবস্থান নিশ্চিত করতে পারছে না। অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে ৩৩ হাজার টন গম আত্মসাতের প্রমাণ রয়েছে।

মামলার প্রত্যক্ষ সাক্ষী অন্য একটি জাহাজের স্থানীয় এজেন্ট মেসার্স এন আর ট্রেড ইন্টারন্যাশনালের মালিক মো. আব্দুর রাজ্জাক দুদকের কাছে লিখিতভাবে জানিয়েছেন, দেশের সর্বোচ্চ আদালতকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে দেশের খাদ্য বিভাগের জন্য আমদানি করা ৩৩ হাজার মেট্রিক টন গম লুট করা হয়েছে। খাদ্য অধিদফতরে ৩৩ হাজার মেট্রিক টন গম সরবরাহের যথেষ্ট সুযোগ থাকা সত্ত্বেও তারা নানা টালবাহানা করে গম আত্মসাৎ করার উদ্দেশ্যে ডিজি ফুডকে গম সরবরাহ করেননি।

বরং জাহাজের ড্রাফট কমানোর কথা বলে দক্ষিণ কোরিয়ার রফতানিকারকের কাছ থেকে প্রায় চার লাখ ডলার আদায় করে। একইভাবে ভুয়া অজুহাত দেখিয়ে শিপিং এজেন্ট শুল্ক কর্তৃপক্ষের অনুমতি নিয়ে জাহাজ থেকে গম খালাস করে মালেক মাঝির গুদামে রাখে, যা পরবর্তীতে এই সিন্ডিকেটচক্র বিক্রি করে দেয়।

তিনি লিখিত আবেদনে আরও জানান, শিপিং এজেন্ট কামরুল ইসলাম ও আখতারুজ্জামান মামুন সিন্ডিকেট অসৎ উদ্দেশ্যে দক্ষিণ কোরিয়ার নাগরিক মেসার্স শামজিনের প্রেসিডেন্ট উগ হো এর নামে মিথ্যা ফৌজদারি মামলা ও গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করে তাকে এখানে এসে কাজ করার ওপর বাধা সৃষ্টি করেন। একইভাবে এই বিদেশি নাগরিকের সই জাল করে শুল্ক কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে গম খালাসের ছাড়পত্র নেওয়া হয়েছে।

জে কে শিপিংয়ের ম্যানেজিং ডাইরেক্টর কামরুল ইসলাম জানান, সংসদে আইন পাস হয়েছে সরকারি ছাড়া ব্যক্তিগত কোনও দুর্নীতির বিষয় দুদক তদন্ত করতে পারবে না। তিনি বলেন, এই ৩৩ হাজার মেট্রিক টন গমের মালিক দক্ষিণ কোরিয়ার নাগরিক। তাই খুলনার হাজী শেখ আশরাফ আলী অ্যান্ড সন্সের ম্যানেজিং ডাইরেক্টর আজিজুল হকের অভিযোগের কোনও ভিত্তি নেই। তিনি আরও বলেন, সবাইকে ম্যানেজ করা হয়েছে। তবে সরকারি অর্থ আত্মসাৎ হয়নি।

মামলা সূত্রে জানা গেছে, খাদ্য বিভাগের সঙ্গে দক্ষিণ কোরিয়ার মেসার্স সামজিন সিএস অ্যান্ড টি কোম্পানি লিমিটেড সঙ্গে ৫০ হাজার (+ ৫%) টন গম সরবরাহ চুক্তি হয়। দক্ষিণ কোরিয়ার এই রফতানিকারক প্রতিষ্ঠান ২০১৪ সালের ৪ জানুয়ারি খুলনার হাজী শেখ আশরাফ আলী অ্যান্ড সন্সকে স্থানীয় বিশেষ প্রতিনিধি (EXCLUSIVE AGENT) নিয়োগ দেয়। এরপর ২০১৪ সালের ২৭ জুলাই ১৯ হাজার ৫০০ মেট্রিক টন গম বোঝাই প্রথম চালান নিয়ে এমভি ব্রেভ লিডার জাহাজ মংলা বন্দরে আসে ও খালাস করে। পরে দ্বিতীয় চালানে ৩৩ হাজার মেট্রিক টন গম নিয়ে এমভি ভিরিশতা জাহাজ ২০১৪ সালের ৬ আগস্ট চট্টগ্রাম বন্দরে পৌঁছে।

কিন্তু এই সময় এমভি ভিরিশতা’র স্থানীয় শিপিং এজেন্ট জে কে শিপিং এর অসহযোগিতায় খাদ্য বিভাগ গমের নমুনা সংগ্রহ করতে পারেনি। এ অবস্থায় নানা টানাপড়েনে জাহাজের গম খালাস নিয়ে অনিশ্চয়তা দেখা দেয়। এ অবস্থার মধ্যে হাজী আশরাফ আলী কমিশনের জন্য বার বার রফতানিকারক প্রতিষ্ঠানকে তাগাদা দিতে থাকেন। তাতেও কাজ না হলে পরে তিনি আদালতের শরণাপন্ন হন।

উচ্চ আদালত এই ৩৩ হাজার মেট্রিক টন গমের ওপর স্থিতাবস্থা জারি করেন। পরবর্তীতে উচ্চ আদালত জাহাজ ছেড়ে দিয়ে জাহাজের বোঝাইকৃত গম নামিয়ে রফতানিকারকের হেফাজতে রাখার অনুমতি দেয়। আদালতের এই আদেশকে ব্যবহার করে জে কে শিপিং গম রফতানিকারকের অনুমতি না নিয়ে তা গুদামজাত করে।

কিছুদিন পর গোপনে ৩৩ হাজার মেট্রিক টন গম প্রতারণা ও জালিয়াতি করে একটি সিন্ডিকেটের মাধ্যমে জে কে শিপিং বিক্রি করে দেয়। কিন্তু খাতা কলমে দেখানো হয় এই গম চট্টগ্রাম মালেক মাঝির গুদামে রক্ষিত আছে। অথচ আদালত নির্দেশ ছিল এই গম স্থান পরিবর্তন বা বিক্রি করা যাবে না। এ জটিলতার খবর পেয়ে দক্ষিণ কোরিয়া থেকে M/S Samjin cs & t co. ltd এর প্রেসিডেন্ট Mr. Hco man Woog ২০১৫ সালের ৯ মার্চ চট্টগ্রাম আসেন। তিনি মালেক মাঝির গুদামে রক্ষিত গমের প্রকৃত অবস্থার সন্ধান করেন।

এ অবস্থায় শিপিং এজেন্ট অসহযোগিতা করে ও তাকে জীবননাশের হুমকি দেয়। এই হুমকির পর রফতানিকারক হো ম্যান উগ চট্টগ্রামের ডবলমুরিং থানায় জে কে শিপিং লাইনের ম্যানেজিং ডিরেক্টর মো. কামরুল ইসলামের নামে সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেন। ২০১৫ সালের ১১ মার্চে করা ৪৯৭ নম্বর জিডিতে তিনি উল্লেখ করেন এই গম বাংলাদেশ সরকারের ফুড ডিপার্টমেন্টে সরবরাহ করার জন্য আনা হয়েছিল।

বিদেশি নাগরিক হয়রানি ও ৩৩ হাজার টন গমের নিরাপত্তা বিধান সংক্রান্ত ঢাকার স্পেশাল ব্রাঞ্চ (এসবি) স্মারক নং ৫৬৩/সা. তাং ২৭/০৫/২০১৫ তারিখে পত্রের তদন্ত শেষে সিটি স্পেশাল ব্রাঞ্চ চট্টগ্রাম মেট্টোপলিটন পুলিশ পরিদর্শক আসাদ করিম চৌধুরী ২০১৫ সালের ২০ জুলাই পুলিশ সুপারকে এই ৩৩ হাজার টন গমের সরেজমিন তদন্ত করে প্রতিবেদন দাখিল করেন।

তিনি প্রতিবেদনে উল্লেখ করেন, চট্টগ্রামের সদরঘাটে অবস্থিত মালেক মাঝির ৫ নং গোডাউনে ৩৩ হাজার মেট্রিক টন গমের কোন অস্তিত্ব খুঁজে পাননি। এই সমুদয় গম মালেক মাঝি ঢাকায় অবস্থিত রোকেয়া ফুড প্রসেসিং ইন্ডাস্ট্রিকে বিভিন্ন তারিখে প্রেরণ করেন। এই ৩৩ হাজার মেট্রিক টন গমের বাজার মূল্য প্রায় একশ কোটি টাকা।