মালেকের লুটের সাম্রাজ্যে-বিএনপির সঙ্গে সুলতানুলের আঁতাত
মানিকগঞ্জ থেকে ফিরে প্রিয়া রহমান : দুর্নীতি লুটপাটের সালতানাত গড়ে তুলে সেই জাহিদ মালেক বিদেশে পালালেও তার সহযোগীরা এখনও বহাল রয়েছে মানিকগঞ্জে।সাম্রাজ্যে ধরে রাখতে বিএনপির সঙ্গে হাত মেলাচ্ছে অনেকে। দেয়া হচ্ছে লুটেরা ভাগ বাটোয়ারাও। ইতিমধ্যে সন্তর্পনে একাধিক ডিল সম্পন্ন করেছে মালেকের চেলারা। লুটের ভাগ পেয়ে বিএনপি নেতাকর্মীরা নিশ্চুপ বনে গেছে বনে গেছে বলে কথা উঠেছে।
আওয়ামী লীগ সরকারে দুই বার স্বাস্থ্যমন্ত্রী থেকে জাহিদ মালেক আলে-আওলাদসহ মহা-ধনপতি বনে গেছেন।এই সেই জাহিদ মালেক যিনি একবার স্বাস্থ্য প্রতিমন্ত্রী, আরেকবার একই মন্ত্রণালয়ের পূর্ণ মন্ত্রীর চেয়ারে বসে লুটপাট করেছেন দেদারছে। গড়ে তোলেন পারিবারিক লুটের সিন্ডিকেটও। এতে জড়িয়ে যান জাহিদ মালেকের স্ত্রী, দুই ছেলে-মেয়ে, বোন, ফুপাতো দুই ভাই এবং মামাতো ভাই ও তার ছেলে।
পারিবারিক সিন্ডিকেটের বাইরে জাহিদ মালেকের ছত্রছায়ায় গড়ে উঠে দলীয় সিন্ডিকেট। এই চক্রে ছিলেন আওয়ামী লীগ, যুবলীগ এবং স্বেচ্ছাসেবক লীগের ১০ নেতাকর্মী। অনিয়ম-দুর্নীতিতে ডুবে জাহিদ মালেক ও তার পরিবারের সদস্যরা যেমন সম্পদের পাহাড় গড়েছেন, তেমনি তার দলীয় সিন্ডিকেটের সদস্যদেরও শত শত কোটি টাকার মালিক বানিয়েছেন। পারিবারিক ও দলীয় এই দুই সিন্ডিকেটের সদস্যদের সম্মিলিত সম্পদের পরিমাণ আড়াই হাজার কোটি টাকার বেশি বলে অনুসন্ধানে মিলেছে।
অভিযোগ রয়েছে, জাহিদ মালেকের ক্ষমতার অপব্যবহার করে তার সিন্ডিকেটের সদস্যরা করোনা মহামারীর সময়ে করোনার টিকা ও কিট আমদানিতে কমিশন-বাণিজ্যের মাধ্যমে হাতিয়ে নিয়েছে কোটি কোটি টাকা। এ ছাড়া স্বাস্থ্য খাতে কেনাকাটা, নিয়োগ, পদোন্নতি, বদলি, পদায়ন, চিকিৎসাসেবা, চিকিৎসাসেবায় ব্যবহৃত যন্ত্রপাতি ব্যবহার এবং ওষুধ সরবরাহসহ ১১টি সুনির্দিষ্ট খাত থেকে দুর্নীতির মাধ্যমে বিপুল অর্থ কামিয়েছেন এ সিন্ডিকেটের সদস্যরা। শুধু স্বাস্থ্য খাতই নয়, নিজের সংসদীয় এলাকায় জমি দখল, বালুমহাল নিয়ন্ত্রণ এবং চাকরি দেওয়ার নামে প্রতারণাসহ ছোট-বড় সব খাতেই অনিয়ম-দুর্নীতিতে জড়িয়েছেন জাহিদ মালেক।
তার স্ত্রী শাবানা মালেক, ছেলে রাহাত মালেক ও বোন রুবিনা হামিদের বিরুদ্ধে সানলাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানির গ্রাহকদের সঙ্গে প্রতারণার অভিযোগ রয়েছে। জাহিদ মালেক, তার ছেলে রাহাত মালেক ও মেয়ে সিনথিয়া মালেক সরকারি ওষুধ কারখানা স্থাপনের জমি অধিগ্রহণের সময় জড়িয়ে পড়েন দুর্নীতিতে। সব মিলিয়ে স্বাস্থ্যমন্ত্রী ও তার পরিবারের সদস্যদের সম্পদের পরিমাণ এক হাজার কোটি টাকার বেশি।
অনিয়ম-দুর্নীতির সাম্রাজ্য পরিচালনায় জাহিদ মালেক তার নির্বাচনী এলাকায় পছন্দের দলীয় নেতাকর্মীদের নিয়ে গড়ে তোলেন একটি সিন্ডিকেট। যার নিয়ন্ত্রণে ছিলেন আওয়ামী লীগ, যুবলীগ ও স্বেচ্ছাসেবক লীগের ১০ নেতাকর্মী, এলাকায় তারা পরিচিত ছিলেন কুতুব নামে। এই ১০ কুতুবের অনিয়মের বিস্তারিত প্রমাণ দেশ রূপান্তরের হাতে এসেছে। তারা নিয়োগ ও টেন্ডারবাণিজ্য, জমি ও বাড়ি দখল, বালুমহাল ইজারা, পরিবহনে চাঁদাবাজি এবং অর্থ আত্মসাতের মাধ্যমে অন্তত ১ হাজার ৫০০ কোটি টাকার সম্পদ গড়েছেন।
জাহিদ মালেক সিন্ডিকেটের অন্যতম সদস্য মানিকগঞ্জ জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আ খ ম সুলতানুল আজম। বাসা মানিকগঞ্জ সদরের পূর্ব দাশড়া এলাকায়। স্থানীয় বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ২০০৮ সালের নির্বাচনের আগে তার অর্থনৈতিক অবস্থা ছিল শোচনীয়। কিন্তু আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর রাতারাতি বদলে যেতে থাকে সুলতানুলের আর্থিক অবস্থা। জাহিদ মালেকের প্রশ্রয় ও আশীর্বাদে তিনি বিপুল সম্পদের মালিক বনে গেছেন।অনুসন্ধানে মিলেছে, সুলতানুল আজমের প্রায় ১ হাজার ২০০ কোটি টাকার অবৈধ সম্পদ রয়েছে।
মানিকগঞ্জ জেলার পুরো পরিবহন খাতের চাঁদাবাজির নিয়ন্ত্রণ ছিল তার হাতে। সড়কে নতুন গাড়ি নামাতে হলে চাঁদা দিতে হতো সুলতানুলকে। তিনি দীর্ঘদিন জেলা ট্রাক মালিক সমিতি এবং এসি লিংক বাস মালিক সমিতির সভাপতি। নতুন ব্যবসা প্রতিষ্ঠান স্থাপন কিংবা জমি কেনাবেচাও তাকে চাঁদা না দিয়ে করা যেত না। পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) এবং সড়ক ও জনপথ (সওজ) অধিদপ্তরসহ জেলার সব সরকারি দপ্তরের টেন্ডারে ছিল তার একক নিয়ন্ত্রণ। জাহিদ মালেকের তদবির ও ছত্রছায়ায় তিনি নিম্নমানের কাজ করে শত শত কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন।
তার কবল থেকে বাদ যায়নি মানিকগঞ্জ ডায়াবেটিস সমিতির অফিসও। সমিতির সাধারণ সম্পাদক পদে বসে সীমাহীন দুর্নীতি ও লুটপাট করেছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। টাকার বিনিময়ে জনবল নিয়োগ এবং কেনাকাটার নামে আত্মসাৎ করেছেন বিপুল অর্থ। মানিকগঞ্জ ও আশপাশের বিভিন্ন জেলার মাদক কারবারের সিন্ডিকেটের সঙ্গেও তার সংযোগ ছিল বলে জনশ্রুতি রয়েছে। তাকে অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের গডফাডার হিসেবে চেনেন এলাকাবাসী। স্থানীয় বাসিন্দা নরেন্দ্র ম-লের ১২ বিঘা জমি জোর করে দখল করেছেন। এ ছাড়া সদর উপজেলার আরও অনেকের জমি দখলের অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে।
সুলতানুল আজমের মালয়েশিয়ায় বাড়ি রয়েছে বলে একাধিক ব্যক্তি জানিয়েছেন। জেলা সদরের শিববাড়ীতে পাঁচতলা বাড়ি রয়েছে তার। শহরের শহীদ রফিক সড়কে স্বর্গ ভবন নামে ৬ শতাংশ জায়গায় ১০ তলা একটি ভবন রয়েছে। সুলতানুলের আরও একটি সাততলা ভবন রয়েছে মানিকগঞ্জ শহরে পৌরভবনসংলগ্ন এলাকায়। এ ছাড়া বিভিন্ন সড়কে চলাচল করা তার ৫০টির বেশি ট্রাক ও এসি লিংক বাস রয়েছে। মানিকগঞ্জ ও সাটুরিয়া উপজেলায় নামে-বেনামে রয়েছে কৃষিজমি। রয়েছে দুটি প্রাডো গাড়ি। শহীদ রফিক সড়কে আছে ২৪ শতক জমি, যেখানে প্রতি শতক জমির দাম ৩০ লাখ টাকা।
জাহিদ মালেকের ফুপাতো ভাই ইসরাফিল হোসেনের ক্ষমতার দাপটে জিম্মি ছিলেন স্থানীয় বাসিন্দারা। ইসরাফিল মানিকগঞ্জ সদর উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও উপজেলা চেয়ারম্যান। জনপ্রিয়তা না থাকার পরও ভোট কেন্দ্র দখল করে জাহিদ মালেক ইসরাফিলকে চেয়ারম্যান বানান বলে অভিযোগ রয়েছে। ইসরাফিলের সম্পদের পরিমাণ ১০০ কোটি টাকার কাছাকাছি। মানিকগঞ্জের সরকারি বালুমহাল যেন সোনার খনি। এটা নিয়ন্ত্রণ করতে ইসরাফিলের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ নেতারা একটি সিন্ডিকেট গড়ে তুলে সেখান থেকে কোটি কোটি টাকা আয় করেন। সদর উপজেলা বাসস্ট্যান্ড থেকে নিয়মিত চাঁদা তুলত তার লোকজন। একদিকে মন্ত্রীর আত্মীয় অন্যদিকে উপজেলা চেয়ারম্যান পরিচয়ে বেপরোয়া ছিলেন তিনি। ক্ষমতার অপব্যবহার করে সরকারি কাজের ঠিকাদারি করতেন। তার দাপটে অন্য কেউ টেন্ডার জমা দিতে পারতেন না।
ইসরাফিলের নামে-বেনামে সম্পদ রয়েছে মানিকগঞ্জ এবং রাজধানী ঢাকার বিভিন্ন এলাকায়। মানিকগঞ্জে তার দুটি ভবন রয়েছে। এ ছাড়া সাভারে একটা ছয়তলা ভবন আছে।
সুলতানুল আজমের মাধ্যমে জাহিদ মালেকের এই সিন্ডিকেটে ঢোকেন যুবলীগ নেতা ও জেলা পরিষদের সদস্য আবুল বশর। টেন্ডারবাজি, সন্ত্রাসী কার্যক্রম ও মাদক কারবারের মাধ্যমে কোটি কোটি টাকা কামিয়েছেন তিনি। তার মালয়েশিয়ায় বাড়ি রয়েছে। তিনি মালয়েশিয়ায় টাকা পাচারের সঙ্গে দীর্ঘদিন ধরে জড়িত বলে অভিযোগ রয়েছে। এ ছাড়া সদর উপজেলার শহীদ রফিক সড়কে তার একটি ফ্ল্যাট রয়েছে। স্থানীয় নয়াডিঙ্গি এলাকায় তার নামে কয়েক একর জমি আছে। রয়েছে ছয়টি এক্সক্যাভেটর ও পাঁচটি ড্রেজার মেশিন।
৪০-৫০ কোটি টাকার মালিক বনে গেছেন ১০ কুতুবের আরেকজন আবদুর রাজ্জাক রাজ। তিনি মানিকগঞ্জ জেলা যুবলীগের আহ্বায়ক এবং পৌর কমিশনার। টাকা পাচারের সুবিধার জন্য তিনি ভারতে একটি বাড়ি বানিয়েছেন বলে জনশ্রুতি রয়েছে। সেখানে শ্যালিকা ও তার স্বামী বসবাস করেন। পূর্ব দাশড়া এলাকায় ৫০ শতক ও তেরগ্রামে ৩৫ শতাংশ জমি আছে তার। শহরের তমা ক্লিনিকে শেয়ার রয়েছে রাজ্জাকের। যুবলীগের আরেক নেতা আবু বকর খানের সম্পদের পরিমাণ ৫০ কোটি টাকা। জাহিদ মালেকের প্রশ্রয়ে টেন্ডার ও চাঁদাবাজি করে যুক্তরাষ্ট্রে টাকা জমিয়েছেন তিনি। তার পরিবারের সদস্যরা থাকেন দেশটিতে। সেখানে তিনি একটি বাড়ি কিনেছেন। জাহিদ মালেক ও তার ছেলের ব্যবসায়িক টাকা পাচারেও সংশ্লিষ্টতা রয়েছে এই রাজ্জাকের।
হরিরামপুর থানা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি সেলিম মোল্লার সম্পদের পরিমাণ ২০-৩০ কোটি টাকা। ঢাকায় পাঁচতলা ও মানিকগঞ্জে তিনতলা দুটি বাড়ি রয়েছে তার। ব্যক্তিগত গাড়ি রয়েছে একাধিক। তিনি নামে-বেনামে সম্পদ গড়েছেন। আর এসব সম্পদ গড়েছেন মুক্তিপণ আদায় ও তদবির-বাণিজ্য করে। জাহিদ মালেকের এলাকার আত্মীয় পরিচয়ে তিনি সচিবালয়ে নিয়মিত যাতায়াত করতেন। চাকরি দেওয়ার কথা বলে শত শত মানুষের কাছ থেকে টাকা নিয়ে আত্মসাৎ করেছেন। সাটুরিয়া উপজেলা আওয়ামী লীগ নেতা আনোয়ার হুসেন খান জাহিদ মালেকের দাপট দেখিয়ে অবৈধ উপায়ে বিপুল সম্পদ গড়েছেন।
১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ যখন রাষ্ট্রক্ষমতায় আসে তখন শোচনীয় অবস্থা ছিল আবদুর রাজ্জাকের পরিবারের। ধারদেনা করে চলত সংসারের খরচ। ২০০৮ সালের পর তিনিও জাহিদ মালেকের সিন্ডিকেটে জড়িয়ে পড়ে ক্ষমতার দাপট দেখাতে শুরু করেন। মানিকগঞ্জ জেলা যুবলীগের এ আহ্বায়ক মিথ্যা অভিযোগে করা মামলায় ফাঁসিয়ে নিরপরাধ মানুষকে জেলে ঢুকিয়ে টাকা আদায় করতেন। তার এখন ছয়তলা ভবন রয়েছে, ব্যক্তিগত গাড়ি ছাড়া চলেন না।
মানিকগঞ্জ পৌর আওয়ামী লীগের যুগ্ম আহ্বায়ক জাহিদুল ইসলাম জাহিদ বাস, ট্রাক ও সিএনজি স্টেশনে চাঁদাবাজি করতেন। মহাসড়কের চাঁদাবাজি দেখভালের দায়িত্ব ছিল তার। সাবেক মন্ত্রীর ছত্রছায়ায় রাজধানীর উত্তরায় ফ্ল্যাট ও ঢাকার সাভারে বাড়ি বানিয়েছেন। মানিকগঞ্জ বাসস্ট্যান্ড এলাকায় তার নামে জমি আছে। তার রয়েছে পরিবহন ব্যবসাও।
সাটুরিয়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে খাবার সরবরাহের দায়িত্বে ছিলেন সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রীর মামাতো ভাই ইউপি চেয়ারম্যান আনোয়ার হোসেন খানের (জ্যোতি) ছেলে মহিদ খান। নিম্নমানের খাবার দিয়ে তিনি বিপুল টাকা কামিয়েছেন। বাবা-ছেলে মিলে নদীতে ড্রেজার বসিয়ে বালু উত্তোলন করতেন। তাদের লামিয়া এন্টারপ্রাইজ নামে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান আছে। কর্নেল মালেক মেডিকেল কলেজে আউটসোর্সিং চাকরি দিতে মহিদ খান জনপ্রতি ৩-৫ লাখ টাকা নিতেন। হরগজের গরুর হাট থেকে মোটা অঙ্কের চাঁদা আদায় করতেন তিনি। এ ছাড়া প্রাথমিক বিদ্যালয়ে চাকরি দেওয়ার নাম করে জনপ্রতি ৫ থেকে সাড়ে ৫ লাখ করে টাকা নিতেন।