• রোববার , ২২ ডিসেম্বর ২০২৪

মাধুরীর খলনায়ক স্টাইলে ঢাকায় খুনীকে ধরতে নারী পুলিশের প্রেমের অভিনয়-নানা প্রশ্ন


প্রকাশিত: ১:৪৭ এএম, ১৯ সেপ্টেম্বর ১৫ , শনিবার

নিউজটি পড়া হয়েছে ২৫৪ বার

 

khalnayok-style-www.jatirkhantha.com.bdপ্রিয়া রহমান.ঢাকা:   মুম্বাইয়ে ‌‌’খলনায়ক’ সিনেমার নায়িকা মাধুরী দিক্ষিত তাঁর মায়াবি অভিনয় যাদুতে (একজন পুলিশ সদস্য হয়েও) যেভাবে একজন ডাকাত (সঞ্জয় দত্ত) সর্দারকে পাকরাও কয়েছিলেন ঠিক একই কায়দায় ঢাকার কাছে ঘটেছে এক থ্রিলাার কাহিনী।মাধুরীর অভিনয়ে চোলি ক্যা পিছে কেয়া হায় এখনও মানুষের মুখে মুখে।
সেই মাধুরী শেষমেষ ধরেছিলেন ডাকাত সর্দার সঞ্জয় দত্তকে। তেমনি কায়দায় ঢাকায়ও ধরা পড়েছে এক খুনী । যার নাম রাজ্জাক। কিন্তু প্রশ্ন উঠেছে এই খুনীকে ধরার কৌশল নিয়ে। কারন. এই খুনীকে ধরতে ওই নারী পুলিশ সদস্যকে প্রেমের khalnayok-www.jatirkhantha.com.bdঅভিনয় করতে হয়।যা নিয়েই প্রশ্ন?পুলিশের নারী সদস্যকে প্রেমের অভিনয়’ করানোর পরিকল্পনা ও তার বাস্তবায়ন প্রকারান্তরে ‘নারী নির্যাতনের পুলিশি কায়দা’ হিসেবেই প্রতীয়মান হলো। হত্যাকারী নারীকে ধরার জন্য পুরুষ পুলিশকে প্রেমের অভিনয়ে নিযুক্ত করার কোনো ঘটনা ঘটেছে কি?

এক নারীকে নির্যাতন ও হত্যার রহস্য উন্মোচনে পুলিশের এক নারী সদস্যকে দিনের পর দিন খুনির সঙ্গে প্রেমের অভিনয় করানো হয়েছে। সেই নারী পুলিশকে দিয়ে খুনের দায়ে সন্দেহভাজনকে প্রেমের ফাঁদে আটকানো হলো। আর এভাবেই আটক হলো রাজধানীর টঙ্গী এলাকার গৃহবধূ জুয়েনার ঘাতক রাজ্জাক ।
দৃশ্যত, এটা সাফল্যের বিবরণ হলেও, অনৈতিকতার সংস্পর্শ থাকায় অপরাধী ধরার পদ্ধতিটি প্রশ্নবিদ্ধ হওয়ার যোগ্য। পুলিশের চাকরিবিধিতে এ রকম ‘প্রেমের অভিনয়’ করার কোনো শর্ত বা নিয়ম আছে বলে জানা নেই। যদি কোনো কারণে এমন অদ্ভুত বিধি থাকতও, ‘নারীর’ এহেন ‘ব্যবহার’ মোটেই গ্রহণযোগ্য নয়।
এ সম্পর্কে সেন্ট্রাল উইমেন্স ইউনিভার্সিটি, ঢাকার অধ্যাপক মালেকা বেগম মনে করেন, খবরটি পড়ে ভীত হয়েছি। পুলিশ করিতকর্মা হলে কীভাবে খুনিকে ধরতে পারে, তা এই ঘটনায় জানা গেল। কিন্তু একই সঙ্গে ‘পুলিশের নারী সদস্যকে প্রেমের অভিনয়’ করানোর পরিকল্পনা ও তার বাস্তবায়ন প্রকারান্তরে ‘নারী নির্যাতনের পুলিশি কায়দা’ হিসেবেই প্রতীয়মান হলো। হত্যাকারী নারীকে ধরার জন্য পুরুষ পুলিশকে প্রেমের অভিনয়ে নিযুক্ত করার কোনো ঘটনা ঘটেছে কি? তবে, সে ক্ষেত্রেও কথা থাকে। পুরুষ পুলিশের প্রেমের অভিনয়, আর চাকরির জন্য নারী পুলিশের অভিনয় মনে হয় একপর্যায়ে পড়ে না।
ঘটনার ধারাবাহিকতা এ রকম: গত ২৫ জুন ২০১৫ তারিখে রাজধানীর উত্তরার ৪ নম্বর সেক্টরের আগাখান স্কুলের সামনের নর্দমায় এক তরুণীর লাশ উদ্ধার করা হয়। তঁার নাম জুয়েনা। পরিচয় নিশ্চিত করার পর পুলিশ বিভাগ অপরাধী ধরার কাজ শুরু করে। কে বা কারা জুয়েনার হত্যাকারী, তা জানতে পুলিশ আগাখান স্কুলের সামনে স্থাপিত সিসিটিভি ফুটেজ পরীক্ষা করে। অনুসন্ধানের ভিত্তিতে পুলিশ জানতে পারে জনৈক রাজ্জাক জুয়েনা খুনের ঘটনার সঙ্গে জড়িত। এসব কার্যক্রমের বিবরণ পত্রিকায় বিস্তারিতভাবে রয়েছে।
সাধারণ ক্ষেত্রে পুলিশ সন্দেহভাজনের বিষয়ে খোঁজখবর করে। অপরাধের সঙ্গে সংশ্লিষ্টতার প্রাথমিক আলামত পাওয়া গেলে তাকে গ্রেফতার করে জিজ্ঞাসাবাদ করে। পুলিশের বহুল আলোচিত ‘রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদের’ পদ্ধতি তো রয়েছেই। কিন্তু জুয়েনা হত্যা-তদন্তে প্রচলিত পথে যাওয়া হলো না। তাঁরা অভিনব এক পদ্ধতির আশ্রয় নিলেন। এক নারী পুলিশ বিভাগের জনৈক নারী সদস্যকে চিহ্নিত সন্দেহভাজনকে ‘পটাতে’ নিয়োজিত করা হয়। সেই নারী পুলিশ দিনের পর দিন সন্দেহভাজন খুনি রাজ্জাকের সঙ্গে মোবাইল ফোনে প্রেমের অভিনয় করে যান। এভাবে আস্থার সম্পর্ক তৈরি করেন রাজ্জাকের সঙ্গে।
এরপর জাল গোটানোর সময় আসে পুলিশের। ১৩ সেপ্টেম্বর রোববার (২০১৫) তিনি রাজ্জাকের সঙ্গে দেখা করার বিষয়টি তাঁর ঊর্ধ্বতনদের জানান। ঘাতক রাজ্জাক তাঁর ছদ্মবেশী ‘প্রেমিকার’ কথামতো নির্দিষ্ট জায়গায় গেল ওত পেতে থাকা পুলিশ তাঁকে আটক করে। এরপর জুয়েনাকে হত্যা করার বিষয়ে পুলিশ নিশ্চিত হয় এবং রাজ্জাকের বিরুদ্ধে মামলা করে।
বাংলাদেশের পুলিশ বিভাগে নারী সদস্যদের কাজ এবং অবস্থান (Status) কী, সেটাও জানা গেল। চিরাচরিত ধ্যানধারণায় পরিচালিত পুলিশ বিভাগ একজন নারীকে ‘টোপ’ হিসেবে ব্যবহার করে পুলিশের মর্যাদা ও নারীর সম্মান দুটোকেই অপমান করেছে। উল্লিখিত নারী পুলিশ ব্যক্তিটি কেনই-বা এমন ন্যক্কারজনক কাজের ভূমিকায় অভিনয় করলেন, সেটাও জিজ্ঞাস্য। এটাকে পেশাগত উৎকর্ষ বলা যায় না। পুলিশ পরিচয়ের চেয়ে তাঁর নারী পরিচয়কেই বড় করা হয়েছে। এবং সেই নারী পরিচয়কে এমনভাবে ব্যবহার করা হয়েছে, যাতে একজন অভিযুক্ত তাঁর প্রতি আকর্ষিত হয়। এ বিষয়ে বিস্তারিত ওই খবরে উল্লেখিত না থাকলেও, বাকিটা আমরা অনুমান করে নিতে পারি। যে রাজ্জাক পরস্ত্রীকে প্রতারণার মাধ্যমে ধর্ষণের পরিস্থিতি তৈরি করে এবং তাতে ব্যর্থ হয়ে ধারালো স্ক্রু ড্রাইভার বুকে বিদ্ধ করে হত্যা করে, তার সঙ্গে প্রেমের অভিনয় করানো খুবই ন্যক্কারজনক কাজ বলেই মনে করি।
পুলিশ বিভাগে ও অন্য সব মন্ত্রণালয়ে নারী সদস্য নিযুক্ত হচ্ছেন যথাযথ শিক্ষাগত ও অন্যান্য যোগ্যতার পরীক্ষায় পাস করে। সেই ক্ষেত্রে নারী সদস্যের পরিচয় হবে ‘ব্যক্তি’। নারী নিজেও ‘ব্যক্তি’ পরিচয়ে নিজ ব্যক্তিত্ব ও যোগ্যতার গুণেই প্রতিষ্ঠিত হওয়ার জন্য সংগ্রাম করছেন। কিন্তু অনেক ক্ষেত্রে কর্মপরিবেশে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার গর্হিত নির্দেশ অমান্য করলে তাঁকে শাস্তি পাওয়ার ঝুঁকিতে থাকতে হয়। ‘চাকরিচ্যুত’ অথবা ‘নির্যাতিত’ হওয়ার ভয় ও ঝুঁকি নারীকে তাঁর ‘ব্যক্তি’ পরিচয়ে দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত হতে দিচ্ছে না। পুলিশ বিভাগে চাকরি করেও, লীলাময়ী ‘নারী’ হিসেবে ব্যবহৃত হওয়ার ঘটনা তারই আরেকটা উদাহরণ হয়ে থাকবে।
পুলিশ বিভাগে পুরুষ পুলিশের দ্বারা নারীরাও নির্যাতিত হয়ে থাকেন। এ রকমই একটি ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে গত মে মাসে প্রথম আলোয় প্রকাশিত সম্পাদকীয়র উল্লেখ বাহুল্য হবে না। তাতে বলা হয়, ‘পুলিশ বাহিনীর সদস্যদের মধ্যে স্ত্রীকে খুন করা, যৌতুকের দাবিতে নির্যাতন চালানো, প্রতারণা করা, এমনকি নারী ধর্ষণের মতো গুরুতর অপরাধেরও অভিযোগ উঠেছে। বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ সংবাদপত্রে প্রকাশিত খবর পর্যালোচনা করে তথ্য দিয়েছে, গত এক বছরে ৪৪ জন নারী আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীগুলোর সদস্যদের নির্যাতনের শিকার হয়েছেন, যাঁদের মধ্যে ৪০ জনই নির্যাতিত হয়েছেন পুলিশ সদস্যদের দ্বারা। তবে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীগুলোর সদস্যদের হাতে নারী নির্যাতনের এই হিসাব পূর্ণাঙ্গ নয়।’
পুলিশ বিভাগের আলোচ্য পদক্ষেপটি ‘নারী পুলিশ’কে যেভাবে অপমানিত করেছে, নির্যাতিত করেছে, তেমন কোনো ‘কৌশলী’ পদক্ষেপ যেন ভবিষ্যতে না নেওয়া হয়, সেই বিষয়ে সরকার ও সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়সমূহের প্রতি আহ্বান জানাচ্ছি।