মশা মারতে কামান দাগাচ্ছে সালমা ইসলাম-ডা.মীম-এমপি’র ঘটনা বিহিত হওয়া জরুরি
ডা. আবুল হাসনাৎ মিল্টন: গত কয়েকদিন ধরে ফেসবুক উত্তাল। ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের জরুরি বিভাগে গত ২৮ জুলাই ঘটে যাওয়া একটি ঘটনা নিয়েই এই উথাল-পাথাল। ঘটনাটি ঘটেছে ঢাকা-১ আসনের (দোহার-নবাবগঞ্জ) মাননীয় সংসদ সদস্য, সাবেক মহিলা ও শিশুবিষয়ক প্রতিমন্ত্রী, জাতীয় মহিলা পার্টির সভাপতি অ্যাডভোকেট সালমা ইসলাম এবং সেই মুহূর্তে জরুরী বিভাগে কর্মরত চিকিৎসক ডা. নুনজেরুল মোহসেন মীমের মধ্যে। সংঘটিত ঘটনাটি নিয়ে ইতিমধ্যে কয়েকরকমের ভাষ্য পাওয়া যাচ্ছে। তবে ভাষ্যগুলো মনোযোগ সহকারে বিশেষণ করলে কারো বুঝতে কষ্ট হবার কথা না কোনটা সত্য আর কোনটা আপন মনের মাধুরী মেশানো, বানোয়াট।
ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের একজন প্রাক্তন ছাত্র হিসেবে এবং ইন্টার্ণশীপ প্রশিক্ষণের অংশ হিসেবে জরুরি বিভাগে কয়েক রাত কাজ করবার সামান্য অভিজ্ঞতায় আমি দেখেছি, অফিস আওয়ারের বাইরে জরুরি বিভাগে রোগীর কী পরিমান ভীড় থাকে এবং একজন ইমার্জেন্সি মেডিক্যাল অফিসারকে তাদের চিকিৎসা সেবা দিতে গিয়ে কী পরিমান ব্যস্ত থাকতে হয়!
অবস্থাভেদে কিছু রোগীকে ডাক্তার রুমে বসে দেখেন, আবার কিছু রোগীকে পাশের নির্ধারিত পর্যবেক্ষণ কক্ষে গিয়ে দেখতে হয়। অর্থাৎ কাজের ধরণ অনুযায়ী ডাক্তারের পক্ষে সারাক্ষণ নিজের রুমে বসে থাকা সম্ভব নয়। সুতরাং সম্মানিত এমপি মহোদয় রুমে গিয়ে ডাক্তারকে তার চেয়ারে নাও পেতে পারেন, এটি কর্তব্যে অবহেলা নয়। আমি নিশ্চিত নই, মাননীয় এমপি মহোদয়ের সাথে সেই মুহূর্তে কতজন লোক ছিলেন?
তার মত একজন জননন্দিত এবং প্রভাবশালী এমপি ঢাকা মেডিক্যাল হাসপাতাল প্রাঙ্গনে পা রাখবেন, তা যে কারণেই হোক না কেন, হাসপাতালের সবার জন্যই তা ভীষণ সৌভাগ্যের ব্যাপার। আমি ঠিক জানি না তিনি হাসপাতালের পরিচালককে অবহিত করে গিয়েছিলেন কী না, কারণ সে ক্ষেত্রে জরুরি বিভাগ নয়, তাঁর তো হাসপাতালের প্রধান ফটক দিয়ে পরিচালকের রুম হয়েই পরিচালকের সাথেই জরুরি বিভাগে যাওয়ার কথা।
তবে চাইলে মাননীয় এমপি মহোদয় সরাসরিই হাসপাতালের জরুরি বিভাগে যেতে পারেন, তাতে কারো কোন আপত্তি থাকার কথা না। তবে পরিস্থিতি যাই হোক, ডা. মীমের উচিত ছিল সবকিছু ম্যানেজ করা। বাংলাদেশের মত দেশে একজন এমপি জরুরি বিভাগে গিয়ে একজন চিকিৎসকের চেয়ারে বসবেন, তাঁর সাথে প্রচুর লোক থাকবে এবং তাদের উপস্থিতিতে জরুরি বিভাগে সাধারণ মানুষের চিকিৎসা সেবার সাময়িক ব্যাঘাত ঘটতেই পারে। এটাই স্বাভাবিক এবং এতে কিছু যায় আসে না, কারণ একজন এমপি মানে দেশের ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ একজন ব্যক্তি! জরুরি বিভাগের চিকিৎসক হিসেবে এরকম পরিস্থিতি সামাল দেবার দক্ষতা অর্জন তাই তার কাজেরই অংশ। বয়সে তরুণ, অপেক্ষাকৃত কম অভিজ্ঞ ডা. মীম এখানে দায়িত্ব পালনে এক ধরণের ব্যর্থই হয়েছেন বলা যায়।
প্রত্যক্ষদর্শীর ভাষ্যানুযায়ী, ডা. মীম নাকি একজন রোগীকে চিকিৎসা দিয়ে রুমে এসে সাংসদকে দেখে বলেছিলেন ‘এখানে অনেক গরম ম্যাডাম আপনি পরিচালক স্যারের রুমে বসুন’। তাতেই মহা অন্যায় করে ফেলেছেন এই তরুণ চিকিৎসক! এমপি ম্যাডামের সাথীদের ঔদ্ধত্যের কথা আর নাই-বা বললাম!
অফিস কক্ষ থেকে একজন মহিলা চিকিৎসককে তুলে নেবার হুমকি প্রদান কেমন সভ্যতার মধ্যে পড়ে, এমপি মহোদয়ের কাছে বড় জানতে ইচ্ছে করে। অথচ ডা. মীমের এই তথাকথিত ব্যর্থতার জন্য ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ তাকে কারণ দর্শাও নোটিশ দিয়েছে!
এই ঘটনাটি নিয়ে শ্রদ্ধেয় সালমা ইসলামদের পারিবারিক মালিকানাধীন পত্রিকা, পাঠকপ্রিয় দৈনিক যুগান্তর যেভাবে ধারাবাহিক প্রতিবেদন প্রকাশ করা শুরু করেছে তাতেও যুগপৎ অবাক এবং ব্যথিত না হয়ে পারিনি। সাথে যমুনা টেলিভিশনও পিছু লেগেছে। একজন সামান্য নারী চিকিৎসকের বিরূদ্ধে সত্য-মিথ্যা মিলিয়ে এইভাবে ঝাপিয়ে পড়া কোন ধরণের সাংবাদিকতা?
তার দায়িত্ব পালনে অবহেলা কিংবা ব্যর্থতার সাথে তার পারিবারিক জীবন, শ্বশুর বাড়ির আত্মীয়-স্বজনের সাথে সম্পর্ক, কাজের ফাঁকে ছুটিতে ঢাকার বাইরে প্রাকটিস করার কী সম্পর্ক? দুটো বাড়তি উপার্জনের জন্য সপ্তাহান্তের ছুটিতে ঢাকার বাইরে নবীন চিকিৎসকদের অনেকেই যায়, এটাতো অবৈধ বা গোপন কোন ব্যাপার নয়। কথায় কথায় অনেকেই চিকিৎসা পেশার দায়িত্ব-নৈতিকতা নিয়ে কথা বলেন। চিকিৎসা পেশায় দায়িত্ব আছে,নৈতিকতা আছে, সাংবাদিকতায় নাই?
হাতে কলম থাকলেই যা ইচ্ছা তাই লেখা যায়? এবং আমরা নিরীহ আমজনতা এবং চিকিৎসকরা তা মুখ বুজে সয়েই যাবো? সামান্য লেখালেখির সুবাদে ঢাকার অনেক সাংবাদিকের সাথেই আমার ব্যক্তিগত পরিচয় রয়েছে, তাদের শ্রম- মেধা ও আন্তরিকতায় মুগ্ধ না হয়ে পারি না। অথচ কতিপয় অসৎ-অদক্ষ তথাকথিত সাংবাদিকের জন্য এই মহান পৈশার শরীরে আজ হলুদের দাগ!
সারা জীবন শুনে এসেছি ’বাঁশের চেয়ে কঞ্চি বড়।’ এক্ষেত্রেও কি তাই ঘটছে? আমার বিশ্বাস করতে কষ্ট হয় যে প্রিয় সালমা ইসলামের নির্দেশে ডা. মীমের বিরূদ্ধে দৈনিক যুগান্তরে তথ্য সন্ত্রাস চলছে। তিনি ব্যস্ত রাজনীতিবিদ, তার কি এত তুচ্ছ বিষয়ে মাথা ঘামানোর মত সময় আছে? যদি তিনিই এসব করিয়ে থাকেন, তবে নিঃসন্দেহে তা নিন্দনীয়। আর যদি আগ বাড়িয়ে কিছু অদক্ষ, অযোগ্য কলমধারী সাংবাদিক তাঁর কৃপালাভের জন্য এহেন দুষ্কর্মটি করে থাকে, তবে সেটা বন্ধ করার দায়িত্বও এমপি মহোদয়ের। সত্য যেটাই হোক, মিসেস সালমা ইসলামের ভাবমূর্তি কিন্তু ব্যাপকভাবেই ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে। মাননীয় এমপি মহোদয় এবং তাঁর শুভাকাক্সিখরা কি একবারো ভেবে দেখছেন দেশের চিকিৎসকদের একটি বিরাট অংশ কী নেতিবাচক ধারনা পোষণ করছেন, এমপিকে নিয়ে কী ধরণের মন্তব্য করছেন?
সেসবের সামান্য কিছু আমার চোখে পড়েছে, আমি তাতেই মর্মাহত। এই লেখা যখন লিখছি তখন দেখতে পাচ্ছি, কেবল চিকিৎসকরাই নন, সাধারণ মানুষও সালমা ইসলাম এমপি সম্পর্কে বিরূপ মন্তব্য করছে। একজন এমপিতো একটি প্রতিষ্ঠান, সে তো কেবল ব্যক্তি সালমা ইসলাম নয়, তার অপমানতো আমাদের কারো জন্য মঙ্গলজনক নয়।
ডা. মীম এবং সালমা ইসলাম এমপি’র ঘটনায় কিছুটা দেরীতে হলেও অবশেষে ফেসবুকের ম্ধ্যামে বাংলাদেশ মেডিক্যাল এসোসিয়েশনের (বিএমএ) একটি প্রতিক্রিয়া পেলাম। তবে প্রতিক্রিয়াটি আরো আগে পেলে বেশী খুশী হতাম। কারন গত কয়েকদিনে বিএমএর প্রতি নবীন চিকিৎসকদের তফাভটাও কিন্তু খুব তীব্রভাবেই ফুটে উঠেছে। তারুণ্যের এই ক্ষোভকে কেবল মাত্র ‘অতি বিপবীর হঠকারিতা’ভাবলেই চলবে না। বিএমএর উচিত আত্মানুসন্ধানে মগ্ন হওয়া, কেন তরুণ চিকিৎসকরা তাদের উপর আস্থা রাখতে পারছে না?
বাংলাদেশে কর্মক্ষেত্রে সরকারি চিকিৎসকদের নিরাপত্তা আজ হুমকির মুখে। তাদের সামাজিকভাবে বিপন্ন করার একটা প্রবণত্ওা আজকাল চোখে পড়ছে। এমতাবস্থায়, আমরা বিএমএ’র কাছে আরো সুচিন্তিত এবং শক্তিশালী কার্য্যক্রম আশা করি। বিড়ালের মিউ মিউ নয়, আমরা তাদের কাছে বাঘের গর্জন চাই। ঘটনা ঘটার সাথে সাথে কেন শীর্ষ নেতৃত্বের কেউ একজন হুংকার দিয়ে বলে ওঠে না, ‘আর যদি আমার একজন ডাক্তারকে অপমান করা করা হয়, তাকে কর্মক্ষেত্রে হেনস্থা করা হয়, কিংবা আঘাত করা হয়, তবে বাংলার চিকিৎসক সমাজ মুখে আঙ্গুল দিয়ে বসে থাকবে না। আমরা আক্রমনকারী/সন্ত্রাসী/ হেনস্থাকারীর দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চাই। আমাদের রাজপথে নামতে বাধ্য করবেন না। কর্মক্ষেত্রে চিকিৎসকদের সম্পূর্ণ নিরাপত্তা দিতে হবে, এ ব্যাপারে কোন আপোষ নেই’। বর্তমান প্রেক্ষিতে আমারতো মনে হয়, রাজপথে আন্দোলনেরও প্রয়োজন নাই। সমর্থিত দল ক্ষমতায়, চিকিৎসক নেতৃত্বের একাংশের জন্য এটাতো পাস পয়েন্ট হবার কথা, সরাসরি নীতিনির্ধারকদের সাথে যৌক্তিক আলোচনা করেইতো অনেককিছু আদায় করতে পারার কথা।
ডা. মীমের সাথে আমার ব্যক্তিগত পরিচয় নেই, তবু চিকিৎসক হিসেবে সে আমার ছোট বোন। তার এই দুঃসময়ে আমরা তার পাশে দাঁড়াতে চাই, চিকিৎসক পেশার মর্যাদা সমুন্নত রাখার স্বার্থে এটি আমাদের নৈতিক দায়িত্বও বটে। কর্মক্ষেত্রে তার বিরূদ্ধে একটি অভিযোগ উত্থাপিত হয়েছে। সঠিক ও প্রভাবমুক্ত তদন্ত সাপেক্ষে যদি সে দোষী সাব্যস্ত হয়, তবে তার প্রাপ্য শাস্তি তাকে দেওয়া হোক। এই নিয়ে কারো কোন দ্বিমত থাকবার কথা নয়। তবে গৃহীত প্রশাসনিক পদক্ষেেপ শেষ হবার আগেই অযাচিতভাবে তার চরিত্র হণনের অপচেষ্টা মোটেও গ্রহণযোগ্য নয়। এর মধ্য দিয়ে সমগ্র চিকিৎসা পেশাকেই জনগনের কাছে হেয় করার একটি প্রবণতাও লক্ করা যাচ্ছে। আমরা এর তীব্র প্রতিবাদ করছি।
একজন এমপি সবার কাছে সম্মানিত হয়ে থাকবেন এটাই আশা করি।ক্ষমতা থাকলেই তার অপব্যবহার করতে হবে এটা যেন কেউ না ভাবেন। মিডিয়ার মালিক হলেই তথ্য সন্ত্রাস চালাতে হবে এমন কোন কথা নেই। আমরা যেন ভুলে না যাই, বর্তমান প্রযুক্তির যুগে বিকল্প মিডিয়ার ক্ষমতাও কিন্তু কম নয়। আর চিকিৎসকরা ঐক্যবদ্ধ হলে কী পরিণতি হয় তা জানার জন্য বেশী কষ্ট করতে হবে না, মাননীয় এমপি যেন তার মূলদলের প্রধান নেতাকেই জিজ্ঞেস করেন। একজন নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরও দায়বদ্ধতা আছে, তার আচরণেরও সীমা থাকা উচিত। এই সত্যটা মাননীয় সালমা ইসলাম এমপি যত দ্রুত অনুধাবন করবেন ততই তাঁর ও দেশের রাজনীতির জন্য মঙ্গল।
আমি আসলে বুঝতে পারি না, দেশের মেধাবী একটি পেশাজীবী গোষ্ঠীকে হেয় করে, তাদের শরীরে ‘কসাই’ তকমা লাগিয়ে আখেরে কাদের লাভ? কথায় কথায় তাদের অপমান করা হবে কেন? এর একটি বিহিত হ্ওয়া দরকার। একজন প্রবীন রাজনীতিবিদ হিসেবে এবং স্বাস্থ্য মন্ত্রনালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রী হিসেবে জননেতা মোহাম্মদ নাসিম এই ঘটনার একটি সুষ্ঠ সমাধান করতে পারেন।
স্বাস্থ্যমন্ত্রী হিসেবে চিকিৎসা পেশার মর্যাদা সমুন্নত রাখার দায়িত্ব তাঁর উপরও কিছুটা বর্তায়। মাননীয় স্বাস্থ্যমন্ত্রীর কাছে এই প্রত্যাশাটি সঙ্গতও বটে।-ডাঃ আবুল হাসনাৎ মিল্টন, কবি ও চিকিৎসক। বর্তমানে অস্ট্রেলিয়াস্থ নিউক্যাসেল বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনারত।ই-মেইল: miltonhasnat@gmail.com