• বৃহস্পতিবার , ২১ নভেম্বর ২০২৪

মহাসড়কে লুটপাট চেষ্টা


প্রকাশিত: ১১:২৪ পিএম, ১৪ জুলাই ২৪ , রোববার

নিউজটি পড়া হয়েছে ১৩৭ বার

০০ সন্দেহ প্রধান প্রকৌশলীর সিন্ডিকেট
০০ লুটের আয়োজন প্রায় ৩ হাজার কোটি
০০ যশোর মহাসড়ক নির্মাণে ভয়াবহ ব্যয়

শফিক রহমান : সড়ক নির্মাণে লাগাতার বাড়তি খরচ নিয়ে ক্ষুদ্ধ পরিকল্পনা কমিশন। অভিযোগ উঠেছে, সড়ক ও মহাসড়ক বিভাগের একটি সিন্ডিকেট দুর্নীতিবাজ চক্র যোগসাজশ করে কোটি কোটি টাকা লুটপাট করে নিজেরা লাভবান হচ্ছে। বলা হচ্ছে এই চক্রের শিকড় অনেক লম্বা। পরিকল্পনা কমিশনের সন্দেহের তালিকায় রয়েছে সড়কের চীফ ইঞ্জিনিয়ার, সড়কের প্রকল্প পরিচালকসহ জমি অধিগ্রহণের সঙ্গে সংশ্লিষ্ঠরাও। সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণে সরকারী টাকা লোপাটের চেষ্ঠা চলছে বলেও অভিযোগ করা হয়েছে।

এ সম্পর্কে পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য (সচিব) এমদাদ উল্লাহ মিয়া দৈনিক সত্যকথা প্রতিদিন কে বলেন, সড়কের লুটেরা সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণসহ জমি অধিগ্রহণে সংশ্লিষ্ট কিছু বিষয় নিয়ে কমিশন সড়ক ও জনপথ সওজ’র প্রধান প্রকৌশলী, প্রকল্প পরিচালকসহ সংশ্লিষ্টদের কাছে ব্যাখ্যা চেয়েছে। সার্বিক বিষয় নিয়ে রোববার ১৪ জুলাই পরিকল্পনা কমিশনে এসব বিষয়ে বৈঠক হয়েছে বলেও জানান তিনি।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে. যশোর মহাসড়ক নির্মাণে ২০২১ সালে ৩৭৩ একর জমি অধিগ্রহণে ব্যয় ধরা হয়েছিল ৮১৮ কোটি টাকা। গত মাসে সেই জমি অধিগ্রহণে ব্যয় প্রস্তাব করা হয়েছে ২ হাজার ৬৫০ কোটি টাকা। আর একারণে এই প্রকল্পে জমি অধিগ্রহণ, পরামর্শক ব্যয়, সম্ভাব্যতা সমীক্ষা ও পুনর্বাসন ব্যয় বৃদ্ধি নিয়ে পরিকল্পনা কমিশন প্রশ্ন তুলেছে সড়ক ও জনপথ বিভাগের কাছে।

টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান দৈনিক সত্যকথা প্রতিদিন কে বলেন, বাংলাদেশে সড়ক নির্মাণে কিলোমিটারপ্রতি খরচ তুলনামূলক বেশি। এখানে উন্নয়নের নামে একশ্রেণির মানুষকে অর্থ উপার্জনের অবৈধ সুযোগ করে দেওয়া হয়। জমি অধিগ্রহণের নামে রাষ্ট্রীয় সম্পদের অপচয় করা হয়। তিনি বলেন, সড়ক নির্মাণের মতো প্রকল্পেও পরামর্শক নিয়োগ করে এ খরচ আরও বাড়ানো হয়। কিসের ভিত্তিতে সওজ এসব খরচ নির্ধারণ করেছে, তা খতিয়ে দেখা দরকার।

ব্যয় বাড়ার কারণে তিন বছরের ব্যবধানে কিলোমিটারে বাড়তি খরচ ধরা হয়েছে ৬১ কোটি টাকা। জমি অধিগ্রহণ, পুনর্বাসন ও পরামর্শক ব্যয় বাড়তি দেখিয়ে সংশোধিত প্রকল্প প্রস্তাবটি দিয়েছে সড়ক ও জনপথ (সওজ) অধিদপ্তর।
পরিকল্পনা কমিশনে পাঠানো ওই প্রস্তাবে দেখা গেছে, প্রকল্প শেষ হওয়ার কথা ছিল ২০২৩ সালের ডিসেম্বরে। এরপর ব্যয় বৃদ্ধি ছাড়াই প্রকল্পের মেয়াদ ২০২৬ সালের জুন পর্যন্ত করা হয়। পরে গত মাসে প্রকল্পের মেয়াদ ছয় মাস বাড়িয়ে এ-সংক্রান্ত প্রথম সংশোধন প্রস্তাব পরিকল্পনা কমিশনে পাঠায় সওজ। এতে জমি অধিগ্রহণ ব্যয় ৩ গুণ বাড়িয়ে ২ হাজার ৬৫০ কোটি টাকা করার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে।

ঝিনাইদহ-যশোর মহাসড়ক উন্নয়ন প্রকল্পের নথিপত্র পর্যালোচনা করে দেখা যায়, ২০২১ সালে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভায় প্রকল্পটি অনুমোদন পায়। তখন প্রকল্প ব্যয় ধরা হয়েছিল ৪ হাজার ১৮৭ কোটি টাকা। সর্বশেষ সংশোধনী প্রস্তাবে ব্যয় ২ হাজার ৯১৩ কোটি টাকা বেড়ে হয়েছে ৭ হাজার ১০০ কোটি টাকা। জমি অধিগ্রহণের বাইরে পুনর্বাসন ব্যয় ১০৪ কোটি টাকা ও পরামর্শক ব্যয় ৩৭ কোটি টাকা বৃদ্ধির কথা উল্লেখ করা হয়েছে।

৪৮ কিলোমিটার দীর্ঘ এই মহাসড়ক বর্তমানে দুই লেনের। মহাসড়কের ছয় লেন নির্মাণে ৩৭৩ একর জমি অধিগ্রহণ করার কথা। নথিপত্পত্রে দেখা যায়, ২০২১ সালে প্রকল্পটি অনুমোদনের সময় জমি অধিগ্রহণে ব্যয় ধরা হয় ৮১৮ কোটি টাকা। তখন প্রতি শতক জমির দাম ধরা হয় ২ লাখ ১৯ হাজার টাকা। তিন বছরের ব্যবধানে সর্বশেষ প্রস্তাবে প্রতি শতকের দাম ধরা হয়েছে ৭ লাখ ১০ হাজার টাকার বেশি। অর্থাৎ প্রতি শতকে বাড়তি দাম প্রায় ৫ লাখ টাকা।

সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ২০১৭ সালে স্থাবর সম্পত্তি অধিগ্রহণ ও হুকুমদখল আইন পাস হয়। এর পর থেকে সরকারি বিভিন্ন প্রকল্পে জমি অধিগ্রহণে দামের ক্ষেত্রে ‘বাণিজ্য’ শুরু করেন অসাধু ব্যক্তিরা। এই আইনে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তি জমির মূল্যের তিন গুণ ক্ষতিপূরণ পান। তা ছাড়া অধিগ্রহণের নোটিশ দেওয়ার আগে যদি কেউ জমিতে স্থাপনা করেন, তাহলে স্থাপনার ক্ষতিপূরণ পাওয়া যায় দুই গুণ। তবে নোটিশ দেওয়ার পর আর জমির শ্রেণি পরিবর্তন করার সুযোগ থাকে না। যদিও নোটিশ জারির আগেই সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা ও স্থানীয় প্রভাবশালী ব্যক্তিরা যোগসাজশ করে জমির শ্রেণি পরিবর্তন করে ফেলেন।

সরেজমিনে দেখা যায়, যশোর সদরের বারীনগর বাজার এলাকার মানিকদিহিতে ঝিনাইদহ-যশোর মহাসড়কের পাশে চারতলা ভবন। ফাঁকা মাঠের মধ্যে ইটের ভাটার সঙ্গেই নির্মাণ করা হয়েছে ভবনটি। আশপাশের লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, দোতলা ভবনটি বছরখানেক আগে হয়ে গেছে চারতলা। পাশেই রয়েছে আরেকটি দোতলা ভবন, সেটিও বছর দেড়েক আগে নির্মাণ করা হয়েছে। ঝিনাইদহ বাস টার্মিনাল থেকে যশোরের পালবাড়ী পর্যন্ত ঘুরে মহাসড়কের পাশে অন্তত ৩৫টি পাকা, সেমিপাকা ও টিনশেড ঘর দেখা গেছে।ঝিনাইদহ জেলা প্রশাসকের কার্যালয় সূত্র বলছে, জমি অধিগ্রহণে সদর উপজেলায় নোটিশ দেওয়া হয় গত বছরের জানুয়ারিতে। এর আগেই সদর উপজেলায় সড়কের দুই পাশে অনেক শিল্পপ্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে। ছোট ছোট দোকানপাট, বাজার হয়েছে। কারখানা হয়েছে। চালকল হয়েছে।

জেলা প্রশাসন জমির দাম নির্ধারণ করে। যদিও সওজ জেলা প্রশাসনের মাধ্যমে জমির দাম নির্ধারণ না করেই সংশোধনী প্রকল্প প্রস্তাব পরিকল্পনা কমিশনে পাঠিয়েছে। সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের একটি নথি পর্যালোচনা করে দেখা যায়, ৩৭৩ একর জমি অধিগ্রহণে সড়ক পরিবহন মন্ত্রণালয় থেকে প্রশাসনিক আদেশ জারি করা হয় ২০২২ সালে। অথচ এ আদেশ জারির এক বছর দুই মাস পর ওই আদেশের বিষয়ে ঝিনাইদহ জেলা প্রশাসকের কার্যালয়কে জানানো হয়। এরই মধ্যে স্থানীয় লোকজন দুই পাশে স্থাপনা গড়ে তুলেছেন।

ঝিনাইদহ জেলা প্রশাসক এস এম রফিকুল ইসলাম বলেন, ঝিনাইদহ-যশোর মহাসড়কের জন্য জেলা প্রশাসকের কার্যালয় এখনো জমির দাম ঠিক করেনি। দাম কীভাবে নির্ধারিত হয়েছে, তা তিনি জানেন না। তবে দাম নির্ধারণের কাজ চলছে বলে তিনি জানান।প্রকল্পে জমি অধিগ্রহণের দাম কীভাবে ঠিক হলো সে সম্পর্কে সওজের কর্মকর্তারা বলছেন, ২০২১ সালে ধারণার ওপর নির্ভর করে জমির মূল্য নির্ধারণ করা হয়। একটি পরামর্শক প্রতিষ্ঠান উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাবনা (ডিপিপি) তৈরি করার সময় জমির ওই প্রাথমিক মূল্যটি দিয়ে দেয়। সেই প্রস্তাবই একনেকে পাস হয়। এবারও (প্রকল্পের প্রথম সংশোধনী) জমির মূল্য ধরা হয়েছে ‘অনুমানের’ ওপর। এখন জমির বর্তমান বাজারদর, হালনাগাদ মৌজা দরের কারণে ভূমি অধিগ্রহণে ব্যয় বেড়ে গেছে। এটাও সম্ভাব্য ব্যয় প্রস্তাব।

এসব সম্পর্কে জানতে প্রকল্প পরিচালক ও সওজের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী জাবেদ হাসানের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তাঁকে পাওয়া যায়নি। পরে ম্যাসেজ পাঠানো হলেও তিনি যোগাযোগ করেননি। ঝিনাইদহ সওজের নির্বাহী প্রকৌশলী মোয়াজ্জেম হোসেন দৈনিক সত্যকথা প্রতিদিন কে বলেন, সওজ জমির একটা দাম ধরে পরিকল্পনা কমিশনে পাঠিয়েছে। জেলা প্রশাসকের কার্যালয় থেকে চূড়ান্ত দাম পাওয়ার পর তা সমন্বয় করা হবে। তিনি আরও বলেন, ‘জমির মূল্য নির্ধারণ যেভাবে হয়েছে, সেটিকে আপনি ত্রুটি বলতে পারেন। চূড়ান্ত নোটিশ (৪ ধারা) দেওয়ার আগে অনেকে জমিতে স্থাপনা করে ফেলেছেন।’

পরিকল্পনা কমিশনে প্রস্তাব পাঠানোর আগে তা দেখার দায়িত্ব সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের। এ বিষয়ে সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের অতিরিক্ত সচিব (পরিকল্পনা অনুবিভাগ) জাকির হোসেন দৈনিক সত্যকথা প্রতিদিন কে বলেন, জমির মূল্য নির্ধারণ করে জেলা প্রশাসকের কার্যালয়। সড়ক মন্ত্রণালয় শুধু দেখে কাগজপত্র ও প্রক্রিয়া ঠিক আছে কি না। এ মন্ত্রণালয়ে দেড় শতাধিক প্রকল্প আছে। এভাবে খুঁটিনাটি বিষয় দেখার সময় থাকে না। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, গত নভেম্বরে অনুমোদন পাওয়া ফরিদপুরের ভাঙ্গা থেকে যশোরের বেনাপোল পর্যন্ত সড়ক নির্মাণে প্রতি কিলোমিটারে খরচ হচ্ছে ১৪০ কোটি টাকা। এর আগে অনুমোদন পাওয়া ঢাকা-সিলেট বিদ্যমান দুই লেনের সড়ককে চার লেনে উন্নীত করতে কিলোমিটারে খরচ হচ্ছে ৮২ কোটি টাকা।